মানবতার অগ্রযাত্রায় রেড ক্রস রেড ক্রিসেন্ট

ডা. শেখ শফিউল আজম »

আন্তর্জাতিক রেডক্রস কমিটি বা আইসিআরসি হচ্ছে রেডক্রস আন্দোলনের জন্মদাতা সংস্থা। ১৮৬৩ সালে ২৬শে অক্টোবর জেনেভায় অনুষ্ঠিত সম্মেলনে গঠিত রেডক্রসই হচ্ছে আইসিআরসি। সংগঠনের নিরপেক্ষতা বজায় রাখার জন্য আন্তর্জাতিক ভাবে স্বীকৃত নিরপেক্ষ রাষ্ট্র সুইজারল্যান্ডের ২৫ জন নাগরিক নিয়ে এই কমিটি গঠিত। জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী যুদ্ধকালীন সময়ে আইসিআরসি আহত সামরিক/বেসামরিক লোকের সেবা যুদ্ধ ক্ষেত্রে ঝুঁকি নিয়ে আহতদের চিকিৎসা নিরাপত্তার ব্যবস্থা ও ফিল্ড হাসপাতালের ব্যবস্থা করে থাকে। যুদ্ধ পরবর্তী পর্যায়ে যুদ্ধ বন্দীদের তদারকী ও বিনিময়ের ব্যবস্থা করে থাকে। জেনেভা কনভেনশনের সংরক্ষণ ও প্রয়োগ কেবলমাত্র আইসিআরসি সম্পাদন করে থাকে। ১৯৪৯ সালের ২২ শে আগস্ট অনুষ্ঠিত কনভেনশনে পূর্ববর্তী সকল কনভেনশনের বিধিসমূহ চূড়ান্ত করা হয়।
ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অফ রেড ক্রস রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি (আইএফআরসি)বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রেডক্রস ও রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি সমূহের সমন্বয়ে ইন্টারন্যানাল ফেডারেশন অফ রেডক্রস ও রেড ক্রিসন্টে সোসাইটিজ গঠিত। ১৯১৯ সালে ৫ই মে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৩৯ সালে সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় স্থায়ীভাবে এর সদর দপ্তর স্থাপন করা হয়। আইএফআরসি বিশ্বের সকল জাতীয় রেড ক্রস রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি সমূহের মধ্যে বন্যা, ঘুর্ণিঝড় দুর্ভিক্ষ, ভূমিকম্প প্রভৃতি প্রাকৃতিক দুর্যোগে দুঃস্থদের সাহায্যার্থে বহুবিদ সেবামূলক কাজ করে থাকে। ১৯৯১ সালের নভেম্বর মাসের সাধারণ পরিষদের সভায় লীগ অফ রেডক্রস এন্ড রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটিজ এর নাম পরিবর্তন করে ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অফ রেডক্রস এন্ড রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটিজ করা হয়।


নামকরণ ও প্রতীক : আইসিআরসি একটি নিরপেক্ষ সংস্থা হিসাবে পৃথিবীর দেশে দেশে কার্যক্রম পরিচালনার জন্য নিরাপত্তার সুবিধার্থে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত একটি প্রতীকের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। এই প্রয়োজনবোধ থেকেই সহজেই চেনা যায়, এমন একটি প্রতীক নির্ধারণ করা হয়।
এবং তা হল সাদা জমিনের উপর লাল ক্রস চিহ্ন। যা সেবক দল বাহুবন্ধনী হিসেবে ব্যবহার করবে। এই অসাধারণ চিহ্ন কার দ্বারা প্রস্তাবিত তা পরিস্কার নয়। তবে যাই হোক প্রতীকটি সুইস পতাকার অনুরূপ বিপরীত রঙের (অর্থাৎ সাদা জমিনে লাল ক্রস চিহ্ন)। উক্ত সম্মেলনের প্রতিনিধিবৃন্দ আজকের পৃথিবীতে সর্বাধিক পরিচিত একটি প্রতীকই শুধুমাত্র নির্বাচন করেননি বরং যে মাটিতে সম্মেলনটি অনুষ্ঠিত হয়েছে সেই সুইজারল্যান্ডের প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শন করেছেন।
পরবর্তী বছরে অর্থাৎ ১৮৬৪ সালে জেনেভা কনভেনশনে সার্বজনীন প্রতীক হিসেবে কোন প্রকার আপত্তি ছাড়াই সকল দেশ কর্তৃক ‘রেডক্রস’ প্রতীকটিকে স্বীকার করে নেয়া হয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও ১৮৭৬ সালে রাশিয়া ও তুরস্কের সাথে যুদ্ধ শুরু হলে সেখানে কাজের ক্ষেত্রে এটি ব্যাবহার হলে বিভিন্ন মহল থেকে উক্ত প্রতীকটিকে খ্রীস্টান ধর্মের একিট ‘চিহ্ন’ বলে উল্লেখ করতে থাকে। এবং ভিন্ন প্রতীক ব্যবহারের দাবি তুলতে থাকে। তখন তুরস্কের জাতীয় পতাকার অনুরূপ বিপরীত রঙের রেড ক্রিসেন্ট প্রতীক ব্যবহার করেন। অতঃপর ১৯২৯ সালের কুটনৈতিক সম্মেলনে কিছু আপত্তি সত্ত্বেও আরো দুইটি প্রতীককে মেনে নেয়া হয়। সেগুলো হল রেড ক্রিসেন্ট এবং ও রেড লায়ন এন্ড সান। ১৯৪৯ সালের কুটনৈতিক সম্মেলনে প্রতীক দুইটি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ করে। ফলে আন্তর্জাতিক সংস্থা তিনটি প্রতীককে একই লক্ষ্য ও আদর্শ ব্যবহারের অনুমোদন লাভ করে। কিন্তু আবার ১৯৮০ সালে রেড লায়ন এন্ড সান সোসাইটি (ইরান) তাদের প্রতীক পরিবর্তন করে। ফলে বর্তমানে এই সংস্থার প্রতীক তিনটি (১) রেডক্রস (২) রেড ক্রিসেন্ট ও (৩) রেড ক্রিস্টাল ।
১৯১০ সালে হেনরি ডুনান্টের মৃত্যুর পর হতে সারা বিশ্বে ৮ মে তাঁর জন্মদিনকে সম্মান দেখিয়ে ‘বিশ্ব রেডক্রস ও রেড ক্রিসেন্ট দিবস’ হিসেবে পালন করে আসছে। তিনি ছিলেন একজন সমাজসেবক, মানব হিতৈষী ও শ্রেষ্ঠ মানব। সেই জন্যই তিনি পেয়েছিলেন শান্তিতে প্রথম- নোবেল পুরস্কার। তাঁর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে আজ কোটি কোটি মানব সন্তান বিপন্ন মানবতার সেবায় নিয়োজিত। তিনি জাতি ধর্ম নির্বিশেষে পৃথিবীর সকল মানুষকে এক পতাকাতলে একই কর্মসূচিতে একত্রিত করেছিলেন। সাম্য মৈত্রীর বন্ধনে আবদ্ধ করেছিলেন মানব সন্তানদের।
বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি প্রতিষ্ঠা-
১৬ই ডিসেম্বর, ১৯৭১ বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভের পর পাকিস্তান রেডক্রস সোসাইটির পূর্ব পাকিস্তান শাখা বাংলাদেশের জাতীয় রেডক্রস সোসাইটি হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে। ১৯৮৮ সালে ৪ঠা এপ্রিল হতে মহামান্য রাষ্ট্রপতির আদেশ বলে বাংলাদেশ রেডক্রস সোসাইটির নাম পরিবর্তিত হয়ে বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি হয়।
বাংলাদেশের প্রতিটি প্রশাসনিক জেলায় ৬৪টি ও ৪টি সিটি করপোরেশনে ৪টি সর্বমোট ৬৮টি ইউনিট রয়েছে। যার মাধ্যমে বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি সারাদেশ ব্যাপী নানাবিধ আর্ত মানবতার সেবা ও কল্যাণমূলক কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে। বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটিকে রাষ্ট্রপতি গেজেট নোটিফিকেশনের মাধ্যমে সরকারের প্রধান সহযোগী ত্রাণ সংস্থা হিসেবে নিয়োজিত করেছে (পিও ২৬/১৯৭৩)। তাই, দেশের সার্বিক দুর্যোগ মোকাবিলায় এবং আর্তমানবতার সেবায় বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির দায়িত্ব অপরিসীম।
বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি স্বাভাবিক সময়ে ও প্রতিটি দুর্যোগে ৬৮টি ইউনিট এর স্বেচ্ছাসেবক ও কর্মকর্তাদের সহযোগিতায় বিপন্ন মানবতার কল্যাণে সোসাইটির ৫টি বিভাগের আওতাধীন ২৬টি অধিদপ্তরের মাধ্যমে গণ মানুষের সেবায় সর্বদা নিয়োজিত। যুদ্ধক্ষেত্রে আহতদের সেবা ও নিহতদের সৎকার করার উদ্দেশ্যে রেডক্রসের জন্ম হলেও এর সেবা ও কর্ম-পরিধি বর্তমানে ব্যাপক এবং বিস্তৃত । সোসাইটি মূলত সকল প্রকার দুর্যোগে গণ মানুষের মানবিক প্রয়োজনে সাড়া প্রদান করে থাকে।
পরিবর্তন বন্যা, নদী ভাঙ্গন, ঘূর্ণিঝড়, টর্নেডো, জলোচ্ছ্বাস, অগ্নিকান্ড, প্রচ- শীত, ভূমিকম্প, ক্লাইমেইট চেঞ্জ অর্থাৎ সাম্প্রতিক বিশ্বায়নের কারণে আবহাওয়ার বিপর্যয় প্রভৃতি প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে জরুরী ভিত্তিতে উদ্ধার ও প্রাথমিক চিকিৎসা কার্যক্রম, খাদ্য সামগ্রী, ঔষধপত্র, বস্ত্র, অস্থায়ী আশ্রয় সামগ্রী, নগদ অর্থ প্রদান করে থাকে। এমনকি অধিকতর ক্ষতিগ্রস্ত বা বিধ্বস্ত এলাকার গৃহহীনদের জন্য পুনর্বাসন কর্মসূচির আওতায় গৃহ নির্মাণ, চাষাবাদের জন্য বীজ-সার প্রদান ও জীবন-জীবিকার জন্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী প্রদান কার্যক্রম পরিচালনা করে। ১৯৮৮ ও ১৯৯১ সালে সংঘটিত শতাব্দীর প্রলয়ংকারী বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত গণমানুষের সেবায় সোসাইটির ত্রাণ ও স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়েছে।
জাতীয় পর্যায়ে দুর্যোগ মোকাবিলায় সহায়তা প্রদানের জন্য দেশের দুর্যোগ প্রবণ ৩৫টি জেলার অধিক ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় বসবাসকারী অসহায় গণ মানুষের বিপদাপন্ন লাঘবে সোসাইটি ১৯৯৭ সাল হতে ‘সমাজ ভিত্তিক দুর্যোগ মোকাবিলা কর্মসূচির মাধ্যমে গণ মানুষের সেবায় নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। ১৯৭০ সালের প্রলয়ংকারী ঘূর্ণিঝড় ও জলচ্ছ্বাসে বাংলাদেশের সমুদ্র উপকূলবর্তী এলাকায় ব্যাপক জীবনহানি এবং সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি হলে ১৯৭২ সালে তৎকালীন বাংলাদেশ রেড ক্রস সোসাইটি সরকারের সার্বিক সহযোগিতায় ‘ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচি’ (সিপিপি) নামে একটি বিভাগ চালু করে । বাংলাদেশে সমুদ্র উপকূলবর্তী প্রবল ঝুঁকিপূর্ণ ৭১০ কিঃ মিঃ প্রলম্বিত এলাকা জুড়ে বসবাসকারী সর্বাধিক বিপদাপন্নড়ৰ জন গোষ্ঠিকে সম্ভাব্য দুর্যোগ হতে তাঁদের জীবন ও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি হ্রাস করার নিমিত্তে সচেতনতা বৃদ্ধি ও প্রস্তুতি মূলক ব্যবস্থা গ্রহণের উপর ভিত্তি করে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে।এ কর্মসূচির আওতায় ১১টি উপকূলীয় জেলার ৩১ টি উপজেলায় প্রায় ৫০ হাজার প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত স্বেচ্ছাসেবক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সার্বিক সহযোগিতায় উপকূলীয় গণমানুষের মধ্যে রেডিও সেট ও মাইক এর মাধ্যমে ঘূর্ণিঝড়ের আগাম সংকেত প্রদান, সচেতনতা মূলক প্রচার, দুর্যোগ সম্পর্কে ধারণাদান, বিভিন্নতর প্রশিক্ষণ প্রদান, দুর্যোগের পরে অপসারণ, উদ্ধার, প্রাথমিক চিকিৎসা এবং তাৎক্ষণিক ভাবে দুর্যোগে ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণসহ জরুরী ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনা করে। ১৯৯১ সালে সংঘটিত প্রলয়ংকারী ঘূর্ণিঝড়ে সোসাইটির উদ্ধার ও ত্রাণ কার্যক্রম সারা বিশ্বে সেবার অনন্য মডেল হিসাবে আস্থা অর্জন করেছে। উপকূলীয় এলাকায় স্বেচ্ছাসেবক ও কর্মকর্তা-কর্মচারী কর্তৃক জনগণকে নিয়মিত সচেতনতা মূলকপ্রচার ও দুর্যোগ সম্পর্কে ধারণাদানের ফলে বিগত ২০০৭ ও ২০০৮ সালে সংঘটিত প্রলয়ংকারী ঘূর্ণিঝড় ‘সিডর’ ও ‘আইলা’ ১৯৯১ সালের মত জীবন ও সম্পদ এর ক্ষতি হয়নি।
পৃথিবীর সকল দেশের মত বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির স্বাস্থ্য সেবার কর্মসূচীর অধীনে এ দেশের গণ মানুষের সেবায় ১টি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ ৫টি স্বয়ংসম্পূর্ণ অত্যাধুনিক মাতৃসদন হাসপাতাল, ৬৮টি গ্রামীণ মাতৃসদন কেন্দ্র, ৩টি আউটডোর ক্লিনিক, ২টি চক্ষু ক্লিনিক, ৬টি রক্ত কেন্দ্র, ২টি নার্সিং কলেজ, ৩টি ধাত্রী বিদ্যা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, এইচ আইভি / এইডস ও এ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস এর সক্রিয়ভাবে কার্যক্রম পরিচালনা, জরুরি মেডিক্যাল টিমের মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের চিকিৎসা সেবা প্রদান করে থাকে।
আজকের শিশু আগামী দিনের জাতির কর্ণধার। একজন সৎ, যোগ্য ও প্রশিক্ষিত নাগরিক দেশের অমূল্য সম্পদ। স্কুল কলেজে অধ্যায়নরত ছাত্র-ছাত্রী বা যুব শ্রেণীর প্রতিনিধিদের মাধ্যমে সোসাইটির যুব রেড ক্রিসেন্ট কার্যক্রম পরিচালিত হয়। সোসাইটির অধিকাংশ কার্যক্রম স্বেচ্ছাসেবার মাধ্যমে সম্পনড়ব হয়। প্রশিক্ষিত যুব স্বেচ্ছাসেবকগণই প্রতিটি দুর্যোগে গণমানুষের সেবায় আন্তরিক ও নিঃস্বার্থ ভাবে কাজ করে। এছাড়া সোসাইটি পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্মসূচী, ভূমিকম্প প্রস্তুতি ও সাড়া প্রদান কর্মসূচী (ইপিআরপি), রোহিঙ্গা শরণার্থী ত্রাণ কার্যক্রম, প্রশিক্ষণ বিভাগ, অনুসন্ধান ও পারিবারিক যোগাযোগ পুনঃস্থাপন বিভাগের মাধ্যমে গণ মানুষের সেবায় নিয়োজিত আছে। বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটিকে সরকার প্রধান সহযোগী ত্রাণ সংস্থা হিসেবে নিয়োজিত করেছে। সেহেতু, দেশের সার্বিক দুর্যোগ মোকাবিলায় এবং আতৃ মানবতার সেবায় বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির দায়িত্ব রয়েছে। বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি দেশের আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি জাতীয় সদর দপ্তর সরাসরি এবং ইউনিটের মাধ্যমে বিপন্ন মানবতার সেবায় বিভিন্নমুখী কল্যাণমূলক কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। যেমনঃ দুর্যোগ-ত্রাণ ও পুনবার্সন কার্যক্রম, ঘুর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচী (সিপিপি), সিসিএ, ভিটুআর, স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম, অনুসন্ধান, সমাজ ভিত্তিক দুর্যোগ মোকাবেলা ব্যবস্থাপনা কর্মসূচি (সিবিডিএম), ওডি, যুব ও স্বেচ্ছাসেবক কার্যক্রম, রক্তদান কর্মসূচি, প্রশিক্ষণ কার্যক্রম, সিইপি, রেড ক্রিসেন্ট নীতিমালা ও আন্তর্জাতিক মানবিক আইনের প্রচার এবং প্রসার, ভূমিকম্প প্রস্তুতি ও সাড়া প্রদান কর্মসূচি (ইউডিআর) প্রভৃতি।
পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ শরণার্থী আশ্রয়স্থল কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে প্রায় ১১ লাখ শরণার্থীর বাস। ২০১৭ সালের আগস্ট মাসে সহিংসতার শিকার হয়ে প্রায় সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গা মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে এ দেশে প্রবেশ করে। বাংলাদেশ সরকারের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রনালয় তথা শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের কার্যালয় হতে নির্দেশিত সকল কার্যক্রমেই রেড ক্রিসেন্টের সরব উপস্থিতি রয়েছে। কক্সবাজারে শুধু শরণার্থী ও তাদের আগমনে ক্ষতিগ্রস্ত জনগণের জন্য পরিচালিত হচ্ছে রেড ক্রিসেন্টের দুটি সহায়তা প্রকল্প। এর মধ্যে মিয়ানমার রিফিউজি রিলিফ অপারেশন (এমআরআরও) শুরু হয় ১৯৯১ সালে এবং পপুলেশন মূভমেন্ট অপারেশন (পিএমও) শুরু হয় ২০১৭ সালে। এই দুটি অপারেশন এর মাধ্যমে রেড ক্রিসেন্ট ৩৪টি ক্যাম্প এবং রামু, উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলার ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠীর জন্য ত্রাণ (খাদ্য ও নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী), নগদ অর্থ, এলপিজি, স্বাস্থ্য -সুরক্ষা সামগ্রী, ওয়াশ সামগ্রী নিয়মিত বিতরণ করছে। এছাড়া প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে পরিচালনা করছে একটি পুরনাঙ্গ ফিল্ড হাসপাতালসহ ১২টি স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র।
বর্তমানে কোভিড-১৯ মোকাবেলায় রেড ক্রিসেন্ট তৈরি করেছে আইসোলেশন ও ট্রিটমেন্ট সেন্টার। পাশাপাশি ক্যাম্প ও উখিয়া- টেকনাফের বিভিন্ন এলাকায় রেড ক্রিসেন্ট কর্মী ও স্বেচ্ছাসেবীরা করোনাভাইরাস সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধিতেও কাজ করছে। কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার বালুখালী আশ্রয়শিবিরে ভয়াবহ অগ্নিকা-ে ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে উদ্ধার ও ত্রাণ কার্যক্রম শুরু করে বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি। কক্সবাজারের শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের কার্যালয়ের সঙ্গে সমন্বয় করে রেড ক্রিসেন্ট শুকনা খাবারসহ এক হাজার তাঁবু, মশারি ও কম্বল বিতরণ করে। কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩টি রোহিঙ্গা শিবিরে জরুরি সাড়াদানে প্রস্তুত রাখা হয় বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির ৩ হাজার ৩০০ প্রশিক্ষিত স্বেচ্ছাসেবক। ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব রেডক্রস অ্যান্ড রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটিজের (আইএফআরসি) সহযোগিতায় প্রশিক্ষিত এই স্বেচ্ছাসেবকেরা শিবিরের বাসিন্দাদের দুর্যোগপ্রস্তুতি প্রশিক্ষণের পাশাপাশি দুর্যোগ মোকাবিলায় সচেতনতা বৃদ্ধিতে কাজ করে।
কোভিড-১৯ মহামারির বিশ্বজুড়ে ক্রমবিস্তার মানুষকে অসহায়ত্বের দিকে ঠেলে দেয়। এই ১৫ মাসে সারা বিশ্বে ছত্রিশ লক্ষ মানুষ করোনার ছোবলে বেঘোরে প্রাণ হারিয়েছে। বিশ্বে আক্রান্ত হয়েছে প্রায় পঁয়ত্রিশ কোটির বেশি মানুষ। তবে আশার কথা যে, নানা দুর্যোগের শিকার বিপন্ন অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে রেড ক্রস, রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি। বিশ্বজুড়ে মানবিক সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে এ সোসাইটি। বর্তমান বিশ্ব মহামারী করোনায় বিপন্ন অসহায় মানুষের জন্য বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সেস্যাইটি শুরু থেকেই এন কার্যক্রম নিয়ে অসহায় মানুষের পাশে দাড়িয়েছে। পবিত্র রমজানে ইফতার ও সেহেরীর খাদ্য সহায়তা যুব রেড ক্রিসেন্ট সেচ্ছাসেবকদের মাধ্যমে দরীদ্র মানুষের ঘরে ঘরে পৌছে দেওয়া হচ্ছে। কক্সবাজারের স্থানীয় বাসিন্দাদের পাশাপাশি মিয়ানমার থেকে আগত নাগরিকদের জন্য কোভিড-১৯-এর টিকাপ্রদান কর্মসূচিতে সহায়তা করেছে বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি।
বিশ্ব রেড ক্রস রেড ক্রিসেন্ট দিবস-২০২৩ এর এই দিনে বাংলাদেশের আপামর জন সাধারণের প্রতি আকুল আবেদন বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি কর্তৃক পরিচালিত বিভিন্ন মানবিক কার্যক্রমে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিন, আর্ত মানবতার সেবায় এগিয়ে আসুন।

• ম্যানেজিং বোর্ড মেম্বার, বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি। • ভাইস চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি, চট্টগ্রাম জেলা ইউনিট।