প্রদীপের ইয়াবা কারবার জেনে যাওয়ায় খুন সিনহা

পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড : র‌্যাব

অভিযোগপত্রে আসামি ১৫

সুপ্রভাত ডেস্ক :
টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাশের ‘ইয়াবা কারবারের খবর জেনে যাওয়ায়’ সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খানকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয় বলে উঠে এসেছে র‌্যাবের তদন্তে।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা র‌্যাব-১৫ তে দায়িত্বরত সহকারী পুলিশ সুপার মো. খায়রুল ইসলাম রোববার সকালে কক্সবাজারের জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম তামান্না ফারার আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেন। খবর বিডিনিউজের।
টেকনাফ থানার সাবেক ওসি প্রদীপ, বাহারছড়া ক্যাম্পের পরিদর্শক লিয়াকত আলীসহ ১৫ জনকে আসামি করা হয় সেখানে।
বিকালে ঢাকার কারওয়ান বাজারে র‌্যাবের মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে ওই তদন্তের বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরেন এ বাহিনীর গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আশিক বিল্লাহ।

তিনি বলেন, ‘এ মামলার তদন্তের মূল বিষয় হচ্ছে এটি একটি পরিকল্পিত হত্যাকা-। প্রদীপের স্বেচ্ছাচারিতা ও ইয়াবা বাণিজ্যের বিষয়টি সিনহা জেনে যাওয়ায় এই ঘটনা।’
গত ৩১ জুলাই রাতে কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়কের বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুরে এপিবিএন চেকপোস্টে পুলিশের গুলিতে নিহত হন সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান। ৫ আগস্ট মামলা দায়ের করেন মেজর সিনহার বোন। অপরদিকে ৬ আগস্ট আদালতে আত্মসমর্পণ করেন আসামি প্রদীপ।
কক্সবাজারের পুলিশ সে সময় বলেছিল, সিনহা তার পরিচয় দিয়ে ‘তল্লাশিতে বাধা দেন’। পরে ‘পিস্তল বের করলে’ চেক পোস্টে দায়িত্বরত পুলিশ তাকে গুলি করে।
কিন্তু পুলিশের দেওয়া ঘটনার বিবরণ নিয়ে প্রশ্ন উঠলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তদন্ত শুরু করে। পরিদর্শক লিয়াকত ও ওসি প্রদীপসহ নয় পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করেন সিনহার বোন শারমিন শাহরিয়া ফেরদৌস।
সিনহা হত্যাকা-ের পেছনে যে প্রদীপের অবৈধ কর্মকা-ের কোনো বিষয় থাকতে পারে, সে গুঞ্জন তখন থেকেই ছিল। কিন্তু তদন্তকারীদের তরফ থেকে এর আগে এ বিষয়ে স্পষ্ট কিছু বলা হয়নি।
র‌্যাব কর্মকর্তা আশিক বিল্লাহ বলেন, ‘ইয়াবা বাণিজ্যের বিষয়টি জেনে যাওয়ায় সিনহা জুলাই মাসের মাঝামাঝি প্রদীপের বক্তব্য নিতে গেলে প্রদীপ সরাসরি হুমকি দিয়েছিল।
‘প্রদীপ ভেবেছিল, হুমকি দিলে সিনহা কক্সবাজার ত্যাগ করবে। কিন্তু কক্সবাজার ত্যাগ না করায় হত্যার পরিকল্পনা করা হয়। তদন্ত কর্মকর্তা তদন্তে এমনটিই পেয়েছেন।’
এ মামলার তদন্ত কর্মকর্তার প্রশংসা করে লেফটেন্যান্ট কর্নেল আশিক বিল্লাহ বলেন, ‘পুলিশে ৩২ বছর ধরে কাজের অভিজ্ঞতা ও অনেক গুরুত্বপূর্ণ মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সহকারী পুলিশ সুপার খায়রুল ইসলাম। অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে ও প্রভাবমুক্ত হয়ে এ মামলার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন।’
চার মাস দশ দিন ধরে তদন্ত শেষে ২৬ পৃষ্ঠার যে তদন্ত প্রতিবেদন খায়রুল ইসলাম আদালতে দিয়েছেন, তাতে মোট ৮৩ জনকে সাক্ষী করা হয়েছে।
অভিযোগপত্রের ১৫ আসামি হলেন: পরিদর্শক লিয়াকত আলী, টেকনাফ থানার সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাশ, এসআই নন্দ দুলাল রক্ষিত, কনস্টেবল সাফানুর করিম, কামাল হোসেন, আব্দুল্লাহ আল-মামুন, মোহাম্মদ মোস্তফা, এপিবিএন এর তিন সদস্য এসআই মোহাম্মদ শাহজাহান, কনস্টেবল মোহাম্মদ রাজীব ও মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ, পুলিশের মামলার তিন সাক্ষী নুরুল আমিন, নেজাম উদ্দিন ও মোহাম্মদ আয়াজ, টেকনাফ থানার সাবেক কনস্টেবল রুবেল শর্মা এবং সাবেক এএসআই সাগর দেব।
সংবাদ সম্মেলনে আশিক বিল্লাহ বলেন, সিনহা হত্যাকা-ের ‘মূল পরিকল্পনায়’ ছিলেন বরখাস্ত ওসি প্রদীপ, পরিদর্শক লিয়াকত, এসআই নন্দদুলাল, তিন এপিবিএন সদস্য এবং বেসামরিক তিনজন, যাদের পুলিশের মামলায় সাক্ষী করা হয়েছিল।
এছাড়া এসআই লিটনসহ অন্যরা ‘ঘটনা ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার’ চেষ্টা করেছেন বলে তথ্য পেয়েছেন তদন্ত কর্মকর্তা।
আশিক বিল্লাহ বলেন, ‘জুলাই মাসের তৃতীয় সপ্তাহে লিয়াকত তিন সোর্স নুরুল আমিন, নেজাম উদ্দিন ও মোহাম্মদ আয়াজের সঙ্গে হত্যা পরিকল্পনা নিয়ে সাক্ষাতও করেছিলেন, সে তথ্যও তদন্তকারী কর্মকর্তা জানতে পেরেছেন।’
এছাড়া গুলি করার পর সিনহার ‘মৃৃত্যু নিশ্চিত’ করতেই তাকে হাসপাতালে নিতে ‘সমক্ষেপণ’ করা হয় এবং পরে ‘লোক দেখাতে’ হাসপাতালে নেওয়া হয় বলে মন্তব্য করেন এই র‌্যাব কর্মকর্তা।
এক প্রশ্নের জবাবে আশিক বিল্লাহ বলেন, সিনহা ছিলেন সদালাপী, মানুষের সঙ্গে দ্রুত মিশে যাওয়ার ক্ষমতা ছিল তার। ‘ভিডিও কন্টেন্ট’ তৈরি করতে কক্সবাজারে গেলেও এলাকাবাসীর কাছ থেকে কথায় কথায় তিনি প্রদীপের ‘অপকর্মের খবর’ জেনে যান এবং প্রদীপের কাছে বিষয়টি জানতে চান।
সে সময় প্রদীপ কি হুমকি দিয়েছিলেন- এ প্রশ্নে র‌্যাব কর্মকর্তা আশিক বিল্লাহ বলেন, ‘কক্সবাজার থেকে চলে যাওয়ার হুমকি দিয়েছিল এবং না গেলে সিনহাকে ধ্বংস করা হবে বলে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছিল প্রদীপ।’
তবে সিনহা হত্যাকা-ের পর তাদের মোবাইল ফোন, ক্যামেরা, ল্যাপটপসহ যা যা পুলিশ জব্দ করেছিল, সেগুলো র‌্যাবের হাতে যাওয়ার পর তেমন কিছু সেখানে পাওয়া যায়নি বলে জানান আশিক বিল্লাহ। তার ধারণা, ডিজিটাল কনটেন্ট যা ছিল, তা ‘আগেই ধ্বংস করা হয়েছে’।
আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘প্রদীপ সরকারি বৈধ অস্ত্রের অবৈধ ব্যবহার করে কক্সবাজারে অভয়ারণ্য তৈরি করেছিল।’
প্রদীপের অপরাধের সঙ্গে তখনকার পুলিশ সুপারের কোনো সংশ্লিষ্টতার তথ্য তদন্তে এসেছে কি না জানতে চাইলে আশিক বিল্লাহ বলেন, তদন্তকারী কর্মকর্তা পুলিশ সুপারের ‘উদাসীনতা ও অপেশাদার আচরণের’ প্রমাণ পেয়েছেন। তাই প্রতিবেদনে পুলিশ সুপারের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।
শিপ্রা-সিফাতের বিরুদ্ধে অভিযোগের ‘সত্যতা মেলেনি’
কক্সবাজারে পুলিশের গুলিতে নিহত অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খানের সঙ্গে ‘ডকুমেন্টারি’ নির্মাণে যুক্ত স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী শিপ্রা দেবনাথ ও সাহেদুল ইসলাম সিফাতের বিরুদ্ধে পুলিশের দায়ের করা মাদকের মামলায় অভিযোগের ‘সত্যতা পায়নি’ র‌্যাব। খবর বিডিনিউজের।
মামলা দুটির তদন্ত শেষে র‌্যাবের তদন্তকারী কর্মকর্তা এএসপি বিমান চন্দ্র কর্মকার গতকাল রোববার কক্সবাজারের জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম তামান্না ফারাহর আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন।
এ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) ফরিদুল আলম বলেন, ‘অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়নি উল্লেখ করে র‌্যাবের তদন্ত কর্মকর্তা আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন। আদালত তা গ্রহণ করে ব্যবস্থা গ্রহণের আদেশ দিয়েছেন।’