প্রযুক্তি এ্যাডিকশন রোধে সচেতনতার বিকল্প নেই

রায়হান আহমেদ তপাদার »

আধুনিক প্রযুক্তিবিদ্যার যুগে আমাদের সবার ঘরবাড়িতেই আজ স্মার্ট টেকনোলজিক্যাল ডিভাইস আছে। উন্নত মানের মোবাইল, পারসোনাল কম্পিউটার, টেলিভিশন, টেলিভিশনের সঙ্গে যুক্ত গেমিং ডিভাইসসহ আরও অনেক গ্যাজেটই আমাদের ঘরবাড়িতে রয়েছে। আমরা প্রাপ্তবয়স্করা সবাই সারা দিন ব্যস্ত থাকি আমাদের মোবাইল আর কম্পিউটার নিয়ে।আর এ জন্য আমরা পরিবারের শিশুদের পর্যাপ্ত সময় দিতে পারি না, যার কারণে শিশুরা মানসিকভাবে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বড়দের সংস্পর্শের অভাবে তারা একা একা, নিজেরা নিজেরা বড় হচ্ছে।এ ছাড়া আজকাল কমবয়সী শিশুদের হাতে ইলেকট্রনিক ডিভাইস তুলে দেওয়া হচ্ছে।ফলে তারা এগুলোর প্রতি মারাত্মকভাবে আসক্ত হয়ে পড়ছে। তাদের স্বাভাবিক জীবন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, তারা পড়াশোনায় মনোযোগ হারিয়ে ফেলছে। এ বিষয়ে আমরা যথাসময়ে সতর্ক না হলে আমাদের শিশুদের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হবে।
প্রযুক্তির অপব্যবহার রোধে আমাদের সবাইকে একসঙ্গে এগিয়ে আসতে হবে।শিশু-কিশোরদের মধ্যে অধিক মাত্রায় ভিডিও গেম বা ফেসবুকের মতো ভার্চুয়াল লাইফে সংশ্লিষ্টতার কারণে ধীরে ধীরে তা আসক্তিতে পরিণত হয়।নিঃসন্দেহে বলা যায়, বিশ্বের প্রযুক্তিগত উন্নয়ন শীর্ষ অবস্থায় এবং এ উন্নয়নের পরশে মানুষের জীবন যাত্রায় হয়েছে লক্ষণীয় পরিবর্তন; এনেছে গতি ও শৌখিনতা। কিন্তু এর অপব্যবহারে প্রাপ্তবয়স্কদের পাশাপাশি শিশুদের ওপরও নানাভাবে এর কুপ্রভাব পড়ছে। উন্নত বিশ্বের শিশুদের মতো বাংলাদেশের শিশু-কিশোরদের মধ্যেও প্রযুক্তি ব্যবহারের প্রতি আসক্তি বাড়ছে।
আল্ট্রাপ্রযুক্তির বিভিন্ন উপকরণে আসক্তির কারণে শিশু-কিশোরদের প্রযুক্তির প্রতি এ ক্রম-আসক্তি পরিপূর্ণ মানসিক ও শারীরিক বিকাশের অন্তরায় হিসেবে কাজ করছে। পরিবারে মা ও শিশুর মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি হচ্ছে। মায়ের জন্য তারা আলাদা সময় বের করতে পারছে না। যার ফলে পারিবারিক প্রথাগত শিক্ষা, শিষ্টাচার, ভ্যালুজ এডুকেশন তথা ধর্মীয় ও সামাজিক আচরণ অর্জন থেকে তারা বঞ্চিত হচ্ছে।
বর্তমান সময়ে প্রযুক্তি ছাড়া আমরা একটা মুহূর্তও কল্পনা করতে পারি না। সারা দিনের সব কাজে আমরা প্রযুক্তির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বাসা কিংবা অফিস আমাদের প্রতিদিন একটা দীর্ঘ সময় কাটাতে হয় কম্পিউটার, ল্যাপটপ আর ইন্টারনেটের দুনিয়ায়। তবে প্রযুক্তি আমাদের কাছে আশীর্বাদ হয়ে এলেও খুব জলদি আমাদের জন্য দুঃসংবাদ নিয়ে আসতে পারে। কারণ বড়দের পাশাপাশি ছোটরাও এখন এই প্রযুক্তির কাছে বন্দী। একটা সময় বিকেল হলেই খেলার মাঠগুলোতে ছোটাছুটিতে মেতে থাকত শিশু-কিশোররা। ফুটবল, ক্রিকেট, গোল্লাছুট, কাবাডি, দাঁড়িয়াবান্ধা, ডাঙ্গুলি, মার্বেল, ক্রামবোর্ডসহ নানা খেলায় বুঁদ হয়ে থাকত তারা। ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে সহপাঠীদের সঙ্গে আড্ডা, দৌড়াদৌড়ি, দুষ্টুমিই ছিল তাদের নিত্যদিনের আনন্দ। সকাল-সন্ধ্যায় গল্পের বইয়ে ডুব দেয়া, বড়দের সঙ্গে সঙ্গে বাইরে ঘুরতে যাওয়া, প্রবীণদের কাছ থেকে গল্প শোনা ছিল তাদের কাছে একটা ভিন্ন রকম অভিজ্ঞতা। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আজকে যেন সবই হারিয়ে যেতে বসেছে। এসব জয়গা এখন দখল করে নিয়েছে মোবাইল, কম্পিউটার, ট্যাব আর ল্যাপটপের মতো আধুনিক প্রযুক্তি।
উল্লেখ্য যে, শহর কিংবা গ্রাম এখন সব জায়গাতেই পিতামাতারা সন্তানকে সময় দিতে পারেন না ব্যস্ততার কারণে। তাই শিশুদের সময় কাটে এখন টিভির কার্টুনে নয়তো মোবাইল ফোন, ট্যাব বা প্রযুক্তির নানা আরও পণ্য। আবার কিছু বাবা-মা তার চঞ্চল শিশুকে অন্য কোন উপায়ে নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে অগত্যা মোবাইল দিয়ে বসিয়ে দেন। আবার অনেক মা তার সন্তান খেতে না চাইলে মোবাইল ফোন হাতে তুলে দেন। তারা ইউটিউবে গান শুনতে শুনতে কার্টুন দেখেতে দেখতে খাবার খায়। এভাবেই পিতা-মাতারা সন্তানকে শান্ত রাখতে তাদের হাতে তুলে দিচ্ছেন স্মার্টফোনসহ নানা ধরনের প্রযুক্তি পণ্য। এতে একদিকে যেমন বাবা-মায়েরা নিশ্চিত হচ্ছেন, অন্যদিকে তেমনি তারা এটাকে আভিজাত্যের অংশ মনে করেন। আবার অনেকেই আত্মতৃপ্তিতে ভোগেন কারণ তার সন্তান ইন্টারনেট থেকে সব তথ্য, এ্যাপস ডাউনলোড করতে পারে এবং খুব ভাল গেমস দেখতে পারে। এখনকার শিশুরা প্রযুক্তি পণ্যে এতটাই আসক্ত যে, তাদের হাত থেকে মোবাইল ফোন বা ট্যাব কেড়ে নিলে তারা রেগে যায় এবং নেতিবাচক আচরণ করে। কার্টুন দেখতে দেখতে এবং গেমস খেলতে খেলতে শিশুদের এমন অবস্থা হয়েছে যে তারা অন্য কোন দিকে খেয়াল করে না, কারও সঙ্গে চোখে চোখ রেখে কথা বলে না। তাদের ডাকলে তারা সহজে সাড়া দেয় না। তারা অন্য একটা জগতে থাকে।এখনকার শিশুরা সব কাজ করছে নেট ব্রাউজ করে। ফলে ব্যাহত হচ্ছে শিশুর মেধার চর্চা। মাথা খাটিয়ে বুদ্ধিবৃত্তিক কাজ থেকে সরে যাচ্ছে তারা। সব কিছুর সমাধান তৈরি পাচ্ছে ফলে তাকে কিছুই করতে হচ্ছে না। সব বাচ্চার ক্ষেত্রে এটা সত্যি নাও হতে পারে।
তবে বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে প্রযুক্তির ওপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীলতা আমাদের মস্তিষ্কে অকার্যকর করে দেয় দিনে দিনে। প্রযুক্তি ছাড়া আমরা কিছু ভাবতে বা করতে পারি না। যাকে বলে প্রযুক্তি এ্যাডিকশন। শিশু-কিশোরকে প্রযুক্তি আসক্তি থেকে বাঁচাতে বাবা-মায়েরা মৌলিক কিছু পদক্ষেপ নিতে পারেন। এটা খুব জরুরি। মনে রাখবেন আপনার শিশু যত বেশি আসক্ত হয়ে পড়বে তত তাকে ফিরিয়ে আনা কঠিন হবে। ঘরে একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য প্রযুক্তির ব্যবহার সম্পূর্ণ বন্ধ রাখুন। পারিবারের প্রত্যেকে ওই সময় কম্পিউটার, মোবাইল বা অন্য যেকোন ইলেকট্রনিক পণ্য ব্যবহার থেকে দূরে থাকুন। এ সময়টা বরাদ্দ করুন বই পড়া, রান্না করা, ছবি আঁকা বা অন্য কোন কাজের জন্য।একটা সময় বেঁধে প্রযুক্তি ব্যবহারের অভ্যাস করুন। নিজে মেনে চলুন, সন্তানদেরও উৎসাহিত করুন। একটা গাইড লাইন তৈরি করুন। কতক্ষণ পড়াশোনা, কতক্ষণ গেমস খেলা, কতক্ষণ ইন্টারনেট ব্যবহার করবেন, সব কিছুর। দেখবেন অকারণে প্রযুক্তির ব্যবহার কমে আসবে। এছাড়া প্রত্যেক পিতা মাতার উচিত তার সন্তানকে মাঝে মাঝে বিশেষ করে ছুটির দিনগুলোতে বিভিন্ন স্থানে বেড়াতে নিয়ে যাওয়া। এতে করে তার মানসিক বিকাশ ঘটবে এবং প্রযুক্তির আসক্তি কমে আসবে। সবচেয়ে ভাল আগে সচেতন হওয়া। আপনার সন্তানের দায়িত্ব আপনার। তাকে যাবতীয় ভাল কিছুর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার দায়িত্বও আপনার। আজকের শিশুই আগামীর ভবিষ্যৎ ও জাতির মেরুদ-। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের অস্তিত্বের প্রশ্নেই আমাদের বোধোদয় হওয়া উচিত।
এমনকি বিরতিহীনভাবে এসব প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে শিশুদের চোখ ও মস্তিষ্কের মধ্যে মাত্রাতিরিক্ত চাপ পড়ে। রেডিয়েশনের প্রভাবে ধীরে ধীরে দৃষ্টিশক্তি কমে যায়। মস্তিষ্ক সঠিকভাবে কাজ করে না। তারা হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। কোনো কিছুতেই আগ্রহ থাকে না। কোনো কায়িক পরিশ্রম কিংবা খেলাধুলা তারা করতে চায় না। সারাক্ষণ আঙুল, চোখ ও মস্তিষ্ক ব্যবহারের মধ্য দিয়ে তাদের মনের চাহিদা পূরণ করতে চায়। অন্যদিকে বিরামহীনভাবে ভিডিও গেম খেলার কারণে কনভালশন তথা খিঁচুনি কিংবা মৃগীর মতো স্নায়বিক সমস্যা দেখা দিতে পারে। দীর্ঘ সময় শুয়ে অথবা বসে ভিডিও গেমস বা ফেসবুকিং করার ফলে হাঁটু ও কোমরে ব্যথা দেখা দেয়। কায়িক পরিশ্রমের খেলাধুলা না করায় অল্প বয়সে তাদের শরীরে চর্বি জমে যায়। এতে করে লিভার, কিডনিসহ হৃদরোগের ঝুঁকি বেড়ে যায়। শিশুরা এখন মা-বাবার মনোযোগ পেতে তাদের প্রিয় ডিভাইসগুলোর সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। মনোবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে এতটা প্রযুক্তিপণ্যের ওপর আসক্তি এক ধরনের মানসিক রোগ। বিকারগ্রস্ত মানসিকতা নিয়ে প্রযুক্তির অপব্যবহারের মাধ্যমে এই শিশু-কিশোররাই বিভিন্ন সামাজিক অপরাধে যুক্ত হচ্ছে। তাদের কচি মস্তিষ্কে বিভিন্ন ইনোভেটিভ ক্রাইমপ্ল্যান করে নানা ঘটনার সাথে যুক্ত হচ্ছে। যার ফলে আশঙ্কাজনকভাবে সমাজে কিশোর অপরাধীর সংখ্যা বাড়ছে। মূলত প্রযুক্তিপণ্য ও ফেসবুকই সব সমস্যা নয়, আমরা কিভাবে এগুলো ব্যবহার করছি, সেটাই অন্যতম বিবেচ্য বিষয়। শিশুদের প্রযুক্তি ব্যবহারের প্রতি আসক্তি দূর করতে জনসচেতনতা প্রয়োজন।

লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট