মোমবাতির আলোয় ৩০ শিক্ষার্থীর ‘দুর্বিষহ’ জীবন

নগরে সরকারি উপজাতীয় ছাত্রাবাস

নিলা চাকমা »

কারো বাবা-মা দিনমজুর, কৃষক, কারো আবার বাজারে শাক সবজি বিক্রি করে সংসার চালান। পাহাড়ের অসচ্ছল পরিবারের সন্তানেরা চট্টগ্রামে পড়াশোনার সুযোগ পেলে সরকারি এই উপজাতীয় ছাত্রাবাসেই উঠে। হোস্টেলে বিন্দুমাত্র সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছে না ছাত্ররা। হোস্টেলের ভবন জরাজীর্ণ, পানির সংকট, ছাদ থেকে পলেস্তারা খুলে পড়ছে। সর্বশেষ ৭ মার্চ বিদ্যুৎ বিল বকেয়া থাকায় লাইন বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়। রাত হলেই মোমবাতি জ্বালিয়ে পড়াশোনা করতে হচ্ছে পাহাড়ের ৩০ শিক্ষার্থীর। ২৭ মার্চের মধ্যে ৫ লাখ টাকার বকেয়া বিল পরিশোধ না হলে হোস্টেলের নামে মামলা করা হবে।

নগরীর পাথরঘাটার ব্যান্ডেল রোডে আবস্থিত সরকারি উপজাতীয় ছাত্রাবাস। সরেজমিনে গতকাল সকালে গিয়ে দেখা যায় হোস্টেলের প্রবেশমুখ সাজানো গোছানো। গেট-দেয়াল সবকিছু রং করা। দেখে বুঝার উপায় নেই ভবনটি জরাজীর্ণ। ভেতরে প্রবেশ করে দেখা গেছে ৭টি রুম রয়েছে। তার মধ্যে ৫টিতে গাদাগাদি করে ৩০ জনের মতো ছাত্র বসবাস করেন। বাকি দুটির একটি টিভি রুম, আরেকটি গেস্ট রুম। টিভি রুমের পাশেই একটিতে ছাদ থেকে পলেস্তারা খসে পড়ছে। সেখানে ২০২২ সালে পরিদর্শনের পর বসবাস না করার জন্য নির্দেশ দিয়ে যান প্রাক্তন কমিশনার আশরাফ উদ্দিন। এছাড়া কোনো কোনো রুমে ফ্যান-বাতি নষ্ট, কোনো রুমে আবার খাট-টেবিল ভাঙ্গা। একটা ভালো রান্না ঘর নেই। ভবনের পাশে কয়েকটি টিন নিয়ে বানানো হয়েছে রান্নাঘর। সেখানে দরজা না থাকায় প্রায় সময় মালামাল চুরি হয়ে যায়। রান্নাঘরের পাশে লাগোয়া ড্রেনে জমে রয়েছে ময়লা-আর্বজনা।

ছাত্রাবাসটির তিন নাম্বার রুমে গিয়ে দেখা যায় ওখানে পড়াশোনা করছেন নুচামং মারমা এক শিক্ষার্থী। তিনি অনার্স শেষ বর্ষের পরীক্ষার্থী। তিনি বলেন, ‘আমাদের হোস্টেলে ৭ মার্চ থেকে কোনো বিদ্যুৎ নেই। বিল বকেয়া থাকায় লাইন কেটে দেয়া হয়েছে। ২৭ মার্চের মধ্যে বিল পরিশোধ না হলে হোস্টেলের নামে মামলাও হতে পারে। এখন আমাদের দিনের আলোতে পড়তে হয়। রাতে মোমবাতি জ্বালিয়ে পড়াশোনা করতে হয়। শহরে থেকেও মনে হচ্ছে আমরা পাহাড়ে বসবাস করছি। রাত হলেই কোনো রুমে লাইট জ্বলে না। বিদ্যুৎ না থাকায় পানি তুলতে পারিনা। প্রতিদিন পানি কিনে খেতে হয়। পানির বিল ১০০ টাকার উপরে যায়। বাবা-মার এত টাকা নেই; তাই এখানে উঠেছি। কিন্ত সীমাহীন কষ্টের মধ্যে দিন কাটাতে হচ্ছে। আমাদের সসম্যা দেখার মতো কেউ নেই। দ্রুত বিদ্যুতের ব্যবস্থা না হলে পড়াশোনাটা হয়ে উঠবে না।’

জানা গেছে, পাহাড়ের ছাত্রদের পড়াশোনার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য শহরে ১৯৫৮ সালে জায়গাটি কেনা হয়। তৎকালীন রাঙামাটি ডেপুটি কমিশনার সৈয়দ আফজাল আগা এ জায়গা কিনেন। বিন্দুবাসী দেবী নামে এক মহিলার কাছ থেকে ১১ শতক জায়গা ৪০ রূপী দিয়ে কিনে নেন তিনি। ১৯৫৮ সাল থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত টিনের ঘর ছিলো। সেই ঘরে মানবেন্দ্র নারায়ন লারমাসহ অনেক পাহাড়ি ছাত্র পড়াশোনা চালিয়ে গেছেন। ১৯৯০ সালের দিকে ৭ রুম বিশিষ্ট একতলা ভবনটি নির্মাণ করা হয়। ১৯৯০ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন বিভাগীয় কমিশনার আলী হায়দার খান এ ছাত্রাবাসটি উদ্বোধন করেন। অবকাঠামো নির্মাণ করা হলেও নাম ঠিকানা পরিবর্তন হয়নি। যার কারণে ২০১১-১০১৬ সাল পর্যন্ত নাম পরিবর্তন করে নেন মালিকপক্ষ। কিন্তু হোস্টেলের কমিটি ঘুণাক্ষরেও তা টের পায়নি। পরে আদালত থেকে নোটিশ এলে জানা যায় জায়গাটি দখলের চেষ্টা চলছে। ২০১৭ সালে প্রমাণের কাগজপত্র নিয়ে পাল্টা মামলা করা হয়। সেখানে সরকার পক্ষের জয় হয়। বর্তমানে রাঙামাটি ডেপুটি কমিশনারের নামে জায়গাটির নাম লিপিবদ্ধ রয়েছে।

হোস্টেল পরিচালানার জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়। সেখানে বিভাগীয় কমিশনার সভাপতি, তিন পার্বত্য জেলার ডিসিরা সদস্য – তিন পার্বত্য জেলার ডিসিদের মনোনীত ৩ জন অভিভাবক প্রতিনিধি রাখা হয়েছে। কমিটিতে তিন পার্বত্য জেলার পরিষদ, উন্নয়ন বোর্ড, চট্টগ্রাম জেলা পরিষদকে সম্পৃক্ত রাখা হয়েছে। এছাড়া একজন মেম্বার সেক্রেটারি, ১ জন তত্ত্বাবধায়ক এবং চিপ মনিটর হিসেবে ১জন রয়েছেন।

এদিকে ছাত্রাবাসটির ভোগান্তি নিয়ে ছাত্র হেলেন চাকমা আরও বলেন, ‘বিদ্যুৎ না থাকায় টাকা দিয়ে দোকানে ফোন চার্জ দিতে হয়। পানি কিনে খেতে হচ্ছে। প্রায় প্রতি রুমের পলেস্তারা খসে পড়ছে। কখন দেওয়াল ধসে পড়ে সেই আতঙ্কে দিন পার হচ্ছে আমাদের। বৃষ্টি হলে অনেক রুমে পানি পড়ে। সারারাত ঘুম হয়না তখন। কেউ দেখে না আমাদের। এখন তো বিদ্যুৎ নেই, রাতেও আলোও নেই। সেই সাথে মশার যন্ত্রণা। এটি হোস্টেল নয়, যেন নরক। আমাদের টাকা নেই। তাই সব সহ্য করে পড়াশোনা শেষ করে যেতে হবে। জানি না আমাদের এ সমস্যার সমাধান কোথায়?’

এ প্রসঙ্গে হোস্টেলটির মেম্বার সেক্রেটারি সুরকৃষ্ণ চাকমা বলেন,‘ আমরা এ ব্যাপারে বিভাগীয় কমিশনার, তিন পার্বত্য জেলার ডিসি এবং চট্টগ্রাম জেলার ডিসির সাথে কথা বলেছি। খাগড়াছড়ি, বান্দরবান এবং চট্টগ্রাম জেলার ডিসি টাকা দেবেন বলে ঘোষণা করেছেন। তবে আমাদের হোস্টেলের কোনো ব্যাংক অ্যাকাউন্ট না থাকায় তারা টাকা পাঠাতে পারছেন না। ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলার জন্য আমরা ইতোমধ্যে সোনালী ব্যাংকের ফরম সংগ্রহ করেছি। ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলামাত্র টাকা পাওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন তারা। আশা করি ২৭ মার্চের আগে আমাদের বিদ্যুৎ লাইনের সংযোগ হবে। প্রাক্তন বিভাগীয় কমিশনার ৯ তলা ভবন তোলার প্রস্তাবনা দিয়ে গেছেন। নতুন বিভাগীয় কমিশনার যোগ দিয়েছেন। আশা করি তিনি আমাদের সমস্যা অনুধাবন করবেন। খরচ সামলাতে না পেরে বর্তমানে অনেক মেধাবী ছাত্র ঝড়ে পড়ছে। আমরা চাই আমাদের ভবনটি দ্রুত সংস্কার হোক। এতে পাহাড়ের গরিব ছাত্ররা পড়াশোনার সুয়োগ পাবেন।’

এ প্রসঙ্গে কথা হয় বিভাগীয় কমিশনার ড. মো. আমিনুর রহমানের সাথে। তিনি বলেন, ‘ওই ছাত্রাবাসের দায়িত্বে যিনি রয়েছেন তিনি গত পরশুদিন (১১ মার্চ) আমার অফিসে এসেছিলেন। সম্ভবত তিনি এ ব্যাপারে আমদের বলেন নি। তিনি ছাত্রবাসের উন্নয়ন প্রসঙ্গে কথা বলেছেন। আমরা এ প্রসঙ্গে অবগত নই। এতদিন ছাত্ররা বিদ্যুৎহীন রয়েছেন; বিষয়টি আমরা জানলে অবশ্যই ব্যবস্থা নিতাম। আমাদের এডিশনালের দায়িত্বে যিনি রয়েছেন তার সাথে যোগাযোগ করতে হবে। অবশ্যই দ্রুত সমস্যার সমাধান হবে।’

নতুন ভবন করা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘ভবন নির্মাণের জন্য ইতিমধ্যে মন্ত্রণালয়ে চিঠি গিয়েছে। এখন অপেক্ষা বাজেট ঘোষণার। বাজেট ঘোষণা না হলে তো নির্মাণ কাজ শুরু করা যাবে না। নতুন ভবন অবশ্যই হবে।’