নাগকেশরী লীলাবতী

আরিফুল হাসান »

পথ চলতে চলতে হঠাৎ থেমে গেলে পথ আমাদের ভেংচি কাটে। বলে, কোন সে পাহাড়িয়া সাপুড়ে, বীণের তালে তালে পথ ভুলে যায়? আমরা আবার দাঁড়াই, আবার চলতে শুরু করি। আমাদের ঝুড়ির ভেতর সাপগুলো কু-লি পাকিয়ে ঘুমায়। আমাদের পায়ের তলার মাটি আবার ঝুরঝুর করে ভাঙতে থাকে। ধুলা ওড়ে হাঁটুঅব্দি ওঠানো পা শাদা হয়ে যায়। আমাদের নাগকেশরকন্যা লীলাবতী হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয়।
একটা গাছতলা দেখে আমরা বসে পড়ি।
আরে খেলা দেখো, খেলা দেখো, সাপের খেলা দেখো। দুধরাজ আর পঙ্খিরাজ কেমন নাচে দেখো। কালনাগে কেটে ছিলো রাজার কুমার। বনবাসে গেল রাজা কিবা সমাচার। আরে, সুতানালি সাপ একখান লখিন্দররে খায়। গোখরা হইলো কাল ভয়ানক, সবার ঘরে যায়।Ñ আমাদের সর্দারের গলা চড়ে।
হাট থেকে ফিরতে বা হাটে যেতে লোকজন একটু থেমে ভিড় বাড়ায়। চারপাশে বৃত্তাকৃতির ভিড় জমে উঠলে আমরা আমাদের সাপের ঝুড়ি খুলতে থাকি। নিমীলিত চোখে তখন নাগকেশরীকন্যা লীলাবতী গাছের গুঁড়ি থেকে ওঠে বসে। চুলগুলো পেছনে খোঁপা করে বাঁধে। কাঁধের ঝোলা থেকে মস্ত একটা লাল প্লাস্টিকের জবাফুল গুঁজে দেয় খোঁপায়। আমরা চোখ ফেরাতে পারি না। চোখ ফেরাতে পারে না হাটুরে মানুষগুলোও। সবাই তখন নাগকেশরীকন্যা লীলাবতীর মুখের দিকে চায়। সে কখন নেচে উঠবে, সে ভাবনায় মনে মনে অস্থির হয়ে ওঠে। লীলাবতী এত সহজে নাচে না। ওস্তাদের সাপখেলা চলতে থাকে। লীলাবতী সামান্য নড়েচড়ে এ বাক্সে ও বাক্সে হাত বুলায়। সর্দারের তালে তালে তাল মিলিয়ে আমরাও গেয়ে উঠিÑ আরে খেলা দেখো, খেলা দেখো, সাপের খেলা দেখো। দুধরাজ আর পঙ্খিরাজ কেমন নাচে দেখো …।
সর্দারের তিনকন্যা। বড়টি স্বামীর সাথে পাহাড়ে জুমচাষ করে। আরেকটি ভাসমান, লোকে বলে পতিতা। হ্যাঁ, আমরাও ভাসমান। উজানগর নদীর পাড়ে তাঁবু বানিয়ে থাকি। কিন্তু সর্দারের দ্বিতীয় মেয়ের মতো কুলমান ত্যাগ করে একেবারে প্রকাশ্যে নষ্ট হয়ে যাইনি। আমাদের বেদে সম্প্রদায়ের অনেকেই জীবনের জন্য জীবনকে বিলিয়ে দেয়। আমরা ক’জন, যারা ঐতিহ্য চিবিয়ে খেয়ে দিন দিন শুকনো সোঁতায় মিশে যাচ্ছি, তবু আমরা নষ্ট হইনি। সর্দারের খুব চিন্তা ছোটো মেয়েকে নিয়ে। লীলাবতী তার অন্য দুই বোনের মতো নয়। একেবারে বাপের ছায়াছবি। পিতার সংসারে যে কোনো ছেলেসন্তান নেই এবং বৃদ্ধ পিতাকে যে তারই দেখতে হবে, এ কথা সে ভালোভাবেই বুঝে। তাই রাত পোহালেই আমাদেরকে তাড়া দেয়, চলো চলো, সাপের খেলা দেখাইয়া আসি চলো। আমরা ঘুমজড়ানো চোখে আড়মোড়া ভেঙে নদীর পানিতে হাতমুখ ধুই। দুতিন কোয়াল মুড়ি আর রসুন মুখে দিয়ে সাপের ঝুড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ি। পথে পথে আমাদের ভাগ্য লিপিবদ্ধ হয়। কখনো হয় না। নির্ণীত বাস্তবতার ওপর আমাদের চুপ থাকতে হয়।
দরিরামপুর বাজার অনেক বড় বাজার। লোকে লোকারণ্য হয়ে যায়। হাট থেকে ফিরতি পথে বাজারের ব্যাগ হাতে দাঁড়িয়েছে তিরিশ-বিশজন মানুষ। আরও কিছু ছেলেখোকা উৎসাহী চোখ নিয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। মাথায় বোঝা নিয়ে কিছু হাটগামী মানুষও দাঁড়িয়েছে। তারা বেশিক্ষণ থাকবে না। তাই সর্দার তাবিজ বিক্রির কাজটি আগেই করতে চায়। বলেÑ সাপের খেলা পরে হইবো। আগে সবাই এই একখানা তাবিজ হাতের মুঠির মধ্যে ধরেন। সাপ কখনো কখনো আমাদের কথাও শুনে না। তখন যেনো রামকু-লি পার হয়ে আপনাদেরকে ছোবল না মারে, এ জন্য এই তাবিজ ধারণ করতে হবে। আমরা সিলভারের কৌটা থেকে কাগজে মুড়ানো লজ্জাবতী গাছের শেকড় সবার হাতে হাতে দেই। কেউ হাত গুটিয়ে চলে যায়। দুএকজন হাঁটগামী মানুষ আমাদের উদ্দেশে ভ-, কপট ইত্যাদি গালি ছুড়তে ছুড়তে বেরিয়ে যায়। একপাশে ক’জন তরুণ হল্লা শুরু করে। এসব ভ-ামি বাদ দেন। আগে আমরা লীলাবতীর নাচ দেখতে চাই। সর্দার মাথা নিচু করে রাখে। নিজের মেয়ের রূপ দেখিয়ে সে ব্যবসা করে ঠিকই। কিন্তু নিজের মেয়েকে কেউ প্রকাশ্যে পণ্যরূপে দেখলে তার মনে লাগে। আমরা লোকজনদের শান্ত করার চেষ্টা করি। বলি, নাগকেশরী লীলাবতী তখনই নাচবে যখন সাপের নৃত্য শুরু হবে। Ñতাইলে শুরু করেন। দু’জন যুবক উগ্রভাবে বলে। আমি তাদের কাছে যাই। মেজাজ শান্ত রাখার চেষ্টা করি। বলিÑ করজোড় মশাই। তাবিজ ধারণ ছাড়া সাপের ঝাঁপি খোলা যাবে না। তারা আমার কথা উড়িয়ে দেয়। বলে, এসব তোমাদের ধান্ধাবাজি। এসব বাদ দিয়ে ওই মালটারে নাচতে বলো। তারা শিশ বাজায়। আমার কানের ভেতর গরম আগুনের ধোঁয়া উড়তে থাকে। আগুন আরো বাড়ায় আরেকজন যুবক। বলে, একরাতে কত দিতে হয় মাইয়াডারে। আমার মগজে তখন আগ্নেয়গিরির দাউদাউ শিখা। হাতের মুঠিটাকে শক্ত করে আবার শীতল করে আনলাম। এ রকম আমাদের প্রায়ই শুনতে হয়। কিন্তু ওস্তাদের বারণ আছে, মানুষের সাথে লাগতে যাওয়া যাবে না। আমরা ভাসমান, কে আমাদের পক্ষে বলবে? তাই নিজেকে সংযত করলাম। গোলমাল দেখে ওস্তাদ বীণ হাতে নিয়ে গলা চড়ায়। যুবকদের হল্লা থেকে আবার আওয়াজ আসে, মালটারে বাজাইতে কন। Ñহ, হ। এইবার আরো প্রৌঢ় পুরুষও তাল মেলায়। ওস্তাদ হাত তুলে সবাইকে শান্ত করার চেষ্টা করেন। কিন্তু ততক্ষণে উঠতি যুবকের দলটি মাত্রা ছাড়িয়ে যায়। তারা পথে পড়ে থাকা ইটের আধলি তুলে ছুড়ে মারতে থাকে আমাদের দিকে। একটা তীক্ষè ইটের টুকরো লীলাবতীর মাথায় এসে লাগে।
মাথায় ব্যান্ডেজ নিয়ে লীলাবতী এই রাতের বেলায় ওঠে এসেছে।
Ñকিরে, পরান! ঘুমাস নাই?
Ñনা, ঘুম তো আসেনা রে। তুই কেনে আইছিস?
Ñআমার ভাল্লাগিছে না। জানস পরান, মনে হয়, বড় বুজিই ভালাআছে। বরের সেথে পাহাড়ে জুমচাষ করে। পথে পথে মানুষের চোখের ছুরিতে ফানা ফানা হইতে হয় না।
Ñতুইও পাহাড়ি কাউকে বিয়ে করিসনে কেনে? জুমচাষ করতি পারবি। দিন শেষে কাঠের ঘরত গিয়ে স্বামীর সোহাগে ঘুমাইতি পারবি।
Ñযাহ, তোরে কইছে! আমার পাহাড়ি স্বামী লাগবিনে। আমার তো তুই আছিস।
Ñআরে, আমি তো তোরে নিরাপত্তা দিতে পারিনে। এই দেখ না, আইজ কেমন অঘটনটা ঘটলো।
মাথার ব্যান্ডেজটাতে হাত বুলায় লীলাবতী। বলেÑ থাক, বাদ দে ওসব কথা। বাবার সাথে বিয়ার কথা কবে কইবি? আমি চুপ করে থাকি। নদীর পাড়ে তারাভরা আকাশের পানে চেয়ে একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলি। রাতের জ্যোৎ¯œা তখন কেমন যেনো ধোঁয়াশারঙে ঢেকে যায়। লীলাবতী আরও কাছে ঘন হয়ে আসে। আমার মাথার চুলে হাত বুলাতে বুলাতে বলে, দুঃখ করিস নে। দেখবি, একদিন আমাদের সব দুঃখ চলি যাইবি।