ফেব্রুয়ারিতে শুরু হচ্ছে স্যুয়ারেজ প্রকল্পের কাজ

২৬২৭ কোটি টাকায় নির্মাণকাজ পেয়েছে কোরিয়ান প্রতিষ্ঠান

সেপটিক ট্যাংকমুক্ত নগর

ভূঁইয়া নজরুল »

২০১৭ সালের ১২ মার্চ চট্টগ্রাম বোট ক্লাব প্রাঙ্গণ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চট্টগ্রাম ওয়াসার ‘শেখ হাসিনা পানি শোধনাগার’ প্রকল্পের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে কর্ণফুলী নদী রক্ষার বিষয়ে কথা বলেন। একইসময়ে চট্টগ্রাম মহানগরীয় পয়ঃবর্জ্য গিয়ে দূষিত হওয়া কর্ণফুলী নদীকে রক্ষা করতে চট্টগ্রাম ওয়াসাকে একটি স্যুয়ারেজ প্রকল্প গ্রহণের নির্দেশনা দিয়েছিলেন তিনি। এমনই এই প্রকল্প মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হলে তা অনুমোদন দেয়ারও অঙ্গীকার করেছিলেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেই অঙ্গীকার রক্ষা করেছিলেন। এমনকি দেশের সকল উন্নয়ন প্রকল্পে যে সংস্থাকে সরকারি ফান্ডের টাকা দেয়া হয় তা কিন্তু পরবর্তীতে ফেরত দিতে হয়। কিন্তু ২০১৮ সালের ৭ নভেম্বর একনেক সভায় স্যুয়ারেজ প্রকল্পের ২ হাজার ৮০০ কোটি টাকা গ্র্যান্ট (অনুদান) হিসেবে চট্টগ্রাম ওয়াসাকে দিয়েছেন। অর্থাৎ এই অর্থ সরকারকে ফেরত দিতে হবে না।

একটি আধুনিক নগর গড়ে তোলার যে স্বপ্ন নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্যুয়ারেজ প্রকল্পের অনুমোদন দিয়েছিলেন অবশেষে তা বাস্তবায়নের দিকে এগোচ্ছে। দরপত্র প্রক্রিয়ার পর একজন ঠিকাদার নিয়োগ শেষ হয়েছে। সরকারের ক্রয় সংক্রান্ত কমিটিরও অনুমোদন পাওয়া গেছে। এখন শুধু ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানকে কার্যাদেশ দেয়ার বাকি রয়েছে। শিগগিরই তা শেষ হবে এবং আগামী ফেব্রুয়ারিতে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান তায়েং ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেড কাজ শুরু করবে বলে জানা যায়।

এবিষয়ে স্যুয়ারেজ প্রকল্পের পরিচালক ও চট্টগ্রাম ওয়াসার তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মোহাম্মদ আরিফুল ইসলাম বলেন, ‘কাজের অগ্রগতি দেখে মনে হচ্ছে ফেব্রুয়ারিতে প্রকল্প এলাকায় কাজ শুরু করতে পারবো। আর কাজ শুরুর পর তা শেষ করতে চার বছর সময় লাগবে।’

একনেকে অনুমোদন পেল ২০১৮ সালের নভেম্বরে কিন্তু ঠিকাদার নিয়োগ হলো তিন বছর পর। এতো দীর্ঘ সময়ের কারণ কি জানতে চাইলে তিনি বলেন, একনেক অনুমোদনের পর একটি প্রকল্পের অনেক ধরনের কাজ থাকে। সেগুলো শেষ করে আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান তা মূল্যায়ন ও পরীবিক্ষণের পর ঠিকাদার চূড়ান্ত হয়ে থাকে। এতে সময় লেগেছে।’

জানা গেছে, ছয়টি প্রতিষ্ঠান দরপত্রে অংশ নিয়েছিল। কিন্তু এদের মধ্যে কারিগড়ি রিপোর্টে মাত্র একটি প্রতিষ্ঠান চূড়ান্ত হয়। কোরিয়ান প্রতিষ্ঠান তায়েং ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেডের ডিজাইন (কারিগড়ি রিপোর্ট) অনুমোদন পাওয়ার পর আর্থিক খাম খোলা হয়। এতে প্রতিষ্ঠানটি ২ হাজার ৬২৭ কোটি টাকায় ১০ কোটি লিটার আয়তনের স্যুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট, ৩০০ ঘনমিটার আয়তনের ফিকেল স্ল্যাজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট এবং ৯০ কিলোমিটার পয়োপাইপ লাইন বসানোর কাজ করবে। এই প্রকল্পের আওতায় আরো প্যাকেজ-২ ও প্যাকেজ-৩ নামে আরো দুটি অংশ রয়েছে। সেগুলো মূলত: পাইপ লাইন বসানোর কাজ।

কি হবে এই প্রকল্পের আওতায়?

এই প্রকল্পের আওতায় নগরীতে কোনো সেপটিক ট্যাংক থাকবে না। অর্থাৎ, মানুষ ও গৃহস্থালীর সকল বর্জ্য পাইপের মাধ্যমে চলে যাবে স্যুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টে। নালা ও খালে যুক্ত হবে না বাসা-বাড়ির কোনো পয়ঃবর্জ্য। কর্ণফুলী হবে না বর্জ্যরে ভাগার। কিভাবে সেপটিক ট্যাংকবিহীন নগরী গড়ে তোলা হবে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী এ কে এম ফজলুল্লাহ বলেন, স্যুয়ারেজ প্রকল্পের আওতায় প্রতিটি বাসা থেকে পয়ঃবর্জ্য সরাসরি পাইপ লাইনের মাধ্যমে চলে যাবে স্যুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টে। এতে কোনো ভবনে আর সেপটিক ট্যাংক থাকবে না।

কোন এলাকা এই প্রকল্পের আওতায় থাকবে?

ওয়াসা কোন কোন এলাকায় এই স্যুয়ারেজ প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে জানতে চাইলে ওয়াসার তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মোহাম্মদ আরিফুল ইসলাম বলেন, ‘নগরীর পানি প্রবাহের উপর ভিত্তি করে পুরো নগরীকে ছয়টি জোনে ভাগ করা হয়েছে। এই ছয়টি জোনে ছয়টি স্যুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট হবে এবং পুরো নগরীতে দুটি ফিকেল সø্যাজ শোধনাগার থাকবে। ছয়টি জোনের মধ্যে প্রথম পর্যায়ে একটি জোন বাস্তবায়ন করা হবে।

সেই জোন কোনটি জানতে চাইলে তিনি বলেন, কোতোয়ালী, বাটালিহিল, মাঝিরঘাট, মাদারবাড়ি, আগ্রাবাদ, টাইগারপাস, আমবাগান, নয়াবাজার, চৌমুহনী, উত্তর হালিশহর, হালিশহর আনন্দবাজার এলাকার ২০ লাখ মানুষ সবার আগে এই সুবিধা পাবে। এজন্য হালিশহর আনন্দ বাজার এলাকায় সাগর পাড় ঘেষে ১৬৫ একর জায়গায় স্যুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টটি গড়ে তোলা হচ্ছে।

কিভাবে হবে প্রকল্পটি?

একটি ঘরে তিনটি উৎস থেকে পানি আসে। একটি হলো বৃষ্টির পানি, অপরটি রান্নাঘরের ও গোসলখানার ব্যবহারের পানি এবং টয়লেটের লাইনের পানি ও বর্জ্য। স্যুয়ারেজ প্রকল্পের আওতায় বৃষ্টির পানি চলে যাবে ড্রেনে, আর বাকি সব পানি পাইপ লাইনের মাধ্যমে স্যুয়ারেজ লাইনে চলে যাবে। এজন্য পুরো নগরীতে সর্বোচ্চ ২০ ইঞ্চি ও সর্বনিম্ন ৪ ইঞ্চি ব্যাসের পাইপ বসানো হবে। এসব পাইপ দিয়ে বর্জ্য ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টে যাবে।

সব এলাকায় পাইপ বসানো যাবে কিনা জানতে চাইলে ওয়াসার তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মোহাম্মদ আরিফুল ইসলাম বলেন, ‘যেসব এলাকায় পাইপ লাইন বসানো যাবে না, সেসব এলাকায় দুটি খালের মাধ্যমে সø্যাজগুলো প্রবাহিত করে পাইপ লাইনে প্রবেশ করানো হবে।’

ওয়াসা কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, প্রাথমিকভাবে হালিশহরে প্রকল্পের কাজ শুরু হলেও পর্যায়ক্রমে পুরো নগরী স্যুয়ারেজ প্রকল্পের আওতায় আসবে।

পরিবেশ ও নগর বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য

নগরীর সকল ভবনের অনুমোদন দিয়ে থাকে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)। কিন্তু সকল ভবনের নিজস্ব সেপটিক ট্যাংক রয়েছে এবং সেগুলোর আউটলেট অবশ্যই নালা বা ড্রেনের সাথে সংযুক্ত উল্লেখ করে সিডিএ’র প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ শাহীনুল ইসলাম খান বলেন, ‘একটি নগরীর পয়ঃবর্জ্য এভাবে উন্মুক্তভাবে নালা বা ড্রেন হয়ে খালে এবং সর্বশেষ নদীতে গিয়ে পড়তে পারে না। এতে খালের পানি যেমন কালো হচ্ছে, খালের উভয় পাড়ে যেমন দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে তেমনিভাবে দূষিত হচ্ছে কর্ণফুলী নদীর পানি।’

তিনি আরো বলেন, পরিবেশ তথা জীবনমান উন্নয়নে চট্টগ্রাম ওয়াসার স্যুয়ারেজ প্রকল্পটি শতভাগ কার্যকরী। আর এজন্যই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রকল্পটি গ্রহণ করার জন্য বলেছিলেন।

এদিকে চট্টগ্রামের পরিবেশ ইস্যুতে সোচ্চার থাকেন পরিবেশবিদ ইদ্রিস আলী। রসায়নের এই অধ্যাপক বলেন, ‘অবশ্যই প্রকল্পটি সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য। কিন্তু মাঝপথে যাতে আবার বন্ধ হয়ে না যায়। পর্যায়ক্রমে পুরো নগরী এই প্রকল্পের আওতায় আনা গেলে অবশ্যই এর সুফল পাওয়া যাবে।’

পরিবেশবিদদের মতে, প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে নগরীর নালা ও খালগুলো অনেকটা দূষণমুক্ত হবে। একইসাথে এসব খালগুলো ব্যবহার উপযোগী হবে এবং কর্ণফুলীতে জীববৈচিত্র্য পুনরুদ্ধার হবে।

উল্লেখ্য, ওয়াসা নামের অর্থ হচ্ছে ‘ওয়াটার সাপ্লাই অ্যান্ড স্যুয়ারেজ অথরিটি’। ১৯৬৩ সালে তা প্রতিষ্ঠার পর থেকে নগরবাসীকে সুপেয় পানি সরবরাহের জন্য কাজ করলেও স্যুয়ারেজের বিষয়ে তাদের কোনো কর্মকাণ্ড ছিল না। ওয়াসা স্যুয়ারেজ মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়ন করে ২০১৭ সালে। মাস্টারপ্ল্যান একনেকে অনুমোদনের দিন (২০১৭ সালের জানুয়ারিতে) প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মাস্টারপ্ল্যানের আওতায় স্যুয়ারেজ প্রকল্প নেওয়ার জন্য বলেছিলেন। আর এরফলে ওয়াসা প্রকল্প গ্রহণ করে এবং ২০১৮ সালের নভেম্বরে ৩ হাজার ৮০০ কোটি টাকার প্রকল্প অনুমোদন পায়।