জনদাবির মুখে র‌্যাম্প নির্মাণ আপাতত বন্ধ

টাইগারপাস-সিআরবির জন্য নতুন নকশা প্রণয়ন করবে সিডিএ

চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের সাথে মতবিনিময়ে বক্তব্য রাখেন সমাজবিজ্ঞানী এবং নাগরিক সমাজ চট্টগ্রামের আহ্বায়ক অধ্যাপক ড. অনুপম সেন।

নিজস্ব প্রতিবেদক »

চট্টগ্রামের সর্বস্তরের মানুষের দাবির মুখে নান্দনিক সড়কে গাছ কেটে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে জন্য র‌্যাম্প নির্মাণের কাজ আপাতত বন্ধ রাখার কথা জানিয়েছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (চউক)। ঈদুল ফিতরের পর নগর পরিকল্পনাবিদদের সাথে আলোচনা করে র‌্যাম্প নির্মাণের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার কথা জানিয়েছে সংস্থাটি।

আর আন্দোলনকারীদের পক্ষ থেকে চউককে জানিয়ে দেয়া হয়েছে, টাইগারপাস-সিআরবির অনিন্দ্য সুন্দর সড়কটি নষ্ট করে এবং গাছ কেটে কোনো র‌্যাম্প সেখানে নির্মাণ করতে দেবেন না তারা।

মঙ্গলবার বিকেলে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের সম্মেলন কক্ষে মত বিনিময় সভায় সিডিএ চেয়ারম্যান ও কর্মকর্তারা জানান, র‌্যাম্পের নতুন নকশার প্রস্তাবনা তৈরি শেষে ঈদের পর নাগরিক সমাজের সাথে আলোচনা করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।

চট্টগ্রামের প্রথম এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নামকরণ করা হয়েছে প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর নামে। গত নভেম্বরে এটি প্রধানমন্ত্রী উদ্বোধন করলেও এখনো যানবাহন চলাচল শুরু হয়নি। চলতি মাসের শেষে যান চলাচল শুরুর কথা রয়েছে। প্রায় সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে এই এক্সপ্রেসওয়েতে থাকছে ১৫টি র‌্যাম্প। এই এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে নিউমার্কেট-কদমতলি এলাকা থেকে যেসব যানবহান উঠবে সেগুলোর জন্য টাইগারপাস-সিআরবির ‘আইকনিক’ একটি র‌্যাম্প নির্মাণের প্রস্তাব আছে চউকে এর প্রকল্প পরিকল্পনায়।

বিষয়টি জানার পর সোমবার থেকে আন্দোলনে নামে চট্টগ্রামের একাধিক নাগরিক সংগঠন। এরপর মঙ্গলবার চউক চেয়ারম্যান জহিরুল আলম দোভাষ ও চউক কর্মকর্তাদের সাথে মত বিনিময় সভায় বসেন নাগরিক সমাজ, চট্টগ্রাম এবং সম্মিলিত পরিবেশ রক্ষা আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ।

সভার শুরুতে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামন্ডলীর সদস্য একুশ পদকজয়ী সমাজবিজ্ঞানী এবং নাগরিক সমাজ চট্টগ্রামের আহ্বায়ক অধ্যাপক ড. অনুপম সেন বলেন, সভ্যতার আগ্রাসনে চট্টগ্রামের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সম্ভার নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। উন্নয়ন তো দরকার। কিন্তু পরিবেশ বিঘ্নিত হলে সব উন্নয়নই ব্যর্থ হয়ে যাবে। টাইগারপাসের দ্বিতল সড়ক এক অপূর্ব সুন্দর জায়গা। সেখানে আমার মনে হয় না র‌্যাম্পের কোনো প্রয়োজন আছে। র‌্যাম্প হলে সেটা একটি কুৎসিত ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে এত র‌্যাম্পের দরকার কেন হবে? তিন-চারটা র‌্যাম্প হলেই থথেষ্ট। আমিও তো আরবান প্ল্যানিংয়ের ছাত্র। আরবান প্ল্যানিং হবে এমন যেখানে প্রাকৃতিক পরিবেশ অবশ্যই বজায় রাখতে হবে এবং কোন জঞ্জাল যেন সৃষ্টি না হয়। এলিভেটেড মানেই ওপর দিয়ে দূর দূরান্তের গাড়ি যাবে। সব রাস্তায় সেটাকে কেন নামাতে হবে? অতিরিক্ত র‌্যাম্পগুলো শহরে যানজটের সৃষ্টি করে। এর জন্য এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতেও যানজট হবে। চেয়ারম্যানের কাছে আবেদন, আপাতত বন্ধ করে দিন। আমরা সবাই মিলে বসে সিদ্ধান্ত নিব এ বিষয়ে কি করা যায়। চট্টগ্রামের নাগরিকেরা নিজেদের মতামত জানাবেন।

এসময় সিডিএ চেয়ারম্যান জহিরুল আলম দোভাষ ডলফিন বলেন, এটা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর একটা প্রকল্ব। করার সময় অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। শুরুতে কেউ কেউ বলেছিল- বারেক বিল্ডিং, কেউ বলেছে দেওয়ানহাটে শেষ করেন। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন লালখান বাজার নামাতে। বুয়েটের বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, দেওয়ানহাটে নামালে সুফল মিলবে না। ৩৫ টা র‌্যাম্পের দাবি ছিল। আমরা কমিয়েছি। কিছু ভুল বুঝাবুঝি হয়েছে। শতবর্ষী গাছ কাটা হবে না। ছোট কিছু গাছ কাটা হবে। গাছ বন বিভাগ মার্কিং করেছে। আমরা করিনি। আপনারা ড্রইং দেখলে বুঝতে পারবেন। প্রয়োজনে র‌্যাম্পের সাইজ আরো ছোট করতে বলেছি।

এরপর আন্দোলনকারীদের পক্ষে বর্ষীয়ান অধ্যাপক শফিক আহমেদ চৌধুরী বলেন, এখানে কোনো র‌্যাম্প আমরা চাই না। বরং যত র‌্যাম্প হচ্ছে সেগুলোই অনেক বেশি।

চউক এর প্রকল্প পরিচালক মাহফুজুর রহমান বলেন, শুরুতে ৩৫টি র‌্যাম্প করার কথা বলা হয়। পরে আমরা কমিয়েছি। এরপরও অনেকের দাবিমুখে মোট ১৫টি র‌্যাম্প করতে হচ্ছে। এখানে র‌্যাম্পের জন্য শতবর্ষী গাছ কাটা যাবে না। শুধু একটি শতবর্ষী গাছের ডাল কাটা যাবে। র‌্যাম্প যদি এখানে তুলতে চাই ডিজাইন আরেকটু মডিফাই করব। ঈদের পরে আপনাদের দেখাব। সবাই যদি মত দেন, তাহলে কাজ বাস্তবায়ন করা আমার দায়িত্ব। সেখানে র‌্যাম্প দরকার না হলে, করব না।

চউক এর প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস বলেন, র‌্যাম্পের বিষয়টি জনঘনত্ব অনুসারে ঠিক করা হয়। এখানে না করলে ২ নম্বর গেট থেকে উঠতে হবে। প্রতি বছর গাড়ি বাড়ছে। পোর্ট সিটি বলে ট্রাক লরির সংখ্যা বেশি। ৫০-১০০ বছর পরে গাড়ি যে বাড়বে তার উপর ডিজাইন। উঠানামা সহজ করব এটা টার্গেট ছিল। এলাকার গুরত্ব বিবেচনা করে প্রস্তাব করা হয়। চট্টগ্রাম শহরে পরিবেশ বিধ্বংসী কিছু করব না। গাছ কেটে আমরা কোনো র‌্যাম্প করব না। নতুন ডিজাইন করে জানাব। দ্বিতল রাস্তা নষ্ট করব না।

এসময় আন্দোলনকারীরা টাইগারপাস-সিআরবি অংশে র‌্যাম্পটি বাতিলের দাবি জানাতে থাকেন। কোন ধরণের যুক্তিতেই চট্টগ্রামের অনন্য দ্বিতল সড়কটি নষ্ট করে র‌্যাম্প নির্মাণ তারা করতে দেবেন না বলে জানিয়ে দেন।

এক পর্যায়ে নগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ও নাগরিক সমাজ চট্টগ্রামের সদস্য সচিব ইব্রাহিম হোসেন বাবুল বলেন, আমরা সবাই মিলে সিআরবি রক্ষা করেছিলাম। তখন সিডিএ আমাদের পাশে ছিল। সিডিএ চেয়ারম্যান বলেছিলেন, তিনি সিআরবিতে কোনো হাসপাতাল নির্মাণের অনুমোদন দেবেন না। শেষ পর্যন্ত তিনি তা দেননি। এখনও চট্টগ্রামের মানুষের সেন্টিমেন্টের বাইরে উনারা (সিডিএ) কিছু করবেন না। আমরা বিশেষজ্ঞদের নাম দিব। সবাই মিলে যেটা ঠিক করব, সেভাবে হবে।

কবি-সাংবাদিক কামরুল হাসান বাদল বলেন, চট্টগ্রামের জনগণ এই র‌্যাম্প চায় না। এখানে র‌্যাম্প করবেন না। এখানে টোল দিয়ে উঠতে হবে। সাধারণ মানুষ এই এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে ব্যবহার করতে পারবে না। এখানে কোনো র‌্যাম্প করবেন না।

ডা. মনজুরুল করিম বিপ্লব বলেন, আপনারা লালখান বাজারেও এলিভিটেড এক্সপ্রেসওয়ের জন্য পাহাড় কেটেছেন। অনেক র‌্যাম্প করেছেন। যারা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে ব্যবহার করবে তারা জিইসি মোড় বা আগ্রাবাদ থেকে উঠতে পারবে। এই অনন্য সড়কটি নষ্ট করার কোনো প্রয়োজন নেই।

শেষে সিডিএ চেয়ারম্যানের উদ্দেশ্যে ড. অনুপম সেন বলেন, ঢাকা বা কোলকাতায় এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে এত র‌্যাম্প নেই। এটা ধনী লোকের জন্য। নিচের রাস্তা যদি বারবার খোড়েন সেটাও ছোট হয়ে যায়। আমার ৮৩ বছর বয়স। ৪৮ সালে এই দ্বিতল সড়ক দেখেছি। চমৎকার সুন্দর সেই অংশটি যেন কোনভাবে নষ্ট না হয়। দ্বিতল রাস্তা কোনভাবে নষ্ট করা যাবে না। এখানে র‌্যাম্প করা যাবে না। চট্টগ্রামের দেড় শতাব্দী প্রাচীন পরিবারের প্রতিনিধি আপনি। আপনি এটি চিন্তা করবেন।

সবার বক্তব্য শুনে ঈদের পর নাগরিক সমাজ ও বিশেষজ্ঞদের সাথে বসে পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করা হবে বলে আশ্বাস দেন চউক চেয়ারম্যান জহিরুল আলম দোভাষ।

সভায় উপস্থিত ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. মাহফুজুর রহমান, দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মফিজুর রহমান, পিপল’স ভয়েস সভাপতি শরীফ চৌহান, বিএফইউজের যুগ্ম মহাসচিব মহসীন কাজী, প্রেস ক্লাবের সহ-সভাপতি চৌধুরী ফরিদ, জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ঋত্তিক নয়ন, ন্যাপ নেতা মিটুল দাশগুপ্ত, সাংস্কৃতিক সংগঠক প্রণব চৌধুরী, রাজনীতিবিদ হাসান মারুফ রুফি, সৈয়দ মোহাম্মদ আতিকুর রহমান, আন্দোলনকারী রিতু পারভি, প্রীতম দাশ, মাহমুদুন্নবী খোকা, রাহুল দত্ত প্রমুখ।

এর আগে মঙ্গলবার সকালেও দ্বিতীয় দিনের মত আইকনিক সড়ক রক্ষা ও শতবর্ষী গাছ না কাটার দাবিতে কর্মসূচি পালন করে ‘সম্মিলিত পরিবেশ রক্ষা আন্দোলন’। তারা শতবর্ষী গাছে লাল কাপড় জড়িয়ে এবং হাতে ব্যানার নিয়ে প্রতিবাদে সামিল হয়। আন্দোলনে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, লেখক, সাংবাদিক, রাজনীতিবিদসহ বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ অংশ নেয়।

কাছাকাছি সময়ে মঙ্গলবার দুপুরে র‌্যাম্পের জন্য নির্ধারিত স্থান পরিদর্শন করে প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা সিডিএ’র বোর্ড সদস্য ও প্রকল্প পরিচালক। এসময় প্রকল্প পরিচালক ও নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মাহফুজুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, শতবর্ষী গাছ রক্ষা করে র‌্যাম্পের নকশা করা হয়। ঈদের পরে পাইলিংয়ের কাজ শুরু করার কথা ছিল। এই র‌্যাম্প নির্মাণ করতে বড় কোনো গাছ কাটা পড়বে না। ছোট ছোট ৪৪টি গাছ কাটা পড়বে। দ্বিতল সড়কে কাজ করা হবে না। নিচের রাস্তা থেকে র‌্যাম্পটি তোলা হবে। নাগরিক সমাজের আপত্তির বিষয়টি গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে জানিয়েছি। এখন মন্ত্রণালয় অনুমোদন দিলে কাজ করা হবে, না হলে অন্যভাবে করা হবে।

পরিদর্শনে থাকা চউক এর বোর্ড মেম্বার ও নগর পরিকল্পনাবিদ স্থপতি আশিক ইমরান বলেন, এখানে দুটি বিষয়্। একটি হলো টাইগারপাসের এই দ্বিতল সড়ক এশিয়ার অন্যতম সুন্দর রাস্তা। ৪৪টি গাছের গুরুত্বপূর্ণ আবেদন আছে। র‌্যাম্পের প্রস্ত কমিয়ে সমাধান করা হলেও ৪৪টি গাছ থাকবে না। ফলে সেই আবেদন নষ্ট হবেই। অন্যদিকে র‌্যাম্প না হলে পলোগ্রাউন্ড টাইগারপাসের কানেকটিভিটি হচ্ছে না। তখন নিউমার্কেট থেকে আসা গাড়িগুলো জিইসি বা আগ্রাবাদ থেকে উঠতে হবে। যদি ক্ষতি সর্বনিম্ন পর্যায়ে রাখা না যায়, তাহলে র‌্যাম্প করা না হোক। বিকল্প কোনো পথ বের করা যায় কি না, তা সিডিএকে অনুরোধ করব।