এ যেন মৃত্যুপুরী !

অর্ধশতাধিক নিহত, আহত ২ শতাধিক, আগুন লাগলে গেট বন্ধ করে দেয় দারোয়ান, ‘রাসায়নিক দ্রব্য থেকে বিস্ফোরণ’, চার কিলোমিটার দূরে শোনা যায় বিস্ফোরণের শব্দ

মো. নাছির উদ্দিন অনিক, সীতাকুণ্ড »

সীতাকুণ্ডে স্মরণকালের ভয়াবহ কন্টেইনার বিস্ফোরণে ৫০ জন নিহত ও ২ শতাধিক আহত হয়েছেন। শনিবার রাত সাড়ে ৯টায় সোনাইছড়িতে অবস্থিত বি এম কন্টেইনার ডিপোতে এ দুর্ঘটনাটি ঘটে। ফায়ার সার্ভিসের ২৩টি ইউনিট ১২ ঘণ্টার চেষ্টা ও সেনাবাহিনীর উদ্ধারকারী দলের সহায়তায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। আগুন নেভাতে গিয়ে নিহত হয়েছেন ফায়ার সার্ভিসের ৯ জন সদস্য। নিখোঁজ রয়েছে ৩ সদস্য।
চট্টগ্রাম নগরী থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পূর্ব পাশে ২৪ একর জায়গা জুড়ে অবস্থিত এ ডিপোতে বিস্ফোরণের শব্দ তিন কিলোমিটার দূর থেকেও শুনেছেন অনেকে এবং প্রচণ্ড কম্পনে পাশর্^বর্তী কাঁচের গ্লাস সম্বলিত বাড়ি ও অফিসের গ্লাস ভেঙেছে প্রায় ১৫০টি।
চমেক হাসপাতালে আহতদের সংখ্যা এত বেশি ছিল যে আগতদের কারও কারও নাম এন্ট্রি করা হয়নি। আঘাত অনুসারে তাদের বিভিন্ন ওয়ার্ডে পাঠানো হচ্ছে। তাই নিহত ও আহতদের তালিকা পাওয়া যায়নি। রাত হতে সকাল পর্যন্ত অ্যাম্বুলেন্স, প্রাইভেটকার, মাক্রোবাস, হিউম্যান হলার, সিএনজিচালিত অটোরিকশায় করে গুরুতর আহতদের আনা হয় চমেক হাসপাতালে। তাদের মধ্যে নিহতের এই সংখ্যা, তবে আশঙ্কা করা যাচ্ছে মৃতের সংখ্যা আরো বাড়বে।
আগুনের সূত্রপাত সম্পর্কে ফায়ার সার্ভিসের সদস্য এবং ডিপোতে থাকা শ্রমিকদের কাজ থেকে জানা য়ায়, রাসায়নিক দ্রব্যসমেত কন্টেইনার থেকে আগুন লাগার বিষয়টি স্পষ্ট। রাসায়নিক পদার্থের সংশ্লেষ থাকায় আগুনের লেলিহান শিখা ক্রমাগত গ্রাস করছিল অন্যান্য রাসায়নিক পদার্থ ও বিভিন্ন মালামাল থাকা কন্টেইনারগুলি। তাই কিছুক্ষণ পর পর কন্টেইনার বিস্ফোরণ হতে থাকে, সর্বমোট ৬টি কন্টেইনার বিস্ফোরণ হয় এবং এই বিস্ফোরণে প্রায় ১শ টি কন্টেইনারে আগুনের সংযোগ সৃষ্টি করে সমস্ত ডিপোতে আগুনের লেলিহান শিখা ছড়িয়ে পড়ে। ১ম কন্টেইনার বিস্ফোরণ হয় রাত নয়টায়। সর্বশেষ বিস্ফোরণটি হয় রাত ২.৩০ মিনিটে তাই আগুন নিয়ন্ত্রণে নিতে বেগ পেতে হয় ফায়ার সার্ভিসের সদস্যদের।
বিএম কন্টেইনার ডিপোতে কাজ করে এবং ঘটনার সময় স্পটে থাকা টিটু নামক এক শ্রমিক জানান, বিস্ফোরণের সাথে সাথে সবাই এদিক সেদিক দৌড়াদৌড়ি করে। দারোয়ান পিছনের গেটটি বন্ধ করে দেয়। আমরা কয়েকজন পিছনের বড় দেয়াল টপকে বাইরে আসি। যারা দেয়াল টপকে আসতে পারে নাই তারা সব মারা গেছে, এর জন্য কন্টেইনার ইয়ার্ডের মালিক দায়ী।
এদিকে ফৌজদারহাট- বায়েজিদ লিংক রোডটিতে শুধু আহতদের বহনকারী অ্যাম্বুলেন্স চলাচলের জন্য খোলা রাখা হয়েছিল। এছাড়া ভাটিয়ারি টু হাটহাজারী লিং রোডটি খুলে দেয়া হয়েছিল চট্টগ্রাম মিলিটারি হাসপাতালে (সিএমএইচ) রোগী নেয়ার জন্য। চমেক হাসপাতাল এলাকা থেকেও অনেক অ্যাম্বুলেন্স ঘটনাস্থলে আসে আহতদের হাসপাতালে নিতে।
ফায়ার সার্ভিসের উপসহকারী পরিচালক শাহজাহান শিকদার জানান, বিএম কন্টেইনার ডিপোতে ভয়াবহ আগুন লেগেছে। ফায়ার সার্ভিসের কাছে রাত ৯টা ২৫ মিনিটে আগুনের খবর দেওয়া হয়। প্রথমে সেখানে ৮টি ইউনিট যায়, এর পরবর্তীতে বিভিন্ন স্টেশন থেকে মোট ২৩টি ইউনিটে সর্বমোট ১৮৩জন আগুন নেভাতে কাজ করে। বিস্ফোরণের কারণে আগুন ছড়িয়ে পড়াতে অন্যান্য কন্টেইনার এবং শেডগুলিতে আগুন লাগে এবং নিহত ও আহতের সংখ্যা বেশি হয়।
বিএম কন্টেইনার ডিপোর পরিচালক মুজিবুর রহমান বলেন, কি কারণে আগুনের সূত্রপাত হয়েছে আমরা এখনো নিশ্চিত নই। তবে কন্টেইনার থেকেই আগুন ধরেছে বলে ধারণা করছি। নৈতিকতা ও মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে আমরা হতাহতদের পাশে থাকবো বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আহতরা যাতে সর্বোচ্চ চিকিৎসা পায় সে ব্যবস্থা করবো। চিকিৎসার সম্পূর্ণ ব্যয়ভার আমরা বহন করবো। এ দুর্ঘটনায় যারাই হতাহত হয়েছে তাদেরকে সর্বোচ্চ ক্ষতিপূরণ দেয়া হবে। পাশাপাশি সকল হতাহতের পরিবারের দায়িত্ব নেয়া হবে।

বিস্ফোরণে কম্পনের তীব্রতা শতাধিক বাড়ি ঘরের কাঁচের গ্লাস চুরমার

কন্টেইনার ডিপোতে বিষ্ফোরণে কম্পনের আওয়াজ এতটাই তীব্র ছিলো যে, আশেপাশের ১ কিলোমিটার এলাকার শতাধিক বাড়ি, ঘর, অফিস, মসজিদের কাঁচের গ্লাস ভেঙে খসে পড়ে। বিস্ফোরণের কম্পনে সোনাইছড়ি এলাকার দুলাল ও নুর মোহাম্মদ তারাকি জানান তাদের বিল্ডিং ঘরের কাঁচের জানালা সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছে, এছাড়া মাল্লাপাড়ার কাসেম জুট মিলস সংলগ্ন মসজিদটির চারিদিকের জানালার গ্লাস ভেঙে পড়ে। কন্টেইনার বিস্ফোরণের শব্দ এতোবেশি প্রকট ছিল মনে হচ্ছিল আকাশটা ফেটে বোধহয় জমিনে পতিত হচ্ছে, শব্দ ও কম্পনের ব্যাপকতা ৪/৫ কিলোমিটারের কম হবে না কথাগুলো বলছিলেন বার আউলিয়া নিবাসী সোনাইছড়ির আলাউদ্দিন।
মীর মামুন জানান, ঘটনাস্থল থেকে আমার বাড়ি ৪ কিলোমিটার এখানে যে শব্দ শোনা গেছে।