বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড : পাকিস্তানি চেতনায় প্রত্যাবর্তনের ব্যর্থ প্রয়াস

ড. মো. সেকান্দর চৌধুরী »

ভারতে ব্রিটিশ শাসনের শেষের দশক মুসলিম লীগ ধর্মীয় দ্বিজাতিতত্ত্বকে প্রতিষ্ঠিত করে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল ভারতের পশ্চিমাঞ্চল ও পূর্বাঞ্চলকে নিয়ে পাকিস্তান নামক একটি আলাদা রাষ্ট্র সৃষ্টি করে। এই পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় পূর্ববাংলার মুসলিম নেতৃত্বের মধ্যে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, এ কে ফজলুল হক, আবুল হাশিম, শামসুল হক ও তরুণ ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমান প্রমুখ অবদান রেখেছেন। ভাষা-সংস্কৃতিগত ব্যাপক ভিন্নতা সত্ত্বেও একটি রাষ্ট্র যে শুধু ধর্মের ওপর ভিত্তি করে টিকে থাকা সম্ভব নয়, তা পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার স্বল্প সময়ের মধ্যে প্রতীয়মান হয়।

পাকিস্তান হওয়ার পর পরই চক্রান্তের রাজনীতি শুরু হয়। পূর্ববাংলার জনগণের ওপর একের পর এক আঘাত আসতে লাগল। সর্বপ্রথম মুসলিম লীগ নেতারা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী করতে চাইলেও মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ও পশ্চিম পাকিস্তানিদের প্রচেষ্টায় খাজা নাজিমুদ্দীনকে পূর্ববাংলার প্রথম মুখ্যমন্ত্রী করা হয়। এতে পূর্ববাংলার জনগণের প্রথম আশাভঙ্গ হয়।

পূর্ববাংলার জনগণ সহসা বুঝতে পারে, রাষ্ট্রভাষার ব্যাপারেও পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকচক্র ষড়যন্ত্র শুরু করেছে। তারা উর্দুকে পূর্ববাংলা ও সমগ্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করতে উদ্যোগ নেয়। এ সময় ভাষার প্রশ্নে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দেয়ার প্রচেষ্টা শুরু হলে পূর্ববাংলার জনগণ পাকিস্তানে প্রথম জাতীয়তাবাদী সংগ্রামের গোড়াপত্তন করে। এর বহিঃপ্রকাশ ঘটে ভাষাবিতর্ক ও ভাষাসংগ্রামের মধ্য দিয়ে। ভাষা আন্দোলনে পূর্ববাংলার জনগণ ধর্মীয় দ্বিজাতিতত্ত্ব থেকে বেরিয়ে সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদের ওপর আস্থাশীল হয়। এর ধারাবাহিকতায় ১৯৪৮ সালের রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি এবং ১৯৪৯ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা হয়।

পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মাতৃভাষা বাংলাকে উপেক্ষা করে উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার প্রতিবাদে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি পূর্ব বাংলার ছাত্র-জনতা রাজপথে জীবন বির্সজন দিয়ে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে। পরবর্তীকালে পূর্ববাংলার জনগণ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে অন্যান্য প্রগতিশীল সংগঠনের সাথে যুক্তফ্রন্ট গঠন করে ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগকে চরমভাবে পরাজিত করে। এতে ধর্মীয় রাজনীতির বিপরীতে ভাষা ও অসাম্প্রদায়িক বাঙালিত্বের চেতনার বহিঃপ্রকাশ ঘটে। নির্বাচনে পরাজিত হয়ে পাকিস্তানি জান্তারা যুক্তফ্রন্ট সরকারকে তার মেয়াদকাল শেষ করতে দেয়নি। তারা পূর্ববাংলার নাম পরিবর্তন করে পূর্ব পাকিস্তান নাম চাপিয়ে দেয়, পূর্ববাংলার ওপর কেন্দ্রের শাসন জারি করাসহ নানা ধরনের বৈষম্যের কারণে বাঙালিদের মধ্যে আলাদা চেতনাবোধ জাগ্রত হয় এবং পূর্ববাংলার জনগণ স্বাধীনতাকামী হয়ে ওঠে।

১৯৫৮ সালে আইয়ুব খানের সামরিক শাসন জারি, ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন এবং ১৯৬৬ সালে শেখ মুজিবুর রহমান আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে বাঙালির বাঁচার সনদ ছয়দফা উত্থাপন করেন। পাকিস্তানি জান্তারা বাংলার অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের ওপর প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করে। এই মিথ্যা মামলা থেকে বাংলার অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবকে মুক্ত করার জন্য পূর্ববাংলার ছাত্র-জনতা ১৯৬৯ সালে গণঅভ্যুত্থান করে। ছাত্র-জনতা প্রিয়নেতাকে মুক্ত করে এবং ‘বঙ্গবন্ধু’ অভিধায় ভূষিত করে। এবং সামরিক শাসক আইয়ুব খানকে ক্ষমতার মসনদ থেকে সরিয়ে দিয়ে নির্বাচন দিতে বাধ্য করে। এরপর অনুষ্ঠিত ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করে। এ নির্বাচনে কেন্দ্র ও প্রাদেশিক পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রিত্বের ম্যান্ডেট পান। কিন্তু ইয়াহিয়া খানের নেতৃত্বে পাকিস্তানি শাসকচক্র নানা অজুহাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে গড়িমসি করতে থাকে এবং পূর্ববাংলার জনগণকে নিশ্চিহ্ন করার নীলনকশা প্রণয়ন করে।

ভূমিধস বিজয়ের পরও ক্ষমতা হস্তান্তরে গড়িমসির প্রতিবাদে ১৯৭১ সালের ১ মার্চ থেকে সমগ্র পূর্ববাংলা উত্তাল হয়ে ওঠে। এমন পরিস্থিতিতে ৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালির স্বাধীনতার রূপরেখা স্পষ্ট করেন। ২৫ মার্চ দিবাগত মধ্যরাতে ‘অপারেশন সার্চলাইট’-এর নামে গণহত্যা শুরু হলে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা অর্জন করার জন্য তিনি সমস্ত বাঙালিকে আহবান জানান এবং এর পরপরই তিনি পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে গ্রেফতার হন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর আহবানে নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ চলতে থাকে। ৩০ লক্ষ শহীদ, ২ লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রম বিসর্জন এবং অগণিত মানুষের ত্যাগের মধ্য দিয়ে বাঙালির বহু কাক্সিক্ষত স্বাধীনতা আসে ১৬ ডিসেম্বরÑ মুক্তিযুদ্ধের বিজয় অর্জনের মধ্যদিয়ে।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর তিনি পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে ১০ জানুয়ারি স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। সদ্যস্বাধীন দেশের পোড়ামাটির ওপর দাঁড়িয়ে শূন্যহাতে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ নির্মাণে হাত দেন। অতি সহসা ভারতীয় মিত্রবাহিনীর ফিরে যাওয়া, অতি অল্প সময়ের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ভিত্তি করে আধুনিক ও বাস্তবসম্মত একটি শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করেন। এতে তিনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবাহী বাঙালি জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র¿, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতাকে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি করেন। অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গঠন এবং অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জনই এই সংবিধানের অভীষ্ট লক্ষ্য। এর মাধ্যমে তিনি দেশ পুনর্গঠনে সর্বতোভাবে আত্মনিয়োগ করেন। এরপর দেশ-বিদেশে বিরাজমান বিষয়সমূহ, যেমন- জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন, ইসলামী সম্মেলন সংস্থা, জাতিসংঘ প্রভৃতিকে সামনে রেখে দেশকে আত্মনির্ভরশীল করতে দ্বিতীয় মুক্তির সংগ্রাম হিসেবে তিনি বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল) প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু তিনি তাঁর স্বপ্নের সোনার বাংলা নির্মাণের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হলেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট একদল বিপথগামী ঘাতকের হাতে সপরিবারে শহীদ হলেন।

খ্রিস্টপূর্ব থেকে পৃথিবীতে বহু রাজনৈতিক হত্যাকা- ঘটেছে। বহু রাজা, প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী, রাজনৈতিক নেতা, মহান নেতা হত্যার শিকার হয়েছেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-টি হয়েছে তাঁকে নির্বংশ করে দেওয়ার জন্য। আমরা দেখি, ১১৭ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে নমেডিয়ান হিমচাল প্রথম, ৪৪ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে রোমের জুলিয়াস সিজার, প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন, প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি, বর্ণবাদবিরোধী নেতা মার্টিন লুথার কিং, ভারতের জাতির পিতা মহাত্মা গান্ধী, প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীসহ অনেকেই রাজনৈতিক হত্যাকা-ের শিকার হয়েছেন। কিন্তু, তাঁরা সপরিবারে নিহত হননি। বঙ্গবন্ধুই পৃথিবীর একমাত্র নেতা যিনি সপরিবারে হত্যার শিকার হন। শিশুপুত্র রাসেল, স্ত্রী, অন্তঃসত্ত্বা পুত্রবধূ, পুত্র, ভাই, ভাগিনা, আত্মীয়-স্বজনসহ পরিবারের সবাইকে হত্যা করা হয়। এরপর আওয়ামী লীগে নেতৃত্ব সংকট তৈরির জন্য মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনাকারী বঙ্গবন্ধুর আস্থাভাজন জাতীয় চার নেতাকে জেলে বন্দি করে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। তবে, ১৫ আগস্টের জঘন্য হত্যাকা- হতে পারিবারিক কারণে জার্মার্নিতে অবস্থান করা বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠকন্যা শেখ হাসিনা ও কনিষ্ঠকন্যা শেখ রেহেনা বেঁচে যান। পরবর্তী সময়ে শেখ হাসিনাকে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট ভয়াবহ গ্রেনেড হামলাসহ অন্তত ২০ বার হত্যার চেষ্টা করা হয়। এতে প্রতীয়মান হয়, ১৯৭৫ সালে ১৫ আগস্টের বঙ্গবন্ধু হত্যাকা- (সপরিবার) ছিল একটি নির্মম আক্রোশ ও প্রতিহিংসার বহিঃপ্রকাশ। বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতা হত্যাকারীরা শুধু জাতির পিতা, তাঁর পরিবার ও রাজনৈতিক সহযোগী হত্যার মধ্যে থেমে থাকেনি। তারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, বাঙালি জাতীয়তাবাদ, অসাম্প্রদায়িকতা এবং ভাষা আন্দোলনের চেতনাকেও মুছে ফেলার চেষ্টা করে।

বাঙালির অসাম্প্রদায়িক বৈশিষ্ট্য ধ্বংস করার জন্য ১৯৭৯ সালে জিয়াউর রহমান সংবিধানের ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ নীতির ওপর আঘাত হানে এবং এর ধারাবাহিকতায় জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ১৯৮৮ সালে সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম সংযোজন করে ‘ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ’ চেতনাকে ক্ষতবিক্ষত করে। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসার পর ২০১০ সালে বাংলাদেশের উচ্চআদালত ধর্মনিরপেক্ষতাকে সংবিধানে পুনঃস্থাপন করেন।

মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাইরে গিয়ে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট পরবর্তী যে পথচলা এর অংশ হিসেবে দেড় মাসের মাথায় ২৬ সেপ্টেম্বর খোন্দকার মোশতাক বঙ্গবন্ধুর খুনিদের রক্ষা করতে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করে। এরপর স্বাধীনতাবিরোধী, আত্মস্বীকৃত রাজাকার শাহ আজিজুর রহমানকে জিয়াউর রহমান প্রধানমন্ত্রী (১৯৭৯-১৯৮২) নিযুক্ত করেন। শাহ আজিজ শুধু মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী নয় বরং ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনেরও প্রত্যক্ষ বিরোধিতাকারী। এরপর বঙ্গবন্ধু হত্যার সুবিধাভোগী খোন্দকার মোশতাক, বিচারপতি সায়েম ও জিয়াউর রহমানের কার্যক্রমকে দায়মুক্তি দিতে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৭৯ সালের ৫ এপ্রিল পর্যন্ত সামরিক সরকারের যাবতীয় কর্মকা-কে বৈধতা দিয়ে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী পাস করা হয়। ’৯১ পরবর্তী খালেদা জিয়ার সরকারের আমলে যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমকে নাগরিকত্ব দিয়ে রাজনীতি করার বৈধতা দেওয়া হয়। এমনকি ২০০১ সালে চারদলীয় জোট ক্ষমতায় এসে আলবদর নেতা, বুদ্ধিজীবী নিধনকারী, স্বঘোষিত রাজাকার মতিউর রহমান নিজামীকে শিল্পমন্ত্রী ও আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদকে সমাজকল্যাণমন্ত্রী করে মুক্তিযুদ্ধের রক্তস্নাত জাতীয় পতাকাকে অবমাননা করা হয়। এটা বাঙালির মহান মুক্তিযুদ্ধের সাথে চরম ধৃষ্টতা বলে প্রতীয়মান হয়।

পৃথিবীর কোন দেশেই স্বাধীনতার সংগ্রাম, স্বাধীনতার ঘোষক, জাতির পিতা নিয়ে বিতর্ক হয় না। অথচ ’৭৫ পরবর্তী বাংলাদেশে এসব নিয়ে অহেতুক বিতর্ক তৈরি করা হয়। উপমহাদেশের স্বল্প সময়ের রাজনীতিবিদ চিত্তরঞ্জন দাশ ‘দেশবন্ধু’ হিসেবে সমাদৃত হয়ে আছেন, তাঁকে নিয়ে কেউ বিতর্ক করে না। স্বাধীনতা সংগ্রামী সুভাষ চন্দ্র বসুর ‘নেতাজি’ উপাধি নিয়েও কারো প্রশ্ন নেই; পাকিস্তানে তাদের জাতির পিতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ কায়দে আযম উপাধিতে সমাদৃত। ভারতের জাতির পিতা মোহন দাস করমচাঁদ গান্ধী পৃথিবীতে মহাত্মা হিসেবে সমাদৃত। অথচ বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা যিনি জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় বাঙালির মুক্তি ও স্বাধীনতার জন্য নিজেকে উৎসর্গ করেছেন, তাঁকে বঙ্গবন্ধু ও জাতির পিতা হিসেবে মানতে অনেকের আপত্তি। এ অপচেষ্টাগুলো স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর অবদান এবং মহান মুক্তিযুদ্ধের বীর শহীদদের আত্মত্যাগকে অপমান বই আর কিছু নয়।

১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত দেশীয় ও আন্তর্জাতিকশক্তি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের মসৃণ পথচলাকে থামিয়ে দেওয়ার জন্য ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে স্বাধীনতার মৌলচেতনা বাঙালি জাতীয়তাবাদের অসাম্প্রদায়িক চেতনার ওপর প্রথম আঘাত হানে। বঙ্গবন্ধু হত্যাকা- পরবর্তী সরকারগুলো মুক্তিযুদ্ধ চেতনাবিরোধী কার্যক্রম প্রবর্তনে কিছুটা সফল হলেও তারা পাকিস্তানি ধারণাকে পুনঃপ্রবর্তন করতে পারেনি। বরং ৩০ লক্ষ শহীদ, ২ লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রম ও অসংখ্য মানুষের ত্যাগের প্রতি সম্মান জানিয়ে জিয়া-এরশাদ-খালেদার অপশাসনে বিপর্যস্ত বাংলাদেশকে সঠিকপথে ওঠানোর জন্য শক্ত হাতে দেশের হাল ধরলেন বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা। বাঙালি জাতির পরম সৌভাগ্য ১৫ আগস্ট অমানবিক, নির্মম হত্যাকাণ্ড থেকে বেঁচে গিয়ে বঙ্গবন্ধুতনয়া শেখ হাসিনা ১৯৮১ সালে ভঙ্গুর আওয়ামী লীগের কান্ডারি হয়ে ধরে ধীরে ধীরে এ দলকে এগিয়ে নিলেন। জনমানুষের ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে ১৯৯৬ সালে রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলেন। এরপর তিনি ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল করে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার করেন এবং ২০০৯ সালে পুনরায় ক্ষমতায় এসে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস ট্রাইব্যুনাল গঠন করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করান।

জিয়া-এরশাদ-খালেদা সরকারের শাসনে ভূলুণ্ঠিত স্বাধীনতার চেতনা আবার আপন মহিমায় ফিরে আসছে এবং বাঙালিত্বের অসাম্প্রদায়িক চেতনা প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে। এর মাধ্যমে বাংলাদেশ ভাষা আন্দোলনের চেতনা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় পুনঃপ্রবর্তন করছে এবং পাকিস্তানি ধ্যান-ধারণা থেকে ফিরে আসার সুযোগ পাচ্ছে। এ পথচলা অবিরত থাকলেই দেশ পরিচালনায় ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বঙ্গবন্ধু প্রবর্তিত চার মূলনীতির পরিপূর্ণ বাস্তবায়নের পথ খুলবে। সেই পথ নির্মাণে জননেত্রী শেখ হাসিনা সফলতার সাথে অগ্রসর হচ্ছেন। তাঁর নেতৃত্বেই স্বাধীনতাকামী সকল আত্মোৎসর্গকারীর মর্যাদা অক্ষুণ্ন থাকবে এবং বঙ্গবন্ধুর কাক্সিক্ষত সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠিত হবে- এটিই আমাদের সকলের প্রার্থনা।