নির্মল বিশুদ্ধতার ‘বাটালি হিল’

বাটালি হিলে একদিন

হুমাইরা তাজরিন »

জিলাপির প্যাঁচের মতো আঁকাবাঁকা রাস্তা হওয়ায় একে জিলাপি পাহাড় বলা হয়। এটিই মনোরম পাহাড় বেষ্টিত চট্টগ্রাম শহরের সর্বাধিক উঁচু পাহাড় যা বাটালি পাহাড় নামে পরিচিত। ৪৩ দশমিক ৫০ একর আয়তনের এই পাহাড় থেকে চট্টগ্রাম শহরের একটা বড় অংশ এবং বঙ্গোপসাগর দেখা যায়। যা সমুদ্রপৃষ্ট থেকে ১৮০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত।

বাটালি হিলের পাহাড়ে থাকা গণপূর্ত অধিদপ্তরের এক ফলকে থাকা পাহাড়টির বর্ণনায় জানা যায়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এই উচুঁ পাহাড়ে বিমান বিধ্বংসী কামান স্থাপন করা হয়েছিলো। তারও আগে দূর সমুদ্রে জাহাজ চলাচলের জন্য এই পাহাড়ের উপরে একটি বাতিঘরও ছিলো। এ পাহাড়ে দুইভাবে ওঠা যায়। একটি হলো পিচ করা রাস্তা যেটি দিয়ে গাড়ি চলাচল করা যায়। অন্যটি হলো সিঁড়ি। যেকোনো পথেই পাহাড়টিতে ওঠা যায়। সকাল-বিকাল অনেকেই এখানে স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে হাঁটতে আসেন। পাহাড়ের ওঠার রাস্তার দু’পাশে রয়েছে অনেকগুলো গাছ।

গণপূর্ত অধিদপ্তরের তথ্য অনুসারে, প্রায় ৫০ প্রজাতির ১৪ হাজার গাছ রয়েছে এখানে। এরমধ্যে ৬ হাজারটি জলপাই গাছ, ৪ হাজারটি কাঁঠাল গাছ, ১০০০টি দেশী নিম গাছ, ৩০০টি কালোজাম, ১০৬টি সুপারি গাছ, ১০০টি নারিকেল গাছ, ৩০টি ঢেওয়া গাছ, ৭০টি পেয়ারা গাছ, ১০টি জামরুল গাছ, ৩০টি বেল গাছ, ৮টি লিচু গাছ, ১০টি কমলা গাছ, ৮টি আমগাছ, ৫টি আতা গাছ, ৭০টি লটকন গাছ, ২০টি চা পাতা গাছ, ৫টি কফি গাছ, ২টি জাফরান গাছ, ৩টি আগরবাতি গাছ, ৩টি লোহাকাঠ, ৩টি চন্দন গাছ, ৩০০টি বাইরা বাঁশ, ৫০০টি মুলী বাঁশ, ৫টি সোনালী গাছ, ৫০টি হরিতকী, ৫০ বহেড়া, ১০০টি আমলকি ও ১০০টি অর্জুন গাছের তথ্য পাওয়া যায় বাটালি হিলে থাকা একটি ফলকে।

সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, গাছের নিচে বিছিয়ে থাকা শুকনো পাতাগুলো অনেকটা গালিচার মতো লাগে। শহরের প্রাণকেন্দ্রে হলেও যান্ত্রিকতার ছোঁয়া যেন লাগেনি এই পাহাড়ে। শত বছরের নির্জনতাকে যেন গভীর যত্নে লালন করে চলেছে পাহাড়টি। গাছপালায় ভরপুর এই পথে হাঁটতে গেলে ক্লান্ত হওয়ার সুযোগ নেই। গাছের ছায়া এবং মনোরম হাওয়ায় সাচ্ছন্দ্যে হাঁটা যায়। কিছুদূর এগোলে প্যাঁচানো রাস্তা, এর নাম জিলাপি পাহাড় হওয়ার কারণ বাতলে দেয়। আরো খানিকটা উপরে উঠলে খাড়া পাহাড়ের খাদগুলো দেখে শহরের সবচে উঁচুতে উঠার অনুভূতি হবে। গাছপালায় বসত গড়েছে বহু প্রজাতির পাখি। তাদের কলকাকলিতে পুরোটা সময় মুখরিত থাকে। অনেকটা উঠার পর রাস্তার দু’ধারে থাকা বেঞ্চিতে চাইলে খানিকটা জিরিয়েও নেওয়া যায়। আরো কিছুদূর পর দেখা মিলবে অতিরিক্ত পুলিশ সুপারের কার্যালয়। তারপর রয়েছে ডিআইজির বাংলো। সেইখানে রাস্তাটা দুভাগ হয়ে একটি চলে গেছে সোজা পাহাড়ের চূড়ার দিকে। সেটি ধরে এগোলে সামনে পড়বে গণপূর্ত অফিসার্স বাংলো। আরেকটু এগুলোই কাক্সিক্ষত পাহাড়-চূড়া। যার নামকরণ করা হয়েছে ‘শতায়ু অঙ্গন’। বহুবছর টিকে থাকার কারণে এই নামকরণ কিনা জানা যায়নি। তবে নামের সাথে জুড়ে দেওয়া হয়েছে ‘নির্মল আকাশ, আনন্দ ও ভোরের বিশুদ্ধ বায়ু; তা নিয়ে হোক সকলের সুস্থ জীবন ও দীর্ঘ আয়ু।’

বাটালি হিলে এলে যেকোনো বয়সী মানুষেরই হৃদয় জুড়িয়ে যায় বলে মন্তব্য করেছেন বিকেলে হাঁটতে আসা মো ইসমাইল। তিনি বলেন, ‘নিজের শহরটাকে একনজরে দেখা এবং গাছের ছায়ায় বেদিতে বসে তার সৌন্দর্য উপভোগ করার সবচে উত্তম জায়গা বোধহয় এই বাটালি হিল। পরিবার-পরিজন বন্ধু-বান্ধব নিয়ে এখানে ঘুরতে আসি। হাঁটাহাঁটির পাশাপাশি শান্ত ¯িœগ্ধ নির্জন পরিবেশটা খুব উপভোগ করি।’

সেলিনা হোসেন নামের এক মধ্যবয়সী নারী চূড়ায় উঠে জিরিয়ে নিচ্ছিলেন শতায়ু অঙ্গনে। তিনি সুপ্রভাতকে বলেন, ‘আমার বাসা কাছেই। আমি প্রায় এখানে আসি। ডায়াবেটিক থাকার কারণে ডাক্তার হাঁটতে বলেছেন। শহরে যানবাহনের শোরগোল ভরা রাস্তার ফুটপাতে হাঁটা বেশ অসুবিধা, তাই এখানে চলে আসি। বেশ নিরিবিলিতে এখানে হাঁটা যায়। পরিবেশটা সুন্দর হওয়ায় এখানে হাঁটতে খারাপ লাগে না।’