নগরীর সব এলাকায় বিস্তৃত হয়নি পরিকল্পিত আবাসিক ফ্ল্যাট

বিভিন্ন এলাকায় বাড়াতে হবে সুযোগ সুবিধা : নগর পরিকল্পনাবিদ

অপরিকল্পিত নগরায়নের চিত্র। ছবির বামদিকে দৃশ্যমান পূর্ব ও পশ্চিম মাদারবাড়ি এবং ডান দিকে আগ্রাবাদ এলাকা। দূরে কর্ণফুলী নদী। এই এলাকায় বহুতল আবাসিক ফ্ল্যাট গড়ে উঠার সম্ভাবনা থাকলেও অপরিকল্পনা এবং নাগরিক সুযোগ-সুবিধার অভাবে তা হচ্ছে না। ছবিটি তুলেছেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আলোকচিত্রী শোয়েব ফারুকী

ভূঁইয়া নজরুল »
মহানগরীতে ৩০ বছরেও হয়নি আবাসন ফ্ল্যাটের বিস্তৃতি। নগরে আবাসন ফ্ল্যাট প্রকল্প সর্বপ্রথম চালু হয় ১৯৯২ সালে। ষোলশহর সিঅ্যান্ডবি কলোনি এলাকায় আইডিয়াল হোম ডেভেলপমেন্ট ‘আপন নিবাস’ নামে আবাসন প্রকল্প চালু করেছিল। সেই শুরুর পর নাসিরাবাদ হাউজিং সোসাইটি, খুলশী, পাঁচলাইশ, চকবাজার, মেহেদীবাগ, জামালখান, নন্দনকানন ও কোতোয়ালী এলাকায় ব্যাপক হারে ফ্ল্যাট তৈরি হলেও অন্যান্য এলাকায় তেমনভাবে ডেভেলপার কোম্পানিগুলো ফ্ল্যাট নির্মাণে আগ্রহী নয়।
ফ্ল্যাটগুলো এমন এককেন্দ্রিক হয়ে ওঠার কারণ কি? এ ব্যাপারে এপিক প্রপার্টিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও রিহ্যাব চট্টগ্রাম চ্যাপ্টারের সাবেক সভাপতি এস এম আবু সুফিয়ান বলেন, ‘এখনো চট্টগ্রাম শহর মানেই খুলশী, নাসিরাবাদ, মেহেদীবাগ, পাঁচলাইশ, জামালখান, চকবাজার ও নন্দনকানন এলাকা। এসব এলাকার বাইরে মানুষ ফ্ল্যাট কিনতে চায় না। আর ক্রেতারা যেসব এলাকায় থাকতে চাইবে ডেভেলপাররাও সেসব এলাকায় ফ্ল্যাট নির্মাণ করবে। এটাই স্বাভাবিক।’
তিনি আরো বলেন, ‘আমরা কালামিয়া বাজার মোড়ে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের পাশে একটি প্রকল্প নিয়েছিলাম। ইতিমধ্যে প্রকল্প শেষ হলেও মানুষ সেখানে ফ্ল্যাট কিনতে আগ্রহী নয় এবং এখনো অনেক ফ্ল্যাট খালি রয়েছে।’
রিহ্যাবের সাবেক সভাপতির সঙ্গে একমত পোষণ করে রিহ্যাবের বর্তমান সভাপতি ও এয়ারবেল ডেভেলপমেন্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুল কৈয়ূম চৌধুরী বলেন, ‘একটি ফ্ল্যাট কিনতে মানুষ আশপাশের পরিবেশ ও যোগাযোগ ব্যবস্থাকে প্রাধান্য দেয়। একইসাথে যেসব এলাকায় স্কুল-কলেজ বেশি থাকে সেসব এলাকা নিয়ে আগ্রহ বেশি থাকে। এ কারণে গত ৩০ বছরেও নতুন নতুন এলাকায় বাণিজ্যিক ফ্ল্যাট নির্মাণ প্রসারিত হয়নি ।’
নগরে অভিজাত ফ্ল্যাট নির্মাণে জুমাইরা হোল্ডিংস অন্যতম। খুলশী, ওআর নিজাম রোড, পাঁচলাইশ হাউজিং সোসাইটি এলাকায় সবচেয়ে বেশি ফ্ল্যাট নির্মাণ করেছে জুমাইরা। কিন্তু এর বাইরে অন্য এলাকায় কেন নির্মাণ করেনি জানতে চাইলে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ শাহজাহান বলেন, ‘অন্য এলাকায় ফ্ল্যাট নির্মাণ করা হলে তা ব্যবসা সফল হবে না। প্রকল্পের একটি ফ্ল্যাটও যদি অবিক্রিত থেকে যায় তাহলে পুরো প্রকল্পে লোকসান গুনতে হবে। অন্য এলাকায় ডিমান্ড নেই।’
এদিকে বর্তমানে জাকির হোসেন রোডের নাসিরাবাদ প্রপার্টিজ, পলিটেকনিকে এয়াকুব ফিউচার পার্ক এলাকায় অনেক ডেভেলপার ফ্ল্যাট নির্মাণে প্রকল্প নিয়েছে। মূলত খুলশী এলাকার ফ্লেভার দিতেই নাসিরাবাদ প্রপার্টিজের পাহাড়ি এলাকায় গিয়েছে ডেভেলপাররা।
নগরীর জামালখান এলাকায় সবচেয়ে বেশি ফ্ল্যাট নির্মাণ করছে সিপিডিএল। এ প্রতিষ্ঠানটিও জামালখানের বাইরে অন্য এলাকায় ফ্ল্যাট প্রকল্পে উৎসাহিত হচ্ছে না।
নগরীর অন্যান্য এলাকায় ফ্ল্যাট প্রকল্প নিতে ডেভেলপারদের অনীহা প্রসঙ্গে স্যানমার প্রপার্টিজের হেড অব অপারেশন এ কে এম আহসানুল বারী বলেন, ‘এটি একটি ব্যবসা। এখানে ক্রেতাদের চাহিদা কোথায়, অবশ্যই তা বিবেচনায় আনতে হবে। একইসাথে বিনিয়োগের টাকা যাতে ঝুঁকিতে না পরে তাও ভাবতে হবে। আর সে কারণেই যেখানে চাহিদা কম সেখানে প্রকল্পও কম।’

নগর পরিকল্পনাবিদদের বক্তব্য

চট্টগ্রাম নগরীর বিশদ উন্নয়ন পরিকল্পনা করে থাকে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)। পুরো শহরে উন্নয়ন ও সুযোগ-সুবিধার অসমতা প্রসঙ্গে সংস্থাটির প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ শাহীনুল ইসলাম খান বলেন, ‘ডেভেলপাররা সবসময় প্রফিটবেইজ প্রকল্প নিয়ে থাকে। তাই যেখানে তারা বেশি লাভ করতে পারবে সেখানে প্রকল্প নেয়। কিন্তু নগরীর অন্যান্য এলাকায় মধ্যম আয়ের মানুষদের জন্য চাইলে প্রকল্প নেয়া যায়।’
নাগরিক সুযোগ-সুবিধা তো বড় একটি ফ্যাক্টর। এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলো তিনি বলেন, এজন্য আমাদের মতো সরকারি সংস্থাগুলো হালিশহর, পতেঙ্গা বা বাকলিয়া এলাকাগুলোতে হাসপাতাল, স্কুল, শপিংমলসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করে দিতে হবে। একইসাথে সিডিএকে ওইসব এলাকায় প্লট বা ফ্ল্যাট প্রকল্প গ্রহণ করে অন্যদের উৎসাহিত করতে হবে।
শাহীনুল ইসলাম খানের বক্তব্যের সাথে একমত পোষণ করে বিশিষ্ট নগর পরিকল্পনাবিদ স্থপতি আশিক ইমরান বলেন, ‘মানুষের চাহিদা ও নাগরিক সুযোগ-সুবিধা অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে। আর তা করা না গেলে মানুষ টাকা দিয়ে ওইসব এলাকায় কেন ফ্ল্যাট কিনতে যাবে? আবার সেখানে বিনিয়োগ করে ডেভেলপাররা কেন ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। এক্ষেত্রে সরকারের সংস্থাগুলোর উচিত বিভিন্ন পলিসির মাধ্যমে ওইসব এলাকায় নাগরিক সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধি করা।
উল্লেখ্য, প্রায় ৬০ বর্গমাইলের চট্টগ্রামে একসময় চট্টগ্রামে ১০২টি ডেভেলপার প্রতিষ্ঠান রিহ্যাবের (রিয়েল এস্টেট হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ) নিবন্ধিত থাকলেও এখন তা কমে ৮২ তে নেমে এসেছে। এসব ডেভেলপার নগরবাসীকে আবাসন সুবিধা দিতে কাজ করছে। কিন্তু নির্ধারিত কিছু এলাকার বাইরে গিয়ে তারা প্রকল্প নিচ্ছে না। একসময় আগ্রাবাদ সিডিএ আবাসিক এলাকা ও হালিশহর কে ও এল ব্লকে অনেকে প্রকল্প নিলেও জলাবদ্ধতার কারণে ওই এলাকা থেকেও অনেকে সরে এসেছে। এছাড়া নগরের বিভিন্ন এলাকায় বিক্ষিপ্তভাবে গড়ে উঠেছে অনেক অপরিকল্পিত ফ্ল্যাট।