আন্দাজে ওষুধ কিনছে মানুষ

৬টি ওষুধের চাহিদা ও দাম বেড়েছে ১০ গুণ পর্যন্ত #
সালাহ উদ্দিন সায়েম :
বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানির আইভারমেকটিন গ্রুপের ইভেরা (৬ এমজি) ট্যাবলেট এক মাস আগে সারা দেশে ১০০ বাক্সের মতো বিক্রি হতো। ১ মাস ধরে এ ওষুধ কেবল চট্টগ্রাম নগরীতে দৈনিক বিক্রি হচ্ছে ৫ হাজার বাক্স!
ওষুধটির হঠাৎ এমন অস্বাভাবিক চাহিদার কারণ হলো, ভয়ঙ্কর করোনাভাইরাস থেকে মুক্ত থাকতে মানুষ এই ওষুধটি কিনতে হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন। বাক্স প্রতি (১০টি ট্যাবলেট) ১৫০ টাকা দামের এই ওষুধ ১ হাজার টাকায়ও কিনছে মানুষ।
শুধু ইভেরা নয়, বেক্সিমকোর প্যারাসিটামল গ্রুপের নাপা ও নাপা এক্সটেন্ড এবং স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানির এন্টিবায়োটিক এজিথ্রোমাইসিন গ্রুপের জিম্যাক্স ৫০০ এমজি ট্যাবলেট, কাশির ফেক্সোফেনাডিন গ্রুপের ফেক্সো ট্যাবলেট (৬০, ১২০ ও ১৮০ এমজি) এবং ভিটামিন-সি গ্রুপের সিভিট ট্যাবলেটের চাহিদাও চট্টগ্রামে ১০ গুণ বেড়েছে ।
নগরীর ফার্মেসিগুলোতে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এই ছয় ক্যাটাগরির ওষুধ অন্তত ৫০টির মতো কোম্পানি উৎপাদন করলেও চট্টগ্রামে স্কয়ার ও বেক্সিমকো কোম্পানির ওষুধের চাহিদা সবচেয়ে বেশি। আইভারমেকটিন গ্রুপের ডেল্টা কোম্পানির স্ক্যাবো ট্যাবলেটেরও চাহিদা বেড়েছে চট্টগ্রামে। এছাড়া ডক্সিসাইক্লিন গ্রুপের অপসোনিন ফার্মার ডক্সিন ক্যাপসুল ও রেনাটা কোম্পানির ডক্সিক্যাপ ক্যাপসুলের চাহিদা আগের চেয়ে পাঁচ গুণ বেড়েছে।
চট্টগ্রামে ৬ ক্যাটাগরির ওষুধ সরবরাহ দিতে হিমশিম খাচ্ছে স্কয়ার ও বেক্সিমকো কোম্পানি
নগরীর বিভিন্ন ফার্মেসিতে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, স্কয়ার কোম্পানির জিম্যাক্স ৫০০ এমজি, সিভিট ও ফেক্সো ট্যাবলেট এবং বেক্সিমকো কোম্পানির ইভেরা, নাপা ও নাপা এক্সটেন্ড-এই ৬টি ক্যাটাগরির ওষুধের ১০ গুণ চাহিদা বেড়েছে গত এক মাসে। বাজারে এসব ওষুধের সরবরাহ দিতে রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছে দেশের ব্র্যান্ডেড এ দুটি কোম্পানি। আর ক্রেতাদের অস্বাভাবিক চাহিদার কারণে ফার্মেসিতে গত এক মাস ধরে এসব ওষুধের চরম সংকট চলছে।
বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানির চট্টগ্রামের ডিপো ম্যানেজার মোহাম্মদ মহসিন সুপ্রভাতকে বলেন, আমাদের ইভেরা (৬ ও ১২ এমজি) ট্যাবলেট চট্টগ্রাম নগরীতে প্রতিমাসে ২-৩ বাক্সের বেশি বিক্রি হতো না। সেই ওষুধের এখন দৈনিক চাহিদা হলো ৫ হাজার বাক্স। নাপা ও নাপা এক্সটেন্ড ট্যাবলেট আগে মার্কেটে দৈনিক সরবরাহ হতো ৫ হাজার বাক্স করে। এই দুটি ট্যাবলেট এখন প্রতিদিন বাজারে ৫০ হাজার বাক্স সরবরাহ করছি। এরপরও সংকট। কারখানায় চট্টগ্রামের জন্য তিনটি ওষুধের ১০ গুণ উৎপাদন বাড়ানো হয়েছে, কিন্তু এরপরও মার্কেটে চাহিদা অনুপাতে আমরা সরবরাহ দিতে পারছি না।
স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানির চট্টগ্রামের ডিপো ম্যানেজার আবদুল মালেক সুপ্রভাতকে বলেন, চট্টগ্রাম শহরে আমাদের সিভিট ট্যাবলেট আগে সরবরাহ হতো দৈনিক ৫ হাজার বাক্স। গত এক মাস ধরে ৫০ হাজার বাক্সের ওপর সরবরাহ হচ্ছে। একইভাবে এন্টিবায়োটিক জিম্যাক্স ৫০০ এমজি ট্যাবলেট ও ফেক্সো ট্যাবলেটেরও ১০ গুণ চাহিদা বেড়েছে। মানুষের অস্বাভাবিক চাহিদার কারণে আমরা এসব ওষুধ সরবরাহ দিতে হিমশিম খাচ্ছি।
আন্দাজে ওষুধ কিনছে মানুষ
ফার্মাসিস্টদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, করোনা থেকে মুক্ত থাকতে অনেকে ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন ছাড়া আইভারমেকটিন, এজিথ্রোমাইসিন, ডক্সিসাইক্লিন ও ভিটামিন-সি গ্রুপের ওষুধ কিনতে আসছে। যার জ্বর, কাশি নেই সেও অপ্রয়োজনে এসব ওষুধ কিনছে। কেউ কোনো ওষুধ খেয়ে ভালো হলে তিনি ফেসবুকে সেটা স্ট্যাটাস দিচ্ছেন। মুহূর্তেই সেটা ছড়িয়ে পড়ছে। সাধারণ মানুষ এক ফার্মেসি থেকে আরেক ফার্মেসিতে এসব ওষুধ হন্যে হয়ে খুঁজছে।
সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নের একদল গবেষক দাবি করেছেন, তারা মাথার উকুন মারার ওষুধ ‘আইভারমেক্টিন’ ব্যবহার করে গবেষণাগারে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই করোনা ভাইরাসকে মেরে ফেলতে সক্ষম হয়েছেন।
বাংলাদেশের একদল চিকিৎসক করোনা আক্রান্ত রোগীদের এজিথ্রোমাইসিন, আইভারমেক্টিন ও ডক্সিসাইক্লিন প্রয়োগে ভালো ফল পেয়েছেন বলে দাবি করেছেন। তারা রোগীদের উপসর্গ অনুযায়ী এসব ওষুধ খেতেও বলছেন।
তিনটি ওষুধে করোনাকে মেরে ফেলার গবেষণার বিষয়টি মাস খানেক আগে ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে। মূলত এরপর থেকে এসব ওষুধ কিনতে ফার্মেসিতে লাইন ধরে মানুষ। একপর্যায়ে বাজারে এসব ওষুধের সংকট দেখা দেয়।
চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক এম এ সাত্তার সুপ্রভাতকে বলেন, অস্ট্রেলিয়া ও আমাদের দেশের কয়েকজন চিকিৎসক করোনা থেকে মুক্তি পেতে কয়েকটি ওষুধ প্রয়োগে কার্যকর ফল পাওয়ার দাবি করলেও তা বৈজ্ঞানিকভাবে এখনো পরীক্ষিত হয়নি। কিন্তু শহর থেকে গ্রামেগঞ্জে পর্যন্ত এসব ওষুধের গুজব ছড়িয়ে গেছে। শুধু করোনা পজিটিভ রোগীরা নয়, যার শরীরে কোনো উপসর্গ নেই সেও আন্দাজে এসব ওষুধ খাচ্ছে।
তিনি বলেন, এসব ওষুধ খেলে নানা ধরনের নিউরোলজিক্যাল সমস্যা হতে পারে। দুর্বল রোগীরা হার্ট অ্যাটাকও করতে পারেন। মস্তিষ্কে নানা ধরনের অসুবিধা হতে পারে। তাই অবশ্যই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ওষুধ খাওয়া উচিত হবে না।
হাসপাতালে করোনা পজিটিভ রোগীদের ওপর প্রয়োগ হচ্ছে না এসব ওষুধ
মানুষ ফার্মেসি থেকে আন্দাজে এজিথ্রোমাইসিন, আইভারমেক্টিন ও ডক্সিসাইক্লিন ক্যাটাগরির ওষুধ কিনে খেতে লাগলেও নগরীর সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন করোনা রোগীদের ওপর এসব ওষুধ প্রয়োগ করছেন না চিকিৎসকরা।
আন্দরকিল্লা জেনারেল হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের সিনিয়র কনসালটেন্ট ডা. আবদুর রব মাসুম সুপ্রভাতকে বলেন, করোনা রোগীদের ওপর এজিথ্রোমাইসিন, আইভারমেক্টিন ও ডক্সিসাইক্লিন প্রয়োগ নিয়ে কোনো পরীক্ষা হয়নি। কেবল চট্টগ্রাম নয়, দেশের কোনো সরকারি হাসপাতালে করোনা রোগীদের ওপর এসব ওষুধ প্রয়োগ হচ্ছে না।
পাঁচ কোম্পানির নয়টি ওষুধের তীব্র সংকট
স্কয়ার কোম্পানির জিম্যাক্স ৫০০ এমজি, ফেক্সো ও সিভিট ট্যাবলেট, বেক্সিমকো কোম্পানির ইভেরা, নাপা, নাপা এক্সটেন্ড, অপসোনিন কোম্পানির ডকসিন ও রেনাটা কোম্পানির ডকসিক্যাপ ক্যাপসুল এবং ডেল্টা কোম্পানির স্ক্যাবো ট্যাবলেট-এই নয়টি ওষুধ এখন নগরীর অধিকাংশ ফার্মেসিতে পাওয়া যাচ্ছে না। অনেক ফার্মেসিতে ‘নাপা, নাপা এক্সটেন্ড নেই’-কাগজে লিখে সাঁটিয়ে দিয়েছেন। চট্টগ্রামে ওষুধের বৃহত্তম পাইকারি বাজার হাজারি গলিতেও এই পাঁচটি কোম্পানির নয়টি ওষুধের সরবরাহ নেই বলে জানা গেছে। তবে যে কয়েকটা ফার্মেসিতে এসব ওষুধ রয়েছে তা গলাকাটা দামে বিক্রি হচ্ছে।
ওষুধ ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কৃত্রিম সংকট তৈরির অভিযোগ উঠলেও ভ্রাম্যমাণ আদালত গত ৭ জুন হাজারিগলিতে অভিযান চালিয়ে কোনো ফার্মেসিতে ওষুধের মজুদ পায়নি।
চট্টগ্রামের ওষুধ প্রশাসনের তত্ত্বাবধায়ক কামরুল হাসান সুপ্রভাতকে বলেন, হাজারিগলিতে আমরা ২৯টি দোকানে অভিযান চালিয়েছি। কিন্তু কোনো দোকানে সাম্প্রতিক সময়ে অধিক ব্যবহৃত ওষুধের মজুদ পাইনি। আসলে ব্যবসায়ীরা ওষুধের কৃত্রিম সংকট তৈরি করছে না। মূলত মানুষ অপ্রয়োজনে ও অধিক পরিমাণে ওষুধ কিনে বাজারে সংকট সৃষ্টি করেছে।
দেওয়ানহাট লাজ ফার্মার বিক্রেতা আল আমিন বলেন, বেশিরভাগ মানুষ এখন চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন ছাড়া ওষুধ কিনতে আসছে। যার গায়ে জ্বর নেই সেও প্যারাসিটেমল ও এন্টিবায়োটিক ওষুধ কিনে নিয়ে যাচ্ছে। মাস খানেক আগে অনেকে ৫-১০ পাতা করেও নাপা ট্যাবলেট কিনেছে।
সংকটে দাম বেড়েছে ১০ গুণ
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বেক্সিমকো কোম্পানির ইভেরা ৬ এমজি ট্যাবলেট ১ বাক্সের নিয়মিত মূল্য হলো ১৫০ টাকা। এই ট্যাবলেট নগরীর অনেক ফার্মেসিতে গোপনে ১ হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি করা হচ্ছে। একই কোম্পানির ১০ টাকা দামের এক পাতা নাপা ট্যাবলেট ২০ টাকা ও ১৫ টাকা দামের এক পাতা নাপা এক্সটেন্ড ৩০-৪০ টাকা দামে বিক্রি হচ্ছে।
স্কয়ার কোম্পানির ১ পাতা ১৮ টাকা দামের সিভিট ট্যাবলেট বিক্রি হচ্ছে ৪০-৫০ টাকা। অপসোনিন কোম্পানির ২৫ টাকা দামের ১ পাতা ডক্সিন ১০০ এমজি ক্যাপসুল বিক্রি হচ্ছে ৫০-৬০ টাকা। ওষুধের দাম বৃদ্ধির বিষয়ে বাংলাদেশ কেমিস্ট এন্ড ড্রাগিস্ট সমিতির চট্টগ্রাম জেলার সভাপতি সমীর কান্তি সিকদার সুপ্রভাতকে বলেন, ওষুধ কোম্পানিগুলো কয়েকটি ওষুধ ক্রেতাদের চাহিদা অনুযায়ী বাজারে সরবরাহ করতে পারছে না। এ কারণে বাজারে এসব ওষুধের সংকট দেখা দিয়েছে। আর এ সংকটকে পুঁজি করে অসাধু ব্যবসায়ীরা এসব ওষুধ বাড়তি দামে বিক্রি করছে।