ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে কলকাতা মডেল

মশা এখন এক আতঙ্কের নাম। এই ভীতির কারণ এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গু ভাইরাস। ডেঙ্গু জ্বরের বাহক এডিস মশার ঘনত্ব, প্রজননস্থল এবং ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা-সব বিবেচনাতেই এ বছরে ডেঙ্গু ভয়ানক রূপ নেওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
সুপ্রভাতের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, চট্টগ্রামে গত শনিবার (২২ জুলাই) ২৪ ঘণ্টায় ১৪৩ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন। যা চলতি বছরের একদিনে সর্বোচ্চ আক্রান্ত। নতুন করে আরও একজনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে চট্টগ্রামে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মোট ২২ জনের মৃত্যু হয়েছে। জুলাই মাসে ডেঙ্গুর প্রকোপ ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে। শনাক্ত বাড়ার সাথে সাথে মৃত্যুও বেড়েছে চলতি মাসে। কোনভাবেই আমরা ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করতে পারছিনা।
কলকাতায় ডেঙ্গুর ইতিহাস প্রায় সাত দশকের পুরোনো। প্রায় একই সময়ে আমাদের দেশেও ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব শুরু হয়। তবে ডেঙ্গু ভীতি কলকাতা এখন অনেকটাই কাটিয়ে উঠেছে। কীভাবে তারা ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করেছে, সেটাই এখন জনস্বাস্থ্যবিদদের আগ্রহের বিষয়।
কলকাতায় ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে তিন স্তরের পরিকাঠামো গড়ে তোলা হয়েছে। ২০১০ সালের দিকে এসব কাজের শুরু হয়। এ ছাড়া ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে গবেষণাগার গড়ে তোলা হয়। ডেঙ্গুর চরিত্র বোঝার জন্য ২০১১ সালে মাত্র চার লাখ টাকায় সেই গবেষণাগার তৈরি করা হয়েছিল। গবেষণাগারে কেবল দেখা হতো, লার্ভা থেকে কীভাবে মশা বেড়ে উঠছে। মশককর্মীদেরও এটা দেখানো হতো। তিন হাজার মাঠকর্মীকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল। চোখের সামনে তাঁদের মশার চরিত্র দেখানো হয়েছিল।
কলকাতা মিউনিসিপ্যাল করপোরেশনে প্রতিটি ওয়ার্ডে একটি করে মশা নিয়ন্ত্রণ কমিটি আছে। এতে ওয়ার্ড কাউন্সিলর, চিকিৎসক ও স্থানীয় ব্যক্তিরা আছেন। আছেন ৬ থেকে ১৫ জন মশককর্মী। প্রত্যেক কর্মীর মশা নিয়ন্ত্রণের প্রশিক্ষণ আছে। এসব ওয়ার্ড কমিটির কাছে এলাকার সম্ভাব্য ডেঙ্গুর উৎসস্থলের তালিকা আছে। কোলকাতায় প্রতিবছর ১০০ দিনের কর্মসূচি আছে। এসব কর্মসূচিতে যুক্ত ব্যক্তিরা ওয়ার্ড পর্যায়ে মশককর্মী হিসেবে কাজ করেন। জানুয়ারি থেকে জুন-এই ছয় মাসে তাঁরা সার্বক্ষণিক নজরদারি করেন। জুলাইয়ে মশার প্রাদুর্ভাবের মৌসুমে নজরদারি আরও বেড়ে যায়।
মশা নিয়ন্ত্রণ কমিটির পাশাপাশি প্রতি ওয়ার্ডে আছে স্বাস্থ্যকেন্দ্র। এসব কেন্দ্রে শুধু ডেঙ্গু রোগের চিকিৎসায় চিকিৎসক আছেন। পরীক্ষায় কারও ডেঙ্গু ধরা পড়লে সেই তথ্য নির্দিষ্ট ওয়ার্ড কাউন্সিলর, ডেপুটি মেয়র, সিটির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ও প্রধান ভেক্টর কন্ট্রোল কর্মকর্তার মুঠোফোনে চলে যায়।
ওয়ার্ডের কোন কোন বাড়িতে চৌবাচ্চা, কুয়া বা ডোবা আছে-তার হিসাব ওয়ার্ড কার্যালয়ে আছে। এসব বাড়ির কোনটিতে কবে এডিসের লার্ভা মিলেছিল, তারও একটি তথ্যভা-ার আছে। তিনি বলেন, কারও ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার তথ্য পাওয়া গেলেই ওয়ার্ডের মশা নিয়ন্ত্রণ কমিটির মাঠকর্মীরা ওই বাড়ি ও আশপাশের ৫০টি বাড়িতে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করেন। কোথাও লার্ভা পাওয়া গেলে সেখানে লার্ভানাশক দেওয়া হয়। এভাবেই উৎসে মশা নিধন করা হয়।
ওয়ার্ড কমিটির ওপর আছে আরো বেশ কয়েকটি কমিটি। এখানেও একটি মশা নিয়ন্ত্রণ কমিটি আছে। এই কমিটিতে একজন কীট নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা ও চিকিৎসক আছেন। প্রতিটি বরোতে দুটি করে র‌্যাপিড অ্যাকশন টিম আছে। তাদের একটি করে গাড়ি আছে। তারা শিক্ষাকেন্দ্র, সরকারি অফিস, বিপণিবিতান, থানা, বেসরকারি বড় স্থাপনাসহ নানা স্থানে নজরদারি করে। তারা কোথাও মশার সম্ভাব্য প্রজননস্থল বা নোংরা-আবর্জনা পেলে প্রথমে মালিক বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জানায়। জায়গাটি তারা পরিষ্কার করে দেয়। কেউ লার্ভা পাওয়ার স্থানের দায় না নিলে জমির দলিল দেখে মালিকানা চিহ্নিত করা হয়। এরপর আবর্জনা পরিষ্কারের খরচ তাঁর আয়কর নথির সঙ্গে যুক্ত করে দেওয়া হয়। আয়কর দিতে গেলে তখন তাঁকে জরিমানার অর্থও পরিশোধ করতে হয়।
নির্মাণাধীন ভবন মশার, বিশেষ করে এডিস মশার বড় আশ্রয়স্থল। কেউ ভবন নির্মাণ করতে গেলেই মশা নিয়ন্ত্রণ কমিটির পক্ষ থেকে তাঁদের একটি নির্দেশিকা ধরিয়ে দেওয়া হয়। সেখানে নির্মাণাধীন ভবন কীভাবে মশামুক্ত রাখা যাবে, তার নির্দেশনা থাকে। এসব ভবন হঠাৎ পরিদর্শনে যান র‌্যাপিড অ্যাকশন টিমের সদস্যরা। প্রথম দফায় লার্ভা পেলে জরিমানা করা হয় না। পরে পাওয়া গেলে এক লাখ রুপি জরিমানা করা হয়।
কলকাতা রোগী ধরে ধরে নজরদারি করতে পেরেছে। যখনই কোনো রোগী পেয়েছে, তাঁর আবাসস্থল এবং কাছাকাছি এলাকায় মশকনিধন করেছে। আমাদের এখানে এটি সেভাবে হয়নি। তারা এক দিনে এ সমস্যার সমাধান করেনি। দীর্ঘ প্রচেষ্টার মাধ্যমে সফলতা পেয়েছে।
এডিস মশার বিস্তার রোধ ও ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে কলকাতা সাফল্য পেয়েছে। এ কাজে তারা যেভাবে মানুষকে সম্পৃক্ত করেছে, সেটা সবার জন্য শিক্ষণীয়। আমরা এই অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে পারি। ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণ, ওরস্যালাইনের প্রসার, টিকাদানের মতো বিষয়ে বাংলাদেশের সাফল্যের ইতিহাস আছে। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণেও জনগণকে সম্পৃক্ত করা হলে সাফল্য আসবে।