ক্রয়াদেশ কমেছে ২০ থেকে ২৫ শতাংশ

পোশাকশিল্প

শুভ্রজিৎ বড়ুয়া »

বাংলাদেশের রপ্তানির প্রধানতম খাত পোশাক শিল্প। তবে গত বছরের জুন থেকে এ খাতে অর্ডার কমছে। মূলত রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে উন্নত দেশগুলোতে দেখা দিয়েছে অর্থনৈতিক মন্দা। ফলে প্রয়োজনের অতিরিক্ত কেউ কিনছে না, চাহিদাও কমছে। উৎপাদন ব্যয় ১০ থেকে ১৫ শতাংশ কমালেও ক্রেতাদের সাড়া মিলছে না বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।

তাদের মতে, ২০২২ সালের ডিসেম্বরে আগের আদেশের সব পণ্য পাঠানো হয়েছে। ফলে ডিসেম্বরের রপ্তানি বেশ ঈর্ষণীয় হলেও আগামীদিনে রপ্তানি আয় কমবে বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো সূত্রে জানা যায়, গত বছরের জানুয়ারিতে ৪৮৫ কোটি তিন লাখ ৭১ হাজার ডলার, ফেব্রুয়ারিতে ৪২৯ কোটি ৪৬ লাখ ডলার, মার্চ মাসে ৪৭৬ কোটি ২৩ লাখ ডলার, এপ্রিল মাসে ৪৭৪ কোটি ডলার ও জুন মাসে ৪৯১ কোটি ডলার পোশাকপণ্য ইউরোপ ও আমেরিকার বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হয়েছে। জুন মাসের তুলনায় জুলাই মাসে ৯৬ কোটি টাকা রপ্তানি কমেছে। জুলাইয়ের পর রপ্তানি কমেছিল আগস্টে। সেপ্টেম্বরে তা আরও কমেছে। অক্টোবরে রপ্তানি কমেছে ২০ শতাংশ। তবে ডিসেম্বরে রেকর্ড রপ্তানি হয়েছে। রপ্তানি বেশি হয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং কানাডায়। এসময় রপ্তানি ২ দশমিক ৪৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের রপ্তানি থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩ দশমিক ১৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে।

এ প্রসঙ্গে কথা হয় বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) সাবেক পরিচালক ও চিটাগং চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির পরিচালক অঞ্জন শেখর দাশ বলেন, ‘আগের অনেকগুলো পণ্যের শিপমেন্টের ডেট (সময়) পিছিয়ে দেওয়া হয়েছিলো। তারমধ্যে প্রায় অনেক পণ্য ডিসেম্বরে শিপমেন্ট হয়েছিলো। এছাড়াও আমাদের কাছে নভেম্বর পর্যন্ত বেশকিছু অর্ডার ছিলো। তাও ডিসেম্বরে পাঠানো হয়েছে। তাই ডিসেম্বরে আমাদের রপ্তানি হার বেশি। তবে ডিসেম্বর থেকে আমাদের কাছে নামমাত্র কিছু অর্ডার আছে। এগুলো চলছে। কিন্তু আগামী পোশাকখাতে কি অবস্থা হবে তা ভেবেই ভয় লাগছে।’

বিজিএমইএ তথ্যমতে, চট্টগ্রামে তালিকাভুক্ত ৭৬টি কারখানা রয়েছে। এ তালিকার বাইরে উৎপাদনে সচল রয়েছে আরও ১৮০টি কারখানা। এর পাশাপাশি প্রায় ২০০টির মতো ছোট কারখানা চুক্তিতে কাজ করছে বড় পোশাক কারখানাগুলোর সঙ্গে। সবমিলিয়ে ৪৫০টির মতো কারখানা সচল রয়েছে। কিন্তু গত তিন মাসে এসব কারখানায় ৪০ ভাগ কার্যাদেশ কমে গেছে। চট্টগ্রামের কারখানাগুলোতে সবমিলিয়ে সাড়ে চার লাখ কোটি টাকার কার্যাদেশ আসার কথা থাকলেও চলতি বছরে এক লাখ ৩৫ হাজার কোটি টাকার কার্যাদেশ কমে গেছে। আগের কার্যাদেশের তুলনায় দেশের সব কারখানার ক্রয়াদেশ ২০ থেকে ২৫ শতাংশ কমেছে।

পোশাক খাতের দুরাবস্থা নিয়ে বিজিএমইএ’র সাবেক পরিচালক খন্দকার বেলায়েত হোসেন বলেন, ‘আমাদের সামনে এখন তিনটি সমস্যা। প্রথম হলো উন্নত দেশগুলোর মুদ্রাস্ফীতির কারণে পোশাকের চাহিদা কমেছে। তাই আমাদের কেউ কেউ উৎপাদন ব্যয় কমিয়ে অর্ডার নেওয়ার চেষ্টা করলেও অর্ডার পাচ্ছে না। দ্বিতীয় হলো আমাদের গার্মেন্টের সকল কর্মীদের নতুন বছরে কমপক্ষে ৫ শতাংশ ইনক্রিমেন্ট দিতে হচ্ছে। তৃতীয় হলো অন্যসব ব্যয়ের মতো জ্বালানি ব্যয়ও বেড়েছে। এ সময় আমরা পরিস্থিতি ভালো হওয়ারও কোনো সম্ভাবনা দেখছি না।’

এ সংকট থেকে পরিত্রাণে সংগঠনটির কোনো পরিকল্পনা আছে কিনা জানতে চাওয়া হয় বিজিএমইএ প্রথম সহ-সভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের কাছে। তিনি বলেন, ‘পোশাক কারখানাগুলোর সার্বিক পরিস্থিতি খারাপ। বায়াররা পণ্য নিচ্ছেন না। রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধে ইউরোপ-আমেরিকার দেশগুলোতে ক্রেতার সংখ্যা কমে গেছে। তারা প্রয়োজনকে প্রাধান্য দিয়ে বিলাসিতা প্রায় বন্ধ করে দিয়েছে। এতে পোশাক বিক্রি সাংঘাতিকভাবে কমে গেছে। এছাড়া যেসব পোশাক আমাদের কাছে তৈরি করা আছে সেগুলো সামারের (গ্রীষ্ম)। এদিকে শীত চলে আসছে। সামারের এসব পোশাকের বাজার স্বাভাবিকভাবে কমে যাবে। তাই আমরা পণ্যের সিএমসি (কাটিং-মেকিং কস্ট বা উৎপাদন ব্যয়) ১০ থেকে ১৫ শতাংশ কমিয়ে দিচ্ছি।’

উৎপাদন ব্যয় কমিয়ে ক্রয়াদেশ কেমন পাওয়া যাচ্ছে প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘পোশাক যেমন প্রয়োজনীয় জিনিস, তেমনি শৌখিনতারও। প্রয়োজনের কেনাকেটা ছাড়া শৌখিনতার দিকে আগ্রহ নেই প্রকৃত ক্রেতাদের। অর্থনৈতিক মন্দার কারণে ক্রেতাদের চাহিদা অনেক কমে গেছে। এর একমাত্র কারণ হলো রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধ। তাই উৎপাদন ব্যয় কমিয়েও বায়ারদের কাছ থেকে কোনো অর্ডার পাচ্ছি না। মাস দুয়েক আগেও যেভাবে অর্ডার আসছিল এখন তা আনুমানিক চল্লিশ শতাংশ কমে গেছে। এ অবস্থায় চট্টগ্রামের কারখানাগুলোতে উৎপাদন কমে যাওয়ায় অনেক কারখানা মালিক যথাসময়ে শ্রমিকের বেতন পরিশোধ করতে পারছেন না।’