বাঁশখালীতে পুড়িয়ে ১১ হত্যার সাক্ষ্য শেষ হয়নি ১৮ বছরেও

ফাইল ছবি

নিজস্ব প্রতিনিধি, বাঁশখালী »

দেশ-বিদেশে আলোচিত বাঁশখালীর সাধনপুর গ্রামের শীলপাড়ায় ১১ জনকে পুড়িয়ে হত্যার ১৮ বছর পূর্ণ হলেও মামলার সাক্ষ্য কাজও সম্পন্ন করা যায়নি। মামলার ৩৯ আসামির ৩৭ জনই জামিনে ও পলাতক থেকে বাদি ও সাক্ষীদের হুমকি দিচ্ছে অবিরত। মামলার বাদি পল্লী চিকিৎসক বিমল শীল পল্লী ছেড়ে ভয়ে ঘটনাস্থল থেকে ৫৫ কিলোমিটার দূরে চট্টগ্রাম শহরে থাকছেন নানা আর্থিক সংকটে।

২০০৩ সালে ১৮ নভেম্বর ঘটনার পর সাধনপুর শীল পাড়ায় পুলিশ ক্যাম্প স্থাপন হলেও চলতি বছরের শুরুতে জানুয়ারি মাসে ওই পুলিশ ক্যাম্পটিও অজ্ঞাতকারণে কর্তৃপক্ষ উঠিয়ে নিয়েছে। ফলে নারীপুরুষ সবাই প্রতিনিয়ত আতংকে দিনাতিপাত করছে।

এমন কী, ২০১৮ সালের ২৩ জুন হাইকোট উক্ত চাঞ্চল্যকর মামলা  দ্রুত নিস্পত্তির জন্য চট্টগ্রাম জজ আদালতকে নির্দেশ দিলেও পলাতক ও জামিনে থাকা আসামিরা কৌশলে মামলার বিচার কাজ বিলম্ব ঘটাচ্ছে। মামলার বাদি বিমল শীল আদালতে ঘুরে ঘুরে দিশেহারা হয়ে পড়েছে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, পুড়িয়ে হত্যার ঘটনার পর পর ওই সময় এলাকাবাসীর মুখে মুখে চাওড় হয় এবং বাদিপক্ষের অভিযোগ ওঠে মূল হত্যাকারী কালীপুর ইউনিয়ন পরিষদের তৎকালীন চেয়ারম্যান ও উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আমিনুর রহমান চৌধুরী। কিন্তু ওই সময় তাঁর চাচাতো ভাই জাফরুল ইসলাম চৌধুরী বাঁশখালীর এমপি এবং তৎকালীন সরকারের বন ও পরিবেশ প্রতিমন্ত্রী ছিলেন। এ কারণে বাদি বিমল শীল এজাহারে আমিনুর রহমান চৌধুরীকে আসামি দিলেও পুলিশ চার্জশীটে আমিনুর রহমান র্চৌধুরীর নাম বাদ দেন। এভাবে বাদির চার্জশিটে নারাজি এবং পুলিশের মূলহোতা বাদ দিয়ে ৩য় বার পর্যন্ত চার্জশীট প্রদানের ঘটনা ঘটে। পরে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসলে অধিকতর তদন্তে সিআইডি সর্বশেষ চতুর্থ দফায় ২০১১ সালের ৯ জানুয়ারি আমিনুর রহমান চৌধুরীসহ ৩৯ জনকে আসামি করে অভিযোগপত্র দেয়। এর কিছুদিন পর আদালত চার্জশিট গ্রহণ করলে আমিনুর রহমান চৌধুরী গ্রেফতার হন। তিনি জামিনে এসে হাইকোর্টে রিট করে মামলা স্থগিত করে দেন। এভাবে অন্তত ৩ বছর মামলার গতিপ্রকৃতি স্তব্ধ হয়ে যায়।

পরে বাদি পক্ষ হাইকোর্টে নানাভাবে শুনানিতে অংশ নিলে হাইকোর্ট ২০১৮ সালে ২৩ জুন আসামি আমিনুর রহমান চৌধুরীর রিটাদেশ বাতিল করে চট্টগ্রাম জজ আদালতকে মামলাটি দ্রুত নিস্পত্তির আদেশ দেন। এই আদেশও যাতে দ্রুত কার্যকর না হয় সেজন্য বাদি ও সাক্ষীকে আসামিরা জামিনে ও পলাতক থেকে প্রকাশ্যে হুমকি ধমকি দিচ্ছে।

আদালত সূত্রে জানা গেছে, চট্টগ্রামের তৃতীয় অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ ফেরদৌস ওয়াহিদের আদালতে মামলাটির বিচার কাজ চলছে। বাদি বিমল শীলের মামলায় আলোচিত চেয়ারম্যান ও বিএনপি নেতা আমিনুর রহমান চৌধুরীসহ ৩৯ জন আসামি। এসব আসামির মধ্যে ১৯ জন আসামি পলাতক,  ১৮ জন আসামি জামিনে এবং ২ জন কারাগারে আছেন। মামলার ৫৭ জন সাক্ষীর মধ্যে মাত্র ২২ জন সাক্ষ্য দিয়েছেন। আবার সাক্ষীর তারিখ ধার্য করা হয়েছে ২০২২ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি।

এ বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষের দায়িত্ব পালনকারী ভারপ্রাপ্ত জেলা পিপি অ্যাডভোকেট লোকমান হোসেন বলেন, মামলাটিতে ৫৭ জন সাক্ষীর মধ্যে মাত্র ২২ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ সম্পন্ন হয়েছে আদালতে। আগামী বছরের ২২ ফেব্রুয়ারি মামলার পরবর্তী তারিখ ধার্য করা হয়েছে। সাক্ষীদের সাক্ষ্য কাজ সম্পন্ন না হলে মামলাটি বিচারকার্য শেষ করতে আরও সময় লাগবে।

মামলার সাক্ষী দেলোয়ার হোসেন ও হোসনে আরা বলেন, আসামিদের হুমকি-ধমকিতে নানা আতংকে আছি। ওই মামলায় সাক্ষী হবার পর থেকে আমাদের নানাভাবে যে ক্ষতি হয়েছে তা কাউকে বুঝাতে পারছি না।

ঘটনার নৃশংসতা: ২০০৩ সালের ১৮ নভেম্বর মধ্যরাত বাঁশখালীর সাধনপুর ইউনিয়নের শীলপাড়ায় খুনিরা প্রবেশ করে। বিশাল দো-তলা মাটির তৈরী বাড়ির চারিদিকের অন্তত ৮টি দরজার বাইর থেকে বন্ধ করে দেয়া হয়। গান পাউডার ছিঁটিয়ে আগুন লাগিয়ে উল্লাস করে। ওই দৃশ্য দেখে মামলার বাদি বিমল শীল দো-তলার জানালা ভেঙে কৌশলে লাফ দিয়ে প্রাণে বাঁচেন। খুনিরা পালিয়ে গেলে ভোররাতে নিস্তব্ধ বাড়িতে বিমল শীল দেখতে পান তার বাবা তেজেন্দ্র লাল শীল (৭০), মা বকুল শীল (৬০), ভাই অনিল শীল (৪০), অনিলের স্ত্রী স্মৃতি শীল (৩২) এবং অনিলের তিন সন্তান রুমি শীল (১২), সোনিয়া শীল (৭), চার দিন বয়সী কার্তিক শীল,বিমল শীলের চাচাতো বোন বাবুটি শীল (২৫), প্রসাদি শীল (১৭), এনি শীল (৭) এবং কক্সবাজার থেকে বেড়াতে আসা তার মাসি দেবেন্দ্র শীল (৭২) পুড়ে অঙ্গার হয়ে আছেন।।

মামলার বাদি বিমল শীল বলেন, ১১ স্বজনকে পুড়িয়ে হত্যার পর বিচার পাবার আশায় খুনিদের বিরুদ্ধে মামলা করেছিলাম। কিন্তু বিচারের কোন পথই পাচ্ছি না। ১৮ বছর শুধুই আদালতে দৌঁড়লাম। ১৮ বছর ভয়ে বাড়িতেই থাকতে পারছি না। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০০৩ সালে বিরোধী দলীয় নেত্রী থাকা অবস্থায় হত্যার ঘটনা দেখতে এসেছিলেন এবং তিনি খুনিদের বিচার চেয়েছিলেন নিজেই। আমাদের সান্তনাও দিয়েছিলেন। এখন প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থায় খুনিরা প্রকাশ্যে ঘুরছে। ওই সময় একটি পুলিশ ক্যাম্প স্থাপন করা পুলিশ ক্যাম্পটিও চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে উঠিয়ে নিয়েছে। আমরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি। প্রধানমন্ত্রীর কাছে খুনিদের বিচার ও আমাদের নিরাপত্তা চাই।

সহকারী পুলিশ সুপার (আনোয়ারা সার্কেল) হুমায়ন কবির বলেন, পুলিশ ফাঁড়িটি পুলিশ স্বল্পতায় উঠিয়ে নেয়া হয়েছে। তবে প্রতিরাতে রামদাস পুলিশ ক্যাম্প থেকে ৫ জন পুলিশ ওখানে পাঠানো হয়।

বিএনপি নেতা ও সাবেক কালীপুর ইউপি চেয়ারম্যান আমিনুর রহমান চৌধুরী বলেন, আমি ১১জন নিহত হওয়া স্বজনদের পরের দিন সহযোগিতার করেছিলাম। ওই ঘটনায় আমি জড়িত নই। রাজনৈতিক কারণে ২০০৩ সালের ঘটনায় ২০১১ সালে আমাকে চতুর্থবার দেয়া চাজর্শিটে আসামি করা হয়েছে। তাই আমি হাইকোর্টে শুধু আমার বিচারর্য্য বিষয় স্থগিত করেছিলাম। পুরো মামলা স্থগিত করিনি।