নানা সংকটে বিভাগীয় পুলিশ হাসপাতাল

ওষুধ নেই তিন মাস ধরে

মোহাম্মদ রফিক
প্রায় তিনমাস ধরে চট্টগ্রাম বিভাগীয় পুলিশ হাসপাতালে ওষুধ নেই। ফলে নগর পুলিশের সাত হাজার সদস্য এবং তাদের পরিবার চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
হাসপাতালটির তত্ত্বাবধায়ক ডা. আহমদ রসুল জানিয়েছেন, একসময় ওষুধ সরবরাহ করত সিএমপি। গত জুলাই থেকে পুলিশ সদর দপ্তর থেকে ওষুধ সরবরাহ করার কথা। কিন্তু সেসময় থেকে কোনো ওষুধ সরবরাহ দিচ্ছে না সদর দপ্তর। ফলে পুলিশ ও তাদের পরিবার যথাযথ চিকিৎসাসেবা পাচ্ছেন না।
এ বিষয়ে সিএমপি কমিশনার সালেহ মোহাম্মদ তানভীর জানান, জুলাই মাস নতুন অর্থবছর। ওষুধের জন্য কর্তৃপক্ষ বরাদ্দ দিলেও করোনা পরিস্থিতিসহ নানা কারণে তা পেতে কিছুটা সময় নিচ্ছে। এটা তো রুটিন ওয়ার্ক। আমরা ইতিমধ্যে চট্টগ্রাম বিভাগীয় পুলিশ হাসপাতালের জন্য ওষুধ ক্রয়ের টেন্ডার আহ্বান করেছি। ওষুধ কিনতে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে ওয়ার্ক অর্ডারও দিয়েছি।’
সিএমপি জানায়, নগরের দামপাড়া পুলিশ লাইনে অবস্থিত চট্টগ্রাম বিভাগীয় পুলিশ হাসপাতালে প্রতিমাসে ৩৫-৪০ লাখ টাকার ওষুধের চাহিদা রয়েছে। বছরে ওষুধ লাগে সাড়ে চার কোটি টাকার। গত জুন মাসে সদর দপ্তরের নির্দেশে হাসপাতালটির জন্য ওষুধ কেনা বন্ধ করে দেয় সিএমপি। জুলাই মাস থেকে সদর দপ্তর ওষুধ সরবরাহ দেয়ার কথা থাকলেও তা মিলছে না। হাসপাতালে ওষুধ না থাকায় রোগশোকে আক্রান্ত পুলিশ সদস্য কিংবা তাদের পরিবারের সদস্য সেখানে ভর্তি হচ্ছেন না। যারা ভর্তি আছেন তারা নিজেদের টাকা দিয়ে বাইরের ওষুধ কিনে খাচ্ছেন। এক্ষেত্রে তারা আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন।
সিএমপির একটি সূত্র জানায়, পুলিশ ও তাদের পরিবারের অনেক সদস্যই চট্টগ্রাম শহরের অন্য হাসপাতালে জটিল রোগের জন্য চিকিৎসা শেষে এ হাসপাতালে ভর্তি হন বিশ্রামে থাকার জন্য। এর মূল কারণ হাসপাতালটিতে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক এবং জনবলের অভাব। গতকাল হাসপাতাল ঘুরে বিভিন্ন কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ছোটখাট অস্ত্রোপচার করা সম্ভব হলেও এ হাসপাতালে জটিল কোনো অস্ত্রোপচার হয় না। একইভাবে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্যও রোগীদের ছুটতে হয় অন্য হাসপাতালে। হাসপাতালটিতে আছে চিকিৎসক সংকট। ১৬ জনের জায়গায় রয়েছেন ৮ চিকিৎসক।
জানা গেছে, এ হাসপাতালটিতে ওষুধ সংকট ছাড়াও রয়েছে নানা সংকট। এক্সরে মেশিন আছে, তবে সেটি ডিজিটাল নয়। আলট্রাসনোগ্রাম মেশিন আছে, টেকনেশিয়ান নেই। দশটি ওয়ার্ডর মধ্যে চালুৃ আছে শুধু জেনারেল ওয়ার্ড। জনবল সংকটের পাশপাশি আছে আধুনিক যন্ত্রপাতি ও অবকাঠামো সংকট। একদিকে ওষুধ সংকট অপরদিকে মিলছে না মানসম্মত চিকিৎসা সেবা। নাম প্রকাশ না করে চট্টগ্রাম বিভাগীয় পুলিশ এক কর্মকর্তা জানান, এ হাসপাতালে রক্তের গ্রুপ নির্ণয় ও ডায়েবেটিস ছাড়া অন্য কোনো রোগের পরীক্ষা হয় না। জটিল রোগের পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য নেই আধুনিক যন্ত্রপাতি।
একশ’ শয্যার এ হাসপাতালে নেই এমআরআই, সিটি স্ক্যান মেশিন। আলট্রাসনোগ্রাম মেশিন থাকলেও টেকনেশিয়ান নেই। ডিজিটাল এক্সরে মেশিন না থাকায় দুর্ঘটনায় আহত রোগীর এক্সরে সঠিকভাবে নিরূপণ করা যাচ্ছে না। এ হাসপাতালে হয় না দুরারোগ্য রোগের চিকিৎসা। হাসপাতালের এক চিকিৎসক জানান, প্রেষণে চিকিৎসক দিয়ে কোনো রকমে চলছে চিকিৎসা সেবা।
সিএমপির তথ্যানুযায়ী, বর্তমানে পুলিশ সদস্যদের মধ্যে পেপটিক আলসার, শ্বাসকষ্ট, কিডনি রোগ, ডায়াবেটিস ও হৃদরোগীর সংখ্যাই বেশি। এরসঙ্গে যোগ হয়েছে করোনাভাইরাস।
এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে জানান, পুলিশ হাসপাতালে দশটি ওয়ার্ড থাকলেও চালু আছে শুধু সাধারণ ওয়ার্ড। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক না থাকায় অন্য ওয়ার্ডগুলো চালু করা যাচ্ছে না। প্রায় তিনমাস ধরে নেই ওষুধ। আউটডোরে প্রতিদিন দুই-আড়াইশ রোগী দেখা হতো। এখন প্রায় শূন্যের কোটায়। ওষুধ নেই, রোগীও ভর্তি হচ্ছে না। ১০০ শয্যার এ হাসপাতালে দরকার ২০-২২ জন চিকিৎসক।
সিএমপির আরেক কর্মকর্তা জানান, এখানে প্রেষণে চিকিৎসক এলেও তারা থাকতে চান না। এ হাসপাতালে সরকার সরাসরি চিকিৎসক নিয়োগ দিলে সমস্যা মিটবে। জানা যায়, ক্যানসারসহ বিভিন্ন জটিল রোগে আক্রান্ত রোগীরা বাইরে থেকে চিকিৎসা নিয়ে পুলিশ হাসপাতালে ভর্তি হন নিয়মিত ওষুধ খাওয়ার জন্য কিংবা বিশ্রাম নেওয়ার জন্য। জটিল রোগীদের জন্য আইসিইউ, সিসিইউয়ের কোনো ব্যবস্থা নেই।
প্রসঙ্গত, পুলিশ সদস্যদের স্বাস্থ্যসেবার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে ১৯১৫ সালে ব্রিটিশ আমলে নগরের দামপাড়া পুলিশ লাইনে স্থাপন করা হয়েছিল এ হাসপাতাল। তখন সেটি গড়ে তোলা হয়েছিল ৪০ শয্যার জেলা পুলিশ হাসপাতাল হিসেবে। ২০০৪ সালে ১০০ শয্যাবিশিষ্ট চট্টগ্রাম বিভাগীয় পুলিশ হাসপাতাল হিসেবে উন্নীত করা হয়। এটি উদ্বোধন করেছিলেন তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ নেতা মো. নাসিম।