ক্ষমতাদর্পী মানুষ এবং শান্তিসন্ধানী মানুষ

রায়হান আহমেদ তপাদার »

মানুষের আচরণ নিয়ন্ত্রণ বা সরাসরি নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা রয়েছে সামাজিক বিজ্ঞান এবং রাজনীতিতে। ক্ষমতা সম্পর্কে সাম্প্রতিক সামাজিক বিতর্কে ঘন ঘন ঘটাতে সক্ষম-অন্য কথায়, ক্ষমতা সামাজিক কর্মকা-গুলি যতটা সম্ভব সীমাবদ্ধ বা তাদের প্রতিরোধ করতে পারে এমন বহু উপায় রয়েছে। ইতিহাস পর্যালোচনা করেেল দেখা যায়, ক্ষমতাদর্পী মানুষ সেখান থেকে কোনো শিক্ষা নেয়নি। এ প্রসঙ্গে কতিপয়ের দুষ্কর্মকে সচল রাখার অভিপ্রায়ে কিছু প্রবাদ চালু রাখা হয়েছে প্রায় সব ভাষায়। যেমন, আমাদের ভাষায় বলে,কয়লা ধুলেও ময়লা যায় না।
আর ইংরেজির প্রবাদ ‘ব্ল্যাক উইল টেক নো আদার হিউ’ আমরা এসবকে আপ্তবাক্য ভেবে নিষ্ক্রিয় থাকি যুগে যুগে মারি আর দুর্যোগ সমৃদ্ধ জনপদ ধ্বংস করেছে। কোথাও কোথাও শ্যামল প্রান্তর আর কোলাহলমুখর জনবসতি বিরান হয়ে গেছে। এসব নিয়ে নানা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ আছে। আর ধর্মগ্রন্থগুলো বিষয়টির কম গুরুত্ব দেয়নি। বলা হয়েছে, মানুষের কৃত অনাচার দুর্যোগ ডেকে এনেছে। বিজ্ঞানও তাই বলে। আমরা প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্যে মানবসৃষ্ট ধ্বংসযজ্ঞ দেখেছি। ফারসি সাহিত্যের শাহনামা তো যুদ্ধবিগ্রহের অপর নাম। গ্রিক সাহিত্য ধ্বংসযজ্ঞ দিয়েই শুরু। আরবি সাহিত্যে বিরান জনপদ নিয়ে কাঁদতে দেখা গেছে কবি ইমরুল কায়েসকে।কালান্তরে মানুষ আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছে। আমরাও ফিরে যাব অচিরে। আসলে মানুষ সহজাত সুস্বভাব নিয়ে জন্মে। কিন্তু মানুষ পারিপার্শ্বিকের প্রভাবে বদলে যায়। সুনীতি বা ন্যায়বোধ আমাদের তাড়িত করে না। কর্তৃত্ববাদিতা আমাদের প্রলুব্ধ করে। এটা মনুষ্যত্ব বা সুস্থ মানসিকতার পরিচায়ক নয়।
সমাজের চারপাশে চোখ-কান খাড়া রাখলেও সব কিছু নিয়ে মন্তব্য করার অধিকার সীমিত। তবে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাসংশ্লিষ্টতার কারণে অনুভব করছি, দেশ ও জনগণের সর্বাধিক কল্যাণ এবং চূড়ান্ত অনিষ্ট করার সামর্থ বা ক্ষমতা রয়েছে রাজনীতি ও রাজনীতিকদের। কোনো দেশের রাজনীতি যদি হয় নীতিহীন, পচনগ্রস্ত; তবে সে দেশটির অন্যান্য প্রতিষ্ঠানকেও সেই সংক্রমণ থেকে রক্ষা করা কার্যত অসম্ভব হয়ে পড়ে। একইভাবে, কিছু কিছু সীমাবদ্ধতার পরও, রাষ্ট্র পরিচালনব্যবস্থা হিসেবে পৃথিবীতে এখন পর্যন্ত গণতন্ত্রের কোনো বিকল্প নেই। কিংবা হয়তো আছে, অধিকতর ও কার্যকর গণতন্ত্র। দায়িত্বশীলতা যার প্রধান ও অপরিহার্য শর্ত। আমরা প্রায়ই শুনি, ক্ষমতা দূষিত করে এবং ক্ষমতা সম্পূর্ণ দূষণ সম্পন্ন করে। এ কথা সত্য নয়, ক্ষমতা তাদেরকেই দূষিত করতে পারে যারা দূষণযোগ্য। ক্ষমতা কেবল অন্তরালকে সম্মুখে এনে দেয়। ক্ষমতা নিরপেক্ষ। সৎ লোকের হাতে ক্ষমতা আশীর্বাদস্বরূপ, আর অধার্মিকের হাতে তা অভিশাপ; অনেকটা বৃষ্টি হলে আগাছা আর ফুল উভয়েই যেমন বাড়তে থাকে, ক্ষমতালোভী লোকেরা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। ক্ষমতার অপব্যবহার তখনই যখন কারো প্রত্যাশা নোংরা হয়ে যায়। পাজি, বিশ্বাসঘাতক ও প্রতারক লোকেরাই ক্ষমতার অপব্যবহার করে কাজের মধ্যে দুর্নীতি ডেকে আনে। যেসব নেতা উত্তরাধিকার সূত্রে লব্ধ বস্তু রেখে যেতে পারেন তারা মহান আদর্শ এবং প্রতিশ্রুতির গভীর বোধ নিয়ে যাত্রা শুরু করেন।
আন্তরিক নেতা শুধু বর্তমান বিষয় নিয়ে ভাবে না, আগামীকাল তথা পরবর্তী সময়ের কথাও ভাবেন। এ ধরনের নেতৃত্ব ইতিহাসের গতি পরিবর্তন করে থাকে। আত্মবিশ্বাস, সাহসিকতা এবং অনমনীয়তার শক্তি বলে যেসব ব্যক্তি নেতৃত্বের পর্যায়ে উন্নীত হন, ইতিহাস তাদের বিশেষ স্থান দিয়েছে। রাজনীতি মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের মাধ্যম, তাই রাজনীতির প্রতি মানুষের আগ্রহ সৃষ্টির শুরু থেকেই। রাজনীতির গতি-প্রকৃতি কোন দিকে যায় তার প্রতি মানুষের তীক্ষ্ম দৃষ্টি থাকে। রাজনীতি নিয়ন্ত্রিত হয় কার্যত রাজনৈতিক নেতৃত্বের দ্বারা, নেতৃত্ব কলুষিত হয়ে গেলে রাজনীতি মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের পরিবর্তে মানুষের ভাগ্যে নেমে আসে অবধারিত দুর্যোগ।লালসা ও বিলাসিতার জন্য জাতির সর্বনাশ করার মতো প্রতারক ও বিশ্বাসঘাতক প্রত্যেক সমাজে রয়েছে। ঐ ধরনের লোকেরা হীনমন্যতাবোধ ও অহংবোধের প্রভাবে যে কোনো মূল্যে ক্ষমতা, সম্পদ ও মর্যাদা পেতে চায়।
মূল্যবোধের অবক্ষয়ের ধারা আমরা অধোগতির তলানিতে। এর মূলে রাজনীতির স্বার্থবাদী দৃষ্টিভঙ্গি, মতবাদের ফাঁকফোকর। কিন্তু তরুণরা এদের অনুকারী হয়; কারণ সবার জানা, ব্যাধি সংক্রামক। তারা নেতাদের অপকর্ম দেখে দ্বিগুণ ৎসাহে দুষ্কৃতির উৎসবে গা ভাসায়। নেতারা সত্যিকার রাজনীতিতে নিয়োজিত হলে শুদ্ধ সমাজ গড়ে উঠবে। ইতিহাসে অনেক রাজনীতিবিদদের নাম লেখা আছে, যাঁদের ত্যাগ ও খ্যাতি মহাকালের ¯্রােতে বিলীন হয়নি।এইতো দেখেন না, শান্তির দূত থেকে ক্ষমতালিপ্সু স্বৈরাচারে পরিণত সু চি মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলমানদের গণহত্যার বিপরীতে নিজের স্পষ্ট অবস্থানের কারণে বহু আগেই নিজের অর্জিত সম্মান হারিয়েছেন।
একসময়কার এশিয়ার ম্যান্ডেলা অং সান সু চি। এখনকার রাষ্ট্রীয় উপদেষ্টা সু চি সবশেষ গত বছর ডিসেম্বরে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে) নিজ দেশের সেনাবাহিনীর গণহত্যার পক্ষে সাফাই গাইতে হাজির হয়ে নিজের কষ্টার্জিত আন্তর্জাতিক সম্মানের অবশেষটুকুও নষ্ট করেছিলেন। বিশ্লেষকরা বলছেন, আইসিজে মিয়ানমারকে গণহত্যা মামলায় অভিযুক্ত করার পর সু চি এখন কেবলই একজন ক্ষমতালিপ্সু স্বৈরাচার, যিনি ক্ষমতা ধরে রাখার স্বার্থে নিজ দেশের সামরিক বাহিনীর গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধের পক্ষে দাঁড়ান। যুক্তরাষ্ট্রের বার্তা সংস্থা অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের এক বিশ্নেষণে এভাবেই বর্ণনা করা হয়েছে সু চিকে। তার সাবেক ভক্তদের মতে, সু চি কেবল নিজেদের প্রতিরক্ষার পক্ষে কথা বলছেন, রোহিঙ্গাদের রক্ষায় ব্যর্থ হয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা এক সময় সু চির ব্যাপক প্রশংসা করেছিলেন। ওবামা বলেন, বছরের পর বছর ধরে সু চির নিরলস প্রচেষ্টা ও ত্যাগের কারণে মিয়ানমার আরও বেশি শান্তিপূর্ণ ও গণতান্ত্রিক হয়েছে, সু চির অবস্থানের নেপথ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে মিয়ানমারের রাজনৈতিক বাস্তবতার। নিজ দলের বিশাল বিজয়ের পরও সাংবিধানিক ক্ষমতার প্রশ্নে এখনও দেশের প্রকৃত শাসক সেনাবাহিনী। সামরিক শাসনবিরোধী লড়াইয়ে সু চির মিত্র ছিল লবিং গ্রুপ বার্মা ক্যাম্পেইন ইউকে। তারা মনে করছে, সু চি রোহিঙ্গা নিধনের পক্ষে দাঁড়িয়েছেন নিজেকে জাতীয়তাবাদী প্রমাণ করে আসন্ন নির্বাচনে তার ভোট বাড়ানোর স্বার্থে। রোহিঙ্গা নিধনের প্রেক্ষাপটে একের পর এক সম্মাননা হারিয়েছেন সু চি।
প্রযুক্তির যুদ্ধে মেধার ব্যবহার হয়। এ যুদ্ধে জিতলে ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, দেশ আর্থিকভাবে লাভবান হয়। অস্ত্রের যুদ্ধে এখন কোন দেশই লাভবান হয় না। যুদ্ধ করে দেশ দখল করতে না পারলে, তেলের খনি দখল করতে না পারলে, মাটির নিচে লুকিয়ে থাকা সম্পদ নিজেদের আয়ত্বে আনতে না পারলে সে যুদ্ধ বৃথা। পেশি শক্তি বা সামরিক শক্তি দেখানোটাকে মানুষ আর আগের মতো পছন্দ করে না। সিরিয়াযুদ্ধের পর যখন আইনাল কুর্দির লাশ সাগরে ভাসে তখন মানুষের মন কাঁদে। আইনাল কুর্দির ছবি বুকে নিয়ে জাতিসংঘ সদর দপ্তরসহ বিশ্বের সবখানে বিক্ষোভ হয়। নাগরিক আন্দোলনের নেতারা ক্ষুব্ধ হন।
সিরিয়া, ইরাক, লিবিয়া কিংবা আফগানিস্তানের যুদ্ধের সময় মানুষ কি দেখেছে। লিবিয়ার বেনগাজিতে ইহতামের চোখের সামনে যখন নববিবাহিতা স্ত্রীর শরীর বোমার আঘাতে ঝলসে যায় তখন বিশ্ব-বিবেক নাড়া দেয়।কারণ এগিয়ে যাওয়া বিশ্বের কোন খাতেই যুদ্ধ কাম্য নয়। মানুষ যুদ্ধ চায় না,শান্তি চায়।

লেখক : গবেষক ও কলামিস্ট
ৎধরযধহ৫৬৭@ুধযড়ড়.পড়স