মাতারবাড়ি বন্দর : শেষের পথে চ্যানেল নির্মাণ

কৃত্রিম চ্যানেলে চলছে জেটি নির্মাণের কাজ – সুপ্রভাত

# পরামর্শক হিসেবে নিয়োগ পেল জাপানি প্রতিষ্ঠান নিপ্পন#
# আগামী ১০ মাসের স্টাডিতে চূড়ান্ত হবে প্রকল্পের ডিজাইন #
# পণ্য পরিবহনে বিকল্প রুট হিসেবে জলপথে ফিডার রোডও থাকছে#

ভূঁইয়া নজরুল:
৩৫০ মিটার চওড়া ও ১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ চ্যানেল নির্মাণের কাজ শেষ হচ্ছে মহেশখালীর মাতারবাড়িতে। আর এই চ্যানেল শেষ হলেই কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য জাহাজ ভেড়ানোর কাজ শুরু হবে।
একইসাথে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের অধীনে বাস্তবায়ন হতে যাওয়া মাতারবাড়ি বন্দরের জন্য চলছে জেটি নির্মাণের কাজও। এই জেটিতে ২০২৫ সালে ভিড়বে কনটেইনারবাহী জাহাজ।
এদিকে মাতারবাড়ি বন্দর উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য ডিজাইন, কনস্ট্রাকশন সুপারভিশন ও টেন্ডার এসিসটেন্স কার্যক্রম করতে জাপানি প্রতিষ্ঠান নিপ্পন কোয়ী কোম্পানি লিমিটেডকে সরকারের ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রণালয়ের কমিটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে। গত বুধবার এই অনুমোদন দেয়া হয়।
প্রকল্পের অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সদস্য (প্রশাসন ও পরিকল্পনা) জাফর আলম বলেন, ‘ভূমি অধিগ্রহনের কাজ শুরু হয়ে গেছে, শিগগিরই হয়তো আমরা ভূমি অধিগ্রহন প্রক্রিয়া শেষ করতে পারবো। ইতিমধ্যে পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের বিষয়টি চূড়ান্ত হয়ে যাওয়ায় এখন প্রকল্পের ডিজাইনও হয়ে যাবে। আর তা করতে হয়তো ১০ মাস সময় লাগতে পারে।’
তিনি আরো বলেন, পরামর্শক এই প্রতিষ্ঠানটি শুধু ডিজাইন করেই দায়িত্ব শেষ করবে না। প্রকল্পটি যথাযথভাবে বাস্তবায়ন হচ্ছে কিনা এবং প্রকল্প শেষ হওয়ার পর আরো একবছর তা মনিটরও করবে। একইসাথে ডিজাইনগত কোনো সমস্যা হলে তা সমাধানও করবে।
প্রকল্পের মেয়াদ বিষয়ে জাফর আলম বলেন, একনেক থেকে অনুমোদিত সময় অনুযায়ী জানুয়ারি ২০২০ থেকে ডিসেম্বর ২০২৬ এর মধ্যে এর কাজ শেষ হওয়ার কথা। তবে আমরা টার্গেট করছি ২০২৫ সালে প্রকল্পের কাজ শেষ করতে।
ইতিমধ্যে প্রকল্প এলাকায় চ্যানেল নির্মাণের কাজ করছে মাতারবাড়ি কয়লা বিদ্যুৎ উন্নয়ন প্রকল্প। এই প্রকল্পের অধীনে পণ্যবাহী জাহাজ আসার কথা রয়েছে। আর সেই জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরের অধীনেই প্রবেশ করবে। তাই চ্যানেলের চ্যানেলের অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, গত ২৯ জুন আমি প্রকল্প এলাকা ঘুরে এসেছি, চ্যানেলে জেটি নির্মাণের কাজ চলছে। পুরো চ্যানেলের কাজ প্রায় শেষ। এছাড়া কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্পের আওতায় নির্মিত চ্যানেলটি বন্দরের অধীনেই পরিচালিত হবে। গভীর সমুদ্র থেকে টাগবোটের মাধ্যমে জাহাজগুলোকে জেটিতে ভেড়ানো হবে। এজন্য শিগগিরই আমরা টাগবোট কিনবো।
মাতারবাড়ি যে গতিতে এগুচ্ছে তাতে হয়তো বন্দর প্রস্তুত হয়ে গেলেও এর সাথে যাতায়াত নেটওয়ার্কের জন্য সড়কপথ যথাসময়ে শেষ নাও হতে পারে। এমন আশঙ্কা বিষয়ে জাফর আলম বলেন, এজন্য আমরা মাতারবাড়ির সাথে চট্টগ্রাম বন্দর, পায়রা ও মোংলা বন্দরের সাথে ফিডার জাহাজ রুট রাখবো। যাতে করে পণ্য সহজে ফিডার জাহাজে করে অন্যান্য বন্দরে নেয়া যায় । এতে সড়ক নেটওয়ার্ক পিছিয়ে থাকলেও দ্রুত পণ্য পরিবাহিত করা যাবে।
ফিডার সার্ভিস প্রসঙ্গে তিনি আরো বলেন, ‘চীন বা সিঙ্গাপুর থেকে সহজে বড় জাহাজ দিয়ে মাতারবাড়িতে নিয়ে আসা যাবে। ফলে চট্টগ্রাম বন্দরের সাথে কলম্বোর যে ফিডার সার্ভিস তা অনেকাংশে কমে আসতে পারে।’
ফিডার সার্ভিস চালু করা প্রসঙ্গে বাংলাদেশ শিপিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের পরিচালক ও পিআইএল শিপিং লাইনের মহাব্যবস্থাপক আবদুল্লাহ জহির বলেন, ‘মাতারবাড়ির সাথে কনটেইনার ফিডার রোড সুফল হওয়ার সম্ভাবনা কম, তবে বাল্ক পণ্য (যেসব পণ্য খোলা আসে) যেমন- পাথর, ক্লিংকার, স্ক্র্যাপ লোহা প্রচুর পরিমাণে আমদানি হয়ে থাকে। এসব পণ্য মাতারবাড়ি থেকে লাইটার জাহাজে (বড় জাহাজ থেকে পণ্য আনা নেয়ার জন্য ছোটো জাহাজ) করে আমদানিকারকরা নিয়ে আসতে পারে। এতে আমদানিকারকদের অনেক সাশ্রয়ও হবে।
ব্যবসায়ীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, মাতারবাড়ি বন্দর বাল্ক পণ্য হিসেবে খুবই উপযোগী হবে। এই বন্দরকে কেন্দ্র করে ইতিমধ্যে মহেশখালী ও কুতুবদিয়ায় দেশি বিদেশী অনেক কোম্পানি বিনিয়োগ করছে। এলপিজি গ্যাস ছাড়াও এলএনজি প্ল্যান্টও গড়ে উঠছে এই এলাকায়। এছাড়া মাতারবাড়িতে বাল্ক পণ্য বেশি এলে চট্টগ্রাম বন্দরের জিসিবি বার্থের জেটিগুলোকে কনটেইনার পরিবহনের জন্য উঠা-নামা করানো যাবে।
বঙ্গোপসাগর থেকে মাতারবাড়িতে নির্মিত কৃত্রিম চ্যানেল (উভয় পাশে মাটি মাঝখান দিয়ে জাহাজ চলাচল করবে) দিয়ে জাহাজ জেটিতে ভিড়তে ১৪ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য পাড়ি দিতে হবে। ৩৫০ মিটার চওড়া এই চ্যানেলটিতে ১৮ মিটার ড্রাফটের ৩৬৬ মিটার দীর্ঘ জাহাজগুলো ভিড়তে পারবে এবং জেটি এলাকায় ঘুরতেও পারবে।
চট্টগ্রাম বন্দরে ৯ মিটার ড্রাফটের এবং বে টার্মিনালে ১২ মিটার ড্রাফটের জাহাজ ভিড়তে পারবে। চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজ ভেড়াতে জোয়ার ভাটার উপর নির্ভর করলেও মাতারবাড়িতে সেই সমস্যা নেই।
১২ মিটার ড্রাফটের বেশি কোনো জাহাজ ভিড়লে তাকে গভীর সমুদ্র বন্দর বলা হয়। সেই হিসেবে মাতারবাড়িতে ১৬ মিটার ড্রাফটের জাহাজ ভিড়তে পারবে। আর এর মাধ্যমে বাংলাদেশ গভীর সমুদ্র বন্দরের সুবিধা পাবে। প্যানামেক্স (১৩ থেকে ১৪ হাজার কনটেইনার পরিবহন করা জাহাজ) আকারের বড় জাহাজগুলো এখানে ভিড়তে পারবে, বিপরীতে চট্টগ্রাম বন্দরে ২২০০ থেকে ২৩০০ কনটেইনার নিয়ে জাহাজ ভিড়ে থাকে।
উল্লেখ্য, জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সির (জাইকা) অর্থায়নে প্রায় ১৮ হাজার কোটি টাকায় বাস্তবায়ন হতে যাওয়া মাতারবাড়ি বন্দর ২০২৫ সালে অপারেশনে আসতে পারে এবং ২০২৪ সালে উৎপাদনে আসবে কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প। চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে দেশের আমদানি রপ্তানির ৯২ শতাংশ পণ্য পরিবাহিত হয়। কিন্তু দেশের অর্থনীতির যে প্রবৃদ্ধি তাতে বিকল্প বন্দরের প্রয়োজন রয়েছে। ইতিমধ্যে ভারতের পণ্যের ট্রান্সশিপমেন্টের প্রথম চালান চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে ত্রিপুরা ও আসামে গিয়েছে। পরীক্ষামূলকভাবে এই সার্ভিস চালু হলেও তা লাভবান হলে ভারত এই রুট ব্যবহার করতে পারে। এতে কলকাতা থেকে চট্টগ্রাম বন্দর এবং চট্টগ্রাম থেকে সড়কপথে আখাউড়া হয়ে ত্রিপুরায় পণ্য যেতে পারবে। তাই মাতারবাড়ি ও বে টার্মিনালের বিকল্প নেই চট্টগ্রাম বন্দরের জন্য।