খরচ আর মেয়াদ বাড়ে, কাজ শেষ হয় না

চটগ্রাম আউটার রিং রোড

সুপ্রভাত ডেস্ক

চার বছরে তিনবার মেয়াদ বাড়িয়ে আর প্রকল্প ব্যয় তিন গুণ করার পরও কাজ শেষ হয়নি চট্টগ্রাম সিটি আউটার রিং রোড প্রকল্পের।
এরমধ্যে প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) সড়কটি যান চলাচলের জন্য সীমিত আকারে খুলে দিয়েছে।
অথচ তিনটি ফিডার রোডের একটিরও নির্মাণ কাজ শেষ হয়নি। তাই সড়কটি নির্মাণের সুফল পুরোপুরি পাওয়া যাচ্ছে না।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই প্রকল্পে ব্যয় আরও বাড়তে পারে। ইতোমধ্যে আরও কিছু কাজ সংযুক্ত করে দ্বিতীয় ধাপে (আউটার রিং রোড-২) আরেকটি প্রকল্প গ্রহণের প্রক্রিয়া চলছে।
২০১১ সালের জুলাইয়ে প্রকল্পের ইঞ্জিনিয়ারিং কনসালটেন্টের সঙ্গে চুক্তি সাক্ষর করে সিডিএ। সেই অনুষ্ঠানে সিডিএ’র তখনকার চেয়ারম্যান আবদুচ ছালাম বলেছিলেন, ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে প্রকল্পটি শেষ হবে।
পতেঙ্গা থেকে দক্ষিণ কাট্টলী পর্যন্ত ১৫ দশমিক দুই কিলোমিটার সড়কটি নির্মাণে তখন প্রাথমিক ব্যয় ধরা হয় ৮৫৬ কোটি ২৮ লাখ টাকা। জমি অধিগ্রহণে ব্যয় ধরা হয় ১৪০ কোটি টাকা। খবর বিডিনিউজের।
উপকূলীয় বাঁধ শক্তিশালী করা, নগরীতে যানজট কমানো, আবাসন-বাণিজ্য ও পর্যটন উৎসাহিত করা এবং বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে সড়কটি নির্মাণ করা হচ্ছে। এটি যুক্ত হবে কর্ণফুলীতে নির্মাণাধীন টানেলের সঙ্গে।
২০১৩ সালের আগস্টে একনেকে অনুমোদনের পর ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে প্রকল্পটির নির্মাণ কাজের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী। জুলাইতে শুরু হয় নির্মাণ কাজ। সেসময় সংশোধিত ব্যয় নির্ধারিত হয় এক হাজার ৪৯৬ কোটি টাকা। মোট ৯০ একর জমি অধিগ্রহণে খরচ ধরা হয় ৪৯৩ কোটি টাকা। মাটি ভরাট কাজে ব্যয় ছিল ১০৬ কোটি টাকা। বাঁধ এলাকায় বসবাসকারীদের পুনর্বাসনে ব্যয় ধরা হয় ৩৩২ কোটি টাকা।
তখন প্রকল্প বাস্তবায়নের সময়সীমা নির্ধারণ করা হয় ২০১৭ সালের জুন।
এরপর ২০১৮ সালের জুনে প্রকল্পের সংশোধিত ব্যয় বেড়ে হয় ২ হাজার ৪২৬ কোটি টাকা। মৌজা দর বদল হওয়ায় ভূমি অধিগ্রহণ ব্যয় বেড়ে হয় ৭৫৫ কোটি টাকা। মাটি ভরাটের খরচ বেড়ে হয় ৩৪৬ কোটি টাকা।
দ্বিতীয় দফায় প্রকল্পের মেয়াদ বাড়িয়ে করা হয় ২০১৯ সালের জুন।
শুরুতে ঢেউ প্রতিরোধক দেয়াল না থাকলেও দ্বিতীয় সংশোধনীতে এই খাতে বরাদ্দ রাখা হয় ২৩০ কোটি টাকা। মোট প্রকল্প ব্যয়ে সরকার দিচ্ছে এক হাজার ৭২০ কোটি টাকা এবং জাইকা দিচ্ছে ৭০৬ কোটি টাকা। এরপরও আর এক দফা সময় বাড়িয়ে করা হয় চলতি বছরের জুন পর্যন্ত। তবে এই সময়েও কাজ শেষ হয়নি।
প্রকল্প পরিচালক সিডিএ’র প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস বলেন, ‘কোভিড-১৯ এরজন্য মে পর্যন্ত প্রায় দুই মাস বন্ধ ছিল। তখন দুটি কিস্তির টাকাও ছাড় হয়নি।
‘এরপরও মূল সড়কের কাজ ৯০ শতাংশ শেষ। বাঁধে ব্লক ডাম্পিং, ওয়াক ওয়ে এবং প্রতিরোধ দেয়ালের বাকি কাজ চলমান।’
প্রকল্পের ব্যয় আরও বাড়তে পারে ইঙ্গিত দিয়ে তিনি বলেন, ‘মেয়াদও ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। আশাকরি এরমধ্যে শেষ করতে পারব।’
বারবার প্রকল্পের মেয়াদ ও ব্যয় বৃদ্ধি প্রসঙ্গে সনাক-টিআইবি চট্টগ্রাম মহানগরের সভাপতি আখতার কবীর চৌধুরী বলেন, ‘মেগা প্রকল্পগুলোতে এমনিতে যে ব্যয় করা হয় তা পার্শ্ববর্তী দেশের তুলনায় কয়েকগুণ বেশি। এসব বড় প্রকল্পের অনিয়মের সুবিধাভোগী উপর মহল পর্যন্ত। তাই বারে বারে মেয়াদ আর খরচ বাড়ে।
‘প্রকল্প বিলম্বিত হওয়ায় অনেক সময় সুফলটাই আর মেলে না। এসব দেখার জন্য যে তদারকি সংস্থা তারাও নির্বিকার। যা লুটপাটের পথকে প্রশস্ত করে।’
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ ২০১৮ সালের জুনে এই প্রকল্পের ‘নিবিড় পরিবীক্ষণ প্রতিবেদন’ এ কিছু সমস্যা চিহ্নিত করে।
সাগরের পাড়ের মাটি দিয়ে বাঁধে মাটি ভরাট কাজের প্রমাণ পায় তারা। প্রকল্পের অধীনে নির্মিত স্লুইচ গেটের সঙ্গে খালের সংযোগ যথাযথ না হওয়ায় সমুদ্র তীরের লোকালয়ে জলাবদ্ধতা সৃষ্টির আশঙ্কা করা হয় প্রতিবেদনে।
এ বিষয়ে প্রকল্প পরিচালক কাজী হাসান বলেন, ‘সাগর পাড়ের মাটির সাথে বালি ও কাদার মিশ্রণে প্রতিটি লেয়ার তৈরি করা হয়। তারপর সেটি যাচাই করে পরের লেয়ার দেওয়া হয়।
‘গত দু’মাস ধরে ভারি যানবাহন চলছে। ঢালাই কোথাও এতটুকু দেবে যায়নি। আগের সাতটি স্লুইচ গেটের স্থলে ১১টি স্লুইচ গেট করা হয়েছে। কাজের মান যাচাই করে জাইকা এবং অস্ট্রেলিয় কনসালটেন্সি ফার্ম। এখানে বিচ্যুতির কোনো সুযোগ নেই।’
শুরুতে নগরীর সঙ্গে সড়কটির সংযোগ স্থাপনে স্টিলমিল নারিকেলতলা-বেড়িবাঁধ (ফিডার রোড-১), বড়পোল-আনন্দবাজার-বেড়িবাঁধ (ফিডার রোড-২) এবং সাগরিকা-স্টেডিয়াম-বেড়িবাঁধ (ফিডার রোড-৩) নির্মাণের পরিকল্পনা ছিল।
জমি অধিগ্রহণ জটিলতায় শুরুতে ফিডার রোড-২ বাতিল করা হয়। আর ফিডার রোড-১ এর কাজ এখনো শুরু হয়নি।
সরেজমিন, দক্ষিণ কাট্টলী রাসমনি ঘাট অংশে দেখা যায়, ফিডার রোড-৩ এর একটি ফ্লাইওভার নির্মাণের কাজ চলছে।
সেখানকার শ্রমিকরা জানান, মহামারীর কারণে বন্ধ থাকার পর মে মাসের শেষে কাজ শুরু হলে শ্রমিক সংখ্যা আগের চেয়ে বাড়ানো হয়েছে। এটি নির্মাণে আরও এক বছর লাগতে পারে।
ফিডার রোড না থাকায় বন্দর ও বিভিন্ন কন্টেইনার টার্মিনাল থেকে পতেঙ্গা হয়ে আউটার রিং রোডে উঠতে হয় পণ্যবাহী ভারী যানবাহনকে। পাশাপাশি নগরীতে প্রবেশের জন্য টোল রোড ধরে ফৌজদারহাট হয়ে ঘুরে আসতে হয়।
দক্ষিণ কাট্টলীর খেজুরতলা ঘাট এলাকায় টোল রোডের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আউটার রিং রোড। এখান থেকে ফৌজদারহাট পর্যন্ত টোলে রোডে গাড়ির চাপ বেড়েছে।
নগর পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের উপ-কমিশনার (বন্দর) তারেক আহম্মেদ বলেন, ‘আউটার রিং রোড চালুর সুফল কিছুটা পাচ্ছি। কিন্তু আনন্দবাজার অংশে সংযোগ না থাকায় পুরো সুফল পাচ্ছি না।’
প্রকল্প পরিচালক কাজী হাসান বলেন, ‘ফিডার-১ এর কাজ জমি অধিগ্রহণ জটিলতায় শুরু করা যায়নি। শিগগির কাজ শুরু হবে। ফিডার-৩ এর কাজ চার-পাঁচ মাসের মধ্যেই শেষ হবে।’
প্রথম প্রকল্পের কাজ শেষ না হলেও প্রকল্পটির দ্বিতীয় ধাপ হিসেবে আরেকটি প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে।
প্রকল্প পরিচালক কাজী হাসান বলেন, জমি অধিগ্রহণের জটিলতায় ফিডার রোড-২ বাদ দেওয়া হয়। ক্ষতিপূরণের টাকা জেলা প্রশাসনকে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু নিম্ন আদালতে মামলা থাকায় ৮০ শতাংশই পরিশোধ সম্ভব হয়নি।
‘ফেজ-২ তে এই ফিডার রোডটি করা হবে। পাশাপাশি রিং রোড এখন যেখানে শেষ হয়েছে সেখান থেকে ফৌজদারহাট পর্যন্ত এক্সপানশন করা হবে। মন্ত্রণালয়ের সভায় এই প্রস্তাবনা দিয়েছে। টানেল চালু হলে গাড়ি ৩০-৪০ শতাংশ বাড়বে। তাই এটা দরকার।’
২০০৬ সালে জাপান ব্যাংক ফর ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন (জেবিআইসি) একটি সমীক্ষা করে নগরীর যোগাযোগ অবকাঠামো বাড়াতে আউটার রিং রোড নির্মাণের উপর গুরুত্ব দেয়। মাস্টারপ্ল্যানেও এটির উল্লেখ ছিল।
চট্টগ্রাম শহর রক্ষা বাঁধের উপর সড়কটি নির্মাণ করা হচ্ছে। সড়ক নির্মাণে বাঁধ এলাকায় প্রায় ২০ হাজার গাছ কাটা হয়।
ষাটের দশকে নির্মিত চট্টগ্রাম শহর রক্ষা বাঁধ ১৯৯১ এর ঘূর্ণিঝড়ে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আগের বাঁধের উচ্চতা ছিল ২০ ফুট। প্রকল্পের অধীনে বাঁধটি আরও ১০ ফুট উঁচু করা হয়েছে। বাঁধের নিচের অংশের ৩০০ ফুট প্রশস্ত করা হয়েছে। আর উপরের সড়কের প্রশস্ততা ৮০ থেকে ৮৪ ফুট। যা আগে ছিল ১৬ থেকে ২৪ ফুট।