আমদানি-রপ্তানিতে গতি আসবে

ফেনী-বিলোনিয়া রেলপথ চালুর উদ্যোগ

নিজস্ব প্রতিবেদক »

দীর্ঘদিনের অচলায়তন ভেঙে আবারো সরব হচ্ছে ফেনীর বিলোনিয়া রেলস্টেশন। ফেনীর বিলোনিয়া হয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে মালামাল পরিবহন করার উদ্দেশে এ রেলপথ চালুর যৌথ উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ-ভারত সরকার। এমন আশা জাগানিয়া খবরটি জানা গেছে বাংলাদেশ রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ সূত্রে।
রেলমন্ত্রী মো. নূরুল ইসলাম সুজন এ বিষয়ে সরকারের ইতিবাচক পদক্ষেপের বিষয়টি তুলে ধরেন সম্প্রতি একটি গণমাধ্যমকে দেওয়া তাঁর বক্তব্যে। তিনি বলেন, ১৯৬৫ সালের পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধের সময় বিকল হয়ে যাওয়া রেলপথগুলো সংস্কার করে পুনরায় বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে রেলসংযোগের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে এবং নতুন করে আখাউড়া-আগরতলা ও ফেনী-বিলোনিয়া দুটি রেলপথ নির্মাণ করা হচ্ছে। ফলে দুই দেশের মধ্যে রেলপথে যাত্রী পরিবহনের পাশাপাশি পণ্য রপ্তানি-আমদানি প্রসার ঘটবে বলেও রেলমন্ত্রী আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
রেলওয়ে সূত্রে জানা যায়, ফেনী-বিলোনিয়া রেললাইন পুনঃস্থাপনের জন্য সম্ভাব্য সমীক্ষার কাজ দেওয়া হয় ভারতের হায়দারাবাদের আরভে অ্যাসোসিয়েটস আর্কিটেক্টস ইঞ্জিনিয়ারিং কনসালটেন্ট কোম্পানিকে। প্রতিষ্ঠানটি ফেনী-বিলোনিয়া রেললাইনের জন্য দুই লেন পুনঃস্থাপনের সম্ভাব্য সমীক্ষা শেষে ২০১৮ সালে বাংলাদেশ রেলওয়ের কাছে একটি প্রতিবেদন জমা দেয়।
বাংলাদেশ রেলওয়ের প্রধান পরিকল্পনাবিদ এস এম সলিমুল্লাহ বাহার ফেনী থেকে বিলোনিয়া রেলপথের একটি সমীক্ষা হয়েছে বলে সুপ্রভাতকে নিশ্চিত করেন।
সূত্র মতে, ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের বিলোনিয়ায় রেললাইন নির্মাণে সমীক্ষার কাজ শেষে আগরতলা স্টেশন থেকে বিলোনিয়া পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণে ৪০ একর ভূমি অধিগ্রহণ করা হয়। ইতোমধ্যে উত্তর-পূর্ব সীমান্তে নর্থ-ইস্ট ফ্রন্টিয়ার্স রেলওয়ে (এনএফআর) জমি জরিপের কাজ শেষ করেছে। চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য জরিপের রিপোর্ট ভারত সরকারের রেল বোর্ডের কাছে পাঠানো হয়েছে।
আগরতলা থেকে বাংলাদেশের আখাউড়া রেলওয়ে স্টেশনের মধ্যে রেলপথ স্থাপনের কাজ চলাকালে বিলোনিয়া থেকে বাংলাদেশের ফেনীর মধ্যে দিয়ে রেলপথ সংযোগ স্থাপনের জমির জরিপ করা হয়। এ রেল সংযোগের ক্ষেত্রে বিলোনিয়া রেলওয়ে স্টেশন থেকে ভারতীয় সীমান্ত পর্যন্ত রেলপথের দূরত্ব হবে ২ দশমিক ৯ কিলোমিটার। অপরদিকে, ভারত ও বাংলাদেশের সীমান্ত থেকে ফেনী রেলওয়ে স্টেশনের দূরত্ব ২৭ কিলোমিটার।
বাংলাদেশের অংশের জমির জরিপের কাজ করছে বাংলাদেশ রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। ২৪ কিলোমিটার রেললাইনের উপর অবৈধ ঘরবাড়ি, দোকানপাটসহ নির্মাণাধীন অবকাঠামো চিহ্নিত করা হয়েছে। নতুন এ রেলপথ স্থাপনের ফলে ত্রিপুরা ও বাংলাদেশের মধ্যে এটি হবে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক রেলপথ।
একসময়ের কর্মচঞ্চল বিলোনিয়া রেলস্টেশনটি পরিত্যক্ত হয়ে পড়ার বয়স প্রায় ২৬ বছরে ঠেকেছে। ১৯৯৭ সালের ১৭ আগস্ট রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ ফেনী-বিলোনিয়া রেলপথটি বন্ধ করে দেয় ক্রমাগত লোকসানের কথা বলে। আর তখন স্টেশনের কর্মচারীদের বদলি করা হয় রেলওয়ের অন্যান্য স্থাপনায়।
দীর্ঘদিন এ পথে রেলযোগাযোগ বন্ধ থাকায় প্রায় কয়েকশ’ একর সরকারি সম্পত্তি বেদখল হয়ে পড়েছে। রেললাইনের অস্তিত্ব বিলোপ হয়েছে, স্লিপারসহ কয়েক কোটি টাকার প্রয়োজনীয় সরঞ্জামও খোয়া গেছে।
আসাম বেঙ্গল রেলওয়ে কোম্পানি ১৯২৯ সালে বাংলাদেশের বিলোনিয়া দিয়ে ফেনী থেকে আসামের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের জন্য ব্রিটিশ সরকারের অর্থায়নে এ রেলপথ নির্মাণ করে। এ রেলপথ ধরে বন্ধুয়ার দৌলতপুর, আনন্দপুর, মুন্সিরহাটের পীরবক্স, নতুন মুন্সিরহাট, ফুলগাজী, চিথলিয়া, পরশুরাম ও বিলোনিয়া নামে আটটি স্টেশন স্থাপন করা হয় একই সময়ে।
এ রেলপথে মালবাহী ট্রেন চলাচল করতো। ১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান ভাগের পর দুটি লাইন আলাদা হয়ে যায়। তখন ভারতের অংশে ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। তবে বাংলাদেশ অংশে পরশুরামের বিলোনিয়া থেকে তৎকালীন ফেনী মহকুমা শহরের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য একটি ট্রেন চালু করা হয়। এসময়ে ফেনী শহর থেকে পরশুরামের বিলোনিয়া সীমান্ত পর্যন্ত প্রায় ২৮ কিলোমিটার রেলপথে একটি লোকাল ট্রেন চলতো।
এদিকে, বিলোনিয়া রেলস্টেশনের পাশে ফেনী জেলার পরশুরাম উপজেলার উত্তর সীমান্তে গড়ে উঠেছে বিলোনিয়া স্থলবন্দর। জানা যায়, বাংলাদেশ, মিয়ানমার, ভুটান ও চীন পরিবেষ্টিত ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোর চট্টগ্রাম বন্দর থেকে পণ্য পরিবহন সহজ করার লক্ষ্যে আখাউড়া-আগরতলার বিকল্প হিসেবে এ রেল রুট ব্যবহার করতে চায় ভারত।
বর্তমানে বিলোনিয়া স্থলবন্দর দিয়ে নিয়মিত বিভিন্ন পণ্য রপ্তানি হচ্ছে। এক্ষেত্রে ফেনী-বিলোনিয়া রেলপথটি পুনরায় চালু হলে যাতায়াত ব্যবস্থার সুবিধা বাড়ার পাশাপাশি ভারতের ত্রিপুরার সাথে বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য বাড়বে। এই স্থলবন্দর থেকে ফুলগাজী হয়ে ফেনী জেলা পর্যন্ত একটি রেলপথ সংযোগ রয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, বিলোনিয়া রেলপথ পুনরায় চালু হলে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে নতুন গতি সঞ্চার হবে। ব্যবসায়ীদের মতে, সড়ক পথের তুলনায় রেলপথে পণ্য পরিবহণ খরচ অনেক সাশ্রয়ী। বর্তমানে জ্বালানি তেল ও গ্যাসের দাম বাড়ার কারণে ফেনী-বিলেনিয়া সড়ক পথে পরিবহন ব্যয় প্রায় দুই-তিনগুণ বেড়ে গেছে। তাই পণ্য পরিবহনের জন্য অনেক টাকা গুনতে হচ্ছে। এ অবস্থায় ব্যবসায়ীরা আর্থিক ভোগান্তি থেকে পরিত্রাণ পেতে বিলোনিয়া রেলপথ চালুর পক্ষে জোর তাগিদ দিয়েছেন।