বাস থেকে ফেলে যাত্রী হত্যা : সড়কে নৈরাজ্য ও নিষ্ঠুরতার চিত্র

সুভাষ দে »

মাত্র এক টাকার ভাড়া নিয়ে কথাকাটাকাটির জের ধরে এক বাস যাত্রীকে মারপিট ও লাথি মেরে ফেলে দিয়েছে বাসের চালক ও সহকারী। জসীম উদ্দিন নামের ঐ যাত্রী মাথায় গুরুতর আঘাত পান। কয়েক ঘণ্টা পর তিনি হাসপাতালে মারা যান। এই ঘটনা মর্মান্তিক, নৃশংস। পত্র-পত্রিকায় নিহত যাত্রীর স্বজনদের আহাজারির ছবি এসেছে। পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে এ রকম অচিন্তনীয়ভাবে হারিয়ে স্বজনদের হাহাকার ও ভবিষ্যতের হতাশা কেবল তাদের আচ্ছন্ন করে রাখবে চিরকাল, রাষ্ট্র-প্রশাসন, বাস মালিক বা শ্রমিক সংগঠনে কোন আঁচড়ই পড়বে না। প্রতিদিন সড়কে যেভাবে ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটছে, মারা যাচ্ছে মানুষ, কত পরিবারে শোকের মাতম উঠছে তার খবর কে রাখে? কেবল যাত্রী কল্যাণ সংস্থা কিছুদিন পরপর সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা, নিহত ও আহতদের খবর জানায়। বিশেষজ্ঞদের নানা সুপারিশ কিংবা সড়ক দুর্ঘটনা হ্রাস করতে আদালতের পর্যবেক্ষণ ও নির্দেশনা উপেক্ষিত থাকছে। সড়কে দুর্ঘটনা এমন পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে যে সন্তানদের স্কুল-কলেজে পাঠিয়ে মা বাবা, উৎকণ্ঠায় থাকেন তাদের ফেরার প্রতীক্ষায়। অনেক সময় অনেক পরিবারের নির্ভরতার আকাশ ভেঙে পড়ে। সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ব্যক্তিদের অধিকাংশই তরুণ, শিক্ষার্থী, শিক্ষক, সরকারি কর্মকর্তা, কর্মচারী ও পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। এসব করুণ-মৃত্যু সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি।
পরিবহন খাতে নৈরাজ্যের চিত্র নিত্যসময়ের। ফিটনেসবিহীন গাড়ি রাস্তায় নামিয়ে দেয়া, যত্রতত্র পার্কিং, চালকের অদক্ষতা, উদাসীনতা, মাদকাসক্তির কারণে দুর্ঘটনা, ওভারটেকিং, রং সাইডে গাড়ি চালনা, এসব বিষয় সড়ক দুর্ঘটনার প্রধান কারণ। এর সাথে আছে যাত্রীদের সাথে দুর্ব্যবহার, ভাড়া নিয়ে কথাকাটাকাটি হরহামেশা, শিষ্টাচারের প্রচ- ঘাটতি, নারী যাত্রীদের সাথে অশালীন ও অনৈতিক আচরণ প্রভৃতি।
পত্রÑপত্রিকার খবরে জানা যায়, জসীমউদ্দিন নামের এক যাত্রী ২৫ সেপ্টেম্বর শুক্রবার আগ্রাবাদ থেকে জিইসির মোড়ে নামার সময় সহকারীর হাতে ১২টাকা দেন যাতে তিনি ৫ টাকা ফেরত পেতে পারেন। আগ্রাবাদ থেকে জিইসির ভাড়া ৭টাকা। সহকারী তাকে ৫টাকার পরিবর্তে ৪ টাকা দেন, এ নিয়ে কথাকাটাকাটির এক পর্যায়ে চালক ও সহকারী দুজনে মিলে তাকে বাস থেকে লাথি মেরে ফেলে দেন। এ ধরণের নিষ্ঠুরতা মানুষের পক্ষে করা কি সম্ভব! এরা মানুষরূপী পশু। পুলিশ বাস চালক ও সহকারীকে গ্রেফতার করেছে এবং তারা জিজ্ঞাসাবাদে যাত্রীকে ফেলে দেওয়ার কথা স্বীকার করেছে। তাদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করা হয়েছে বলে জানা গেছে। আমরা চাই, অপরাধীরা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি পাবে। ২০১৮ সালে চট্টগ্রাম মহানগরের সিটি গেট এলাকায় গ্ল্যাক্সো কার্যালয়ের সামনে এক যাত্রীকে বাস থেকে ফেলে দিয়ে হত্যা করা হয়েছিল। এই ঘটনার কয়েক মাস আগে মুন্সিগঞ্জের গজারিয়ায় সাইদুল রহমান নামের এক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীকে বাস থেকে নদীতে ফেলে হত্যা করেছে পরিবহন কর্মীরা। পত্রিকান্তরে প্রকাশ, এর কোনোটিরই বিচার হয়নি।
রং সাইডে গাড়ি চালিয়ে পথচারী কিংবা বাস থেকে নামা যাত্রীদের নিহত হওয়ার ঘটনাও আছে। নারী যাত্রীদের ওপর যৌন নির্যাতন, ধর্ষণের ঘটনা এবং ধর্ষণের পর বাস থেকে ফেলে দিয়ে হত্যার ঘটনাও আছে। এ প্রসঙ্গে রূপা হত্যার ঘটনা উল্লেখ করা যেতে পারে। এ সকল ঘটনা প্রমাণ করে পরিবহনখাতে কত নৈরাজ্যকর অবস্থা চলছে। যাত্রীরা বাস মালিক ও চালকের হাতে অনেকটা জিম্মি হয়ে আছে। বর্তমান করোনার সময়ও স্বাস্থ্যবিধি না মেনে গাদাগাদি করে যাত্রী নেওয়া হচ্ছে। সরকার নির্ধারিত ভাড়া বাসে টানিয়ে দেয়ার কথা থাকলেও কোনো বাসে তা নেই। যাদের এসব দেখার কথা, বিধিবিধান প্রতিপালন করার কথা তারা তা করেন না। তারাও ম্যানেজ হয়ে যান। এমন কি হাইকোর্টের নির্দেশাবলী প্রতিপালনে সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থাগুলি গরজ অনুভব করছে না।
২ বছর আগে ঢাকায় বাস চাপায় দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যুর পর সড়ক পরিবহন আইন সংসদে পাশ হলেও এখনো পর্যন্ত তার প্রয়োগ হয়নি। জানা গেছে, এ ব্যাপারে যানবাহন মালিক ও শ্রমিক সংগঠনের চাপে কিছু সুপারিশ প্রণয়নে কমিটি করা হলেও কমিটির কাজ কিংবা সুপারিশ সম্পর্কে জনগণ অবহিত নয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুর্ঘটনা কমাতে কিছু নির্দেশাবলিও দিয়েছিলেন অনেক আগে। সে সব সুপারিশ ও বাস্তবায়ন করা হয়নি। সড়ক দুর্ঘটনা হ্রাসের দায়িত্ব যে সব সংস্থার ওপর যথা-সড়ক ও জনপথ অধিদফতর, বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) আইনশৃঙ্খলাবাহিনী, ট্রাফিক বিভাগ এবং সড়ক ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকা সড়ক ও সেতু মন্ত্রণালয়সহ অন্যান্য সংস্থা, সে সব সংস্থার যথাযথ দায়িত্ব পালন ও মাঠ পর্যায়ে কোন তদারকি নেই। সড়ক নির্মাণে আমাদের দেশে বিশ্বের সর্বাপেক্ষা উচ্চ ব্যয় হলেও তার স্থায়িত্ব খুবই স্বল্পকালের সেই সাথে রয়েছে অপূর্ণাঙ্গ নকশা।
প্রকল্প গ্রহণের সময় উপযোগিতা, জনস্বার্থ কিংবা সকল প্রকার যানবাহন চলাচলের, পথচারীদের নির্বিঘেœ হাঁটবার কিংবা রাস্তা পারাপারের ব্যবস্থা রাখা হয় না। অন্যদিকে প্রয়োজন ও আবশ্যকতা না থাকলেও দলীয় ও রাজনৈতিক স্বার্থে এবং জনপ্রতিনিধিদের ইচ্ছানুসারে সড়ক-সেতু নির্মাণ প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। এমনও দেখা গেছে সেতু নির্মাণ করা হয়েছে কিন্তু দুপাশের অ্যাপ্রোচ রোড বছরের পর বছর নির্মাণ করা হয়নি। উপজেলা কিংবা গ্রামাঞ্চলে এ নিয়ে বিভিন্ন সংস্থা একে অপরের ওপর দায় চাপায়।
সম্প্রতি মন্ত্রিসভার বৈঠকে অনাবশ্যক ও অপ্রয়োজনীয় সড়ক নির্মাণ পরিহারের কথা বলা হয়েছে। জেলা সড়ক ও মহাসড়কগুলিতে ছোট যানবাহন চলাচলের পৃথক লেন নেই, জনসাধারণের হাঁটার ফুটপাত রাখা হয়নি। শিক্ষার্থী এবং জনসাধারণের রাস্তা পারাপারের সমস্যা প্রকট, এতে দুর্ঘটনাও ঘটে। আমাদের দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় শিক্ষার্থী ও পথচারীর মৃত্যু বেড়ে চলেছে। গত ১ সেপ্টেম্বর মাসে সারাদেশে ২৭৩টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৩০৪ জনের প্রাণহানি হয়েছে। আহত ৪৯২ জন রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের মাসিক তথ্য প্রতিবেদনে বলা হয় মোটর সাইকেল দুর্ঘটনায় প্রাণহানি বেশি ঘটেছে। এতে নিহত ১০৬ জন। এছাড়া ৮৬ জন পথচারী, ৫৪ জন চালক ও হেলপার, ৫৭ জন নারী ও ৩৮ জন শিশু। প্রতিদিন ঐ মাসে গড়ে ১০ জন সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান।
বিশেষজ্ঞরা রেলপথ, নৌপথ সম্প্রসারণের ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন যাতে সড়কের ওপর চাপ কমে, দুর্ঘটনা হ্রাস পায়। তারা নগরে সাইকেলের জন্য পৃথক লেন করে দেবার কথাও বলেছেন। জনসাধারণকে হাঁটার অভ্যাস করতে হবে। তাদের জন্য তৈরি ফুটপাত দখলমুক্ত করে দিতে হবে।
সড়ক দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধান ও ভবিষ্যতে দুর্ঘটনা এড়ানোর জন্য কোনোরূপ তদন্ত কমিটিও হয় না, আইনের প্রয়োগ না হওয়ায় মামলা করতেও জটিলতা হয়। অর্থের অভাবে নিহত কিংবা আহতের পরিবার মামলায় যেতে পারে না। এদের আইনি সহায়তা দেবার কোন সংস্থাও নেই। ফলে নিহত ও আহতদের পরিবার কোন ক্ষতিপূরণ পায় না। সম্প্রতি হাইকোর্ট দুর্ঘটনায় পা হারানো রাসেল সরকারকে ২০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেয়ার খবর পত্রিকায় এসেছে। আদালতের ক্ষতিপূরণ প্রদানের নির্দেশনা ভুক্তভোগী পরিবারদের জন্য ভরসা নিয়ে এসেছে। প্রচলিত আইনেও এর বিচার এবং প্রতিকার পাওয়া সম্ভব।
পরিবহনখাতে মালিক এবং শ্রমিক সংগঠনের নেতাদের অনেকেই ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের সদস্য, সরকারের আইন, বিধিবিধান প্রতিপালন, কর্মসূচি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে এসব সংগঠন বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বরং দেখা যাচ্ছে, যাত্রীসাধারণকে জিম্মি করে তারা অতীতে ধর্মঘট, সড়কে নৈরাজ্য সৃষ্টি করে দাবি আদায়ের কঠোর পন্থা নিয়েছে। শ্রমিক সংগঠন শ্রমিকের স্বার্থে তাদের চাকরির স্থায়িত্ব, মজুরি ও কাজের ঘণ্টা নির্ধারণ, শিষ্টাচার প্রশিক্ষণ, সড়কের বিধিবিধান অনুসরণে উদ্বুব্ধকরণ, যাত্রীদের সাথে মানবিক ব্যবহার, এসব বিষয়গুলি নিয়ে আন্দোলন-সংগ্রাম করে না। এর অন্যতম কারণ বেশকিছু শ্রমিক নেতা আবার পরিবহনের মালিক।
আমরা চাই সড়ক পরিবহন আইন অবিলম্বে কার্যকর করার পদক্ষেপ নেওয়া হোক। এটিকে আর হিমাগারে রেখে দেওয়া উচিত নয়। প্রতিদিন সড়কে মানুষ মারা যাচ্ছে। দুর্ঘটনার সংবাদ বেড়ে চলেছে, অথচ কারো শাস্তি হচ্ছে না। এ ধরণের নৈরাজ্য, অপকর্ম ও মৃত্যুর দায় কেউ নিচ্ছে না। পরিবারের নির্ভরতার প্রতীক সদস্য সড়কে প্রাণ হারাচ্ছে। শিক্ষার্থী, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মানুষ প্রতিনিয়ত লাশ হয়ে ফিরছে। স্বজনদের বুকফাটা কান্না সমাজ ও রাষ্ট্রের শক্তিকে নৈতিকভাবে দুর্বল করে দিচ্ছে।
লেখক : সাংবাদিক