অবৈধভাবে ‘পাঁচ হাজার’ জন্মনিবন্ধন

সার্ভার হ্যাক : জালিয়াতিতে ৪ জন গ্রেফতার

নিজস্ব প্রতিবেদক »

সার্ভার হ্যাক করে ১৫দিনে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক) ৫টি ওয়ার্ড থেকে ৫৪৬ জনের জন্মনিবন্ধন সনদ ইস্যু করা হয়। এছাড়া সাত মাসে চক্রটি প্রায় পাঁচ হাজার জন্ম নিবন্ধন করিয়ে দিয়েছে বলছে পুলিশ।

তবে তাদের ঠিকানা দেখানো হয়েছে জামালপুর, শরীয়তপুর, উখিয়া ও কক্সবাজারসহ দেশের বিভিন্ন জেলায়। এর মধ্যে রোহিঙ্গা থাকার কথাও নিশ্চিত করেছে সংশ্লিষ্টরা। এমন ঘটনায় হ্যাকার দলের ৪ জনকে গ্রেফতার করেছে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্র্যান্সন্যাশনাল ক্রাইমের (সিটিটিসি) একটি ইউনিট।

গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে সিটিটিসির অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি) আসিফ মহিউদ্দিন গ্রেফতারের বিষয়টি নিশ্চিত করে এ তথ্য জানান। গ্রেফতারকৃতরা হলেন মো. জহির আলম (১৬), মোস্তাকিম (২২), দেলোয়ার হোসাইন সাইমন (২৩) ও মো. আব্দুর রহমান আরিফ (৩৫)।

আসিফ মহিউদ্দিন বলেন, ‘সোমবার গভীর রাতে অভিযানে জন্মনিবন্ধন সনদ জালিয়াতি চক্রের চারজনকে গ্রেফতার করা হয়। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তারা ঘটনার সাথে জড়িত বলে স্বীকার করেন। হ্যাকারের কাজে ব্যবহৃত চারটি সিপিইউ, তিনটি মনিটর, একটি স্ক্যানার ও প্রিন্টার, দুটি প্রিন্টার এবং চারটি মোবাইল ফোন জব্দ করা হয়। তারা এসব কর্মকা-ে দীর্ঘদিন ধরে জড়িত। এ পর্যন্ত তারা জালিয়াতি করে ৫ হাজারেরও বেশি জন্ম নিবন্ধন সনদ ইস্যু করেছে বলে স্বীকার করেন।’

পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের উপকমিশনার মঞ্জুর মোর্শেদ বলেন, চক্রটি কোনোভাবে পাসওয়ার্ড সংগ্রহ করে অবৈধভাবে কাজটি করছে, নাকি অন্য কোনোভাবে, সেটি খতিয়ে দেখা হচ্ছে।’

‘এর সঙ্গে কয়েকটি চক্র জড়িত। যাদের ধরা হয়েছে, তারা ‘মাঠ পর্যায়ের’ তথ্য সংগ্রহকারী। মূলত যাদের জন্মনিবন্ধন সনদ প্রয়োজন, সে ধরনের লোকজন খুঁজে বের করে তারা তথ্য সংগ্রহ করেন। তাদের উপরে আরেকটি গ্রুপ আছে। তারা বিভিন্ন ব্যক্তির তথ্য সংগ্রহ করে তাদের চক্রের অন্যদের কাছে পাঠান। সেখান থেকেই তারা সার্ভারে ইনপুট করে।’

প্রতিটি জন্ম নিবন্ধন সনদের জন্য তারা ৫০০ থেকে ৮০০ টাকা করে নিতো জানিয়ে উপকমিশনার মঞ্জুর বলেন, ‘তারা গত সাত মাসে প্রায় পাঁচ হাজার জন্ম নিবন্ধন করেছেন বলে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছে।’

জানা যায়, চসিকের জন্মনিবন্ধন আইডি প্রথম হ্যাক করা হয় ২০২১ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি। ওইদিন দেশের জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধনের অফিসিয়াল সার্ভারের আপগ্রেডেশনের কাজ চলার সময় হ্যাক করে ৪০ নম্বর উত্তর পতেঙ্গা, ৬ নম্বর চকবাজার এবং ৪১ নম্বর দক্ষিণ পতেঙ্গা ওয়ার্ড কার্যালয়ের নাম ব্যবহার করে ১৮টি জন্মনিবন্ধন সনদ ইস্যু করা হয়। এর মধ্যে ১২টি ছিল রোহিঙ্গার নামে। এ ঘটনায় পতেঙ্গা ও চকবাজার থানায় পৃথক তিনটি মামলা করেন সংশ্লিষ্ট জন্মনিবন্ধন সহকারীরা।

এদিকে চলতি বছর ৮ জানুয়ারি আন্দরকিল্লা ওয়ার্ডের আইডি হ্যাক করে ইস্যু করা হয় ৪টি জন্মনিবন্ধন সনদ। এ ঘটনায় কোতোয়ালী থানায় ১৪ জানুয়ারি জিডি করেন জন্মনিবন্ধন ডাটা এন্ট্রি সহকারী সঞ্জীব আচার্য্য। এছাড়া ১০ জানুয়ারি ১৩ নম্বর পাহাড়তলী ওয়ার্ডের আইডি হ্যাক করে ১০টি, ১১ জানুয়ারি দক্ষিণ কাট্টলী ওয়ার্ডের আইডি হ্যাক করে ৭০টি এবং ২১ জানুয়ারি ৪০ নম্বর উত্তর পতেঙ্গা ওয়ার্ডের আইডি হ্যাক করে ৮৪টি জন্মনিবন্ধন সনদ ইস্যু করা হয়। একের পর এক হ্যাকিংয়ের ঘটনায় চিন্তিত কাউন্সিলর ও জন্মনিবন্ধন সহকারীরা। তাদের ধারণা, সংঘবদ্ধ প্রশিক্ষিত কোনও চক্র এই হ্যাকিং কর্মকা-ের সাথে জড়িত। চসিকের সার্ভার বারবার হ্যাক হওয়ার কারণ জানতে সংস্থাটির আইটি কর্মকর্তা মোহাম্মদ ইকবাল হাসানকে একাধিকবার ফোন করা হলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি। একইভাবে সার্ভার হ্যাক ও অভিযোগের বিষয় সম্পর্কে নগরীর সংশ্লিষ্ট ৫টি ওয়ার্ডের কাউন্সিলরদের সাথে ফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলে তিনজন কাউন্সিলর কল রিসিভ করেননি।

এর মধ্যে ৪০ নম্বর পতেঙ্গা কাউন্সিলর আবদুল বারেক কল ধরলেও এ বিষয়ে কথা বলার অনিচ্ছা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, ‘আমি অসুস্থ। কয়েকদিনের মধ্যে আমি দেশের বাইরে চলে যাবো। ডাক্তার নিষেধ করেছে আমাকে কথা না বলতে। আপনারা সকাল ১০টায় অফিসে যোগাযোগ করবেন। এসব বিষয় অফিস জানে। আমি এসব বিষয়ে এখন কথা বলতে ইচ্ছুক না।’

তবে ১১ নম্বর দক্ষিণ কাট্টলী ওয়ার্ড কাউন্সিলর মোহাম্মদ ইসমাইল বলেন, ‘আমাদের ওয়ার্ডের সার্ভার প্রথম হ্যাক হয়েছে ১০ জানুয়ারি। আমাদের সিরিয়ালের গড়মিল দেখে আমরা বুঝতে পারি। সেদিন ৭০টি জন্মনিবন্ধন উত্তোলন করেন হ্যাকাররা। এ ঘটনায় ১১ জানুয়ারি হালিশহর থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করি। যার নম্বর ৫৬৯। সোমবার রাতে সার্কিট হাউজে মেয়রের সাথে কথা হলে তিনি আমাদেরকে মামলার নির্দেশ দেন। বর্তমানে আমরা মামলার প্রক্রিয়ায় যাচ্ছি।’

একই প্রসঙ্গে কথা হলে চসিকের সচিব খালেদ মাহমুদ বলেন, ‘আমাদের এ পর্যন্ত তিনদিনে ৫টি ওর্য়াডে জন্মনিবন্ধন সার্ভার হ্যাকের ঘটনা ঘটেছে। এতে মোট ৫৪৬টি জন্মনিবন্ধন সনদ তৈরি ও ইস্যু করেছে হ্যাকাররা। এরমধ্যে ১১ নম্বর দক্ষিণ কাট্টলী ওয়ার্ডে সর্বোচ্চ ৪০৮টি, ৪০ নম্বর উত্তর পতেঙ্গা ওয়ার্ডের ৮৪টি, ৩৮ নম্বর দক্ষিণ মধ্যম হালিশহর ওয়ার্ডের ৪০টি, ১৩ নম্বর পাহাড়তলী ওয়ার্ডে ১০টি এবং ৩২ নম্বর আন্দরকিল্লা ওয়ার্ডের ৪টি।’

জন্ম নিবন্ধন সনদ ও অফিস ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সোমবার রাত নয়টায় সার্কিট হাউজে মেয়রের সাথে নগরীর বিভিন্ন ওয়ার্ড কাউন্সিলর, সহকারী সচিবদের সাথে মিটিং হয়। এছাড়া চসিকের পক্ষ থেকে আইনত ব্যবস্থা নিতে সাইবার ক্রাইমকে অভিযোগ করা হয়েছে। কাউন্সিলররা সংশ্লিষ্ট থানায় অভিযোগ করেছেন। এতে ৪০ নম্বর উত্তর পতেঙ্গা ওয়ার্ডের চারজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বর্তমান ৫ ওয়ার্ডে জন্মনিবন্ধন কার্যক্রম রেজিস্টারের অনুমতিক্রমে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত বন্ধ থাকবে এবং হ্যাকারদের ইস্যুকৃত ৫৪৬টি জন্মনিবন্ধন সনদগুলো বাতিল বলে গণ্য হবে।’

সনদ জালিয়াতি তদন্তে মাঠে দুদক
জন্মনিবন্ধন সনদ জালিয়াতির সাথে কাউন্সিলর কার্যালয়ের কেউ জড়িত আছে কি’না তা খতিয়ে দেখতে মাঠে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। গতকাল মঙ্গলবার সকাল ১১ টার দিকে ৫ নম্বর পাহাড়তলী ওয়ার্ড কাউন্সিলর কার্যালয়ে সংস্থাটি অভিযান পরিচালনা করেন। অভিযানে কাউকে গ্রেফতার করা না হলেও কাউন্সিলর কার্যালয়ের বিভিন্ন নথি সংগ্রহ করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন দুর্নীতি দমন কমিশন চট্টগ্রাম ১।

অভিযানের বিষয়ে জানতে চাইলে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) চট্টগ্রাম-১ এর সহকারী পরিচালক ফয়সাল কাদের বলেন, ‘সম্প্রতি বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত চসিকের সার্ভার হ্যাকার ঘটনায় কাউন্সিলর অফিসের কোন কর্মকর্তা জড়িত আছে কি’না এ বিষয়ে তদন্ত করতে একটি টিম গঠন করা হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে মঙ্গলবার থেকে একটি টিম মাঠে নেমেছে। কেন্দ্রীয়ভাবে জন্মনিবন্ধন সার্ভার বন্ধ থাকাতেই আমাদের কিছু তথ্য সংগ্রহ করা যায়নি। তবে বেশ কিছু নথি আমরা সংগ্রহ করেছি। নথিগুলো পর্যালোচনা করে দেখা হবে। এছাড়া ঘটনার সাথে কাউন্সিলর অফিসের কেউ জড়িত থাকলে তাদেরকে আইনের আওতায় আনা হবে।’