খরচের চাপে প্রতিমা শিল্পীরা

smart

নিজস্ব প্রতিবেদক »

কোনটা পুরোপুরি, কোনটার অর্ধেক কাজ শেষ হয়ে রাখা হয়েছে সারি-সারি প্রতিমা। লম্বা এক চৌকিতে গোলাপি, হলুদ, টিয়া, সাদা রংয়ে ভরা কোটায় রাখা হয়েছে পাঁচ-ছয় খানেক তুলি। আর তার পাশে দাঁড়িয়ে প্রতিমার গায়ে আঁচড় কাটছেন ষাটোর্ধ্ব এক বৃদ্ধ লোক। তার নাম অমল পাল। তিনি দেশ স্বাধীনতার ৫ বছর আগে থেকে প্রতিমা তৈরির কাজ করে আসছেন।

শুধুই তাই নয়, পূর্ব পুরুষের সবাই এ কাজে করে গেছেন। কিন্তু বংশ পরম্পরার পেশাটির হাল ধরার আর কেউ রইলোনা। বছর খানেক আগে প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসে হারিয়েছেন এক মাত্র পুত্রকে। আক্ষেপ করে বলেন, আমার তো বয়স হয়েছে। পরিবারের কাউকে দিয়ে যেতে পারলে শান্তি পেতাম। যার দায়িত্ব নেওয়ার কথা সে তো আর নেই। তবে আমার ৩ জন ছাত্র রয়েছেন। তারা যদি ধরে রাখতে পারে, থেকে যাবে পেশাটি।
অমল পাল চট্টগ্রাম নগরীর সদরঘাট এলাকায় আজ থেকে ত্রিশ বছর আগে গড়ে তুলেছেন লোকনাথ শিল্পালয়। প্রতিবছর পূজো এলে নগরীর অর্ধশত প্রতিমা তার হাতের ছোঁয়া পায়। এবার গত পাঁচ মাস আগে থেকে ৪৬টি প্রতিমা তৈরির কাজ করে যাচ্ছেন। কোনটার দাম ৪০ হাজার, আবার কোনটার দাম নেওয়া হয়েছে ৭০ হাজার টাকা। প্রতিমা তৈরির কাজ শেষ হলে সারা বছর লেগে যান পাথরের কাজে।

তিনি জানান, অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাবে প্রতিমা তৈরির রঙ, সুতলি, পুঁথির মালা, পরচুলা, চুমকি, মাটি সব কিছুর দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। এটেল মাটি দিয়ে প্রতিমা তৈরি করা হয়। এসব মাটিগুলো কর্ণফুলী নদী থেকে সংগ্রহ করা হয়। এক ঠেলা গাড়ি মাটির বর্তমান মূল্য ২৫শ’ টাকা। যার আগের মূল্য ছিলো অর্ধেকেরও কম। এভাবে ৪ ঠেলা গাড়ির মাটি দিয়ে একটি প্রতিমা হয়। সুতলির পূর্বের মূল্য ছিলো ৭০ টাকা, বর্তমান মূল্য ১৫০ টাকা। সেই সাথে বেড়েছে কর্মচারীর বেতন। গত পাঁচ মাস ধরে ১২ জন কারিগর ছিলো। শেষ প্রান্তে এসে তা দাঁড়ায় ১৯ জনে। যাদের প্রত্যেকের মাসিক বেতন ১৫ হাজার থেকে ৪০ হাজার টাকা। প্রতিমাসেই অন্য খরচ বাদ দিয়ে কর্মীর বেতনে যায় আড়াই লাখ টাকা। সেই অনুপাতে অর্থ বাড়িয়ে দেয়নি পূজাম-পগুলো। যার কারণে কাজ শেষ করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে বলেও জানান তিনি।

সদরঘাটের স্বর্গীয় দুলার পাল প্রতিমালয়ের প্রধান কারিগর সুজন পাল বলেন, আমাদের এবার ৪০টির মতো প্রতিমা তৈরির কাজ এসেছে। যেগুলো তৈরিতে এক টানা কাজ করে যাচ্ছেন ১৬ জন কর্মী। জিনিসপত্রের লাগাম ছাড়া বৃদ্ধি পেয়েছে। কোনটার দাম বেড়েছে দ্বিগুণ, আবার কোনটার দাম বেড়েছে তিন থেকে চারগুণ। প্রতিমার কাজ নেওয়ার আগে হিসেবের সাথে বর্তমানের হিসেবের কোন মিল নেই। মোট কথা আমাদের হিসেবই মিলছে না। জিনিসপত্র কিনতে গিয়ে প্রতিনিয়ত বাড়াতে হচ্ছে অর্থের অংক। কিন্তু হাতেগোনা কয়েক ম-প বাড়িয়ে দিলেও, অধিকাংশই বাড়াচ্ছে না।

একই অভিযোগ জানিয়ে দেওয়ানজী পুকুর পাড়ের ‘রপশ্রী’ কারিগর রতন পাল বলেন, দুয়েকটাতে সামান্য কিছু অর্থ বেঁচে গেলেও অধিকাংশ প্রতিমা তৈরিতে ক্ষতির হিসাব বইতে হচ্ছে। বেশ কয়েক বছরের সম্পর্ক ম-পগুলোর সাথে। তাই চালিয়ে নিতে হচ্ছে। পূজোও বেশি দিন বাকি নেই। লাভ-ক্ষতি দুটো সমন্বয় করে কাজগুলো দ্রুত শেষ করতে হচ্ছে। বর্তমানে প্রায় ৮০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। এবার ১৯ নগরে, ১৫টির মতো বাইরের কাজ পেয়েছেন বলেও জানান তিনি।

এ বিষয়ে মহানগর পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি আশীষ কুমার ভট্টাচার্য বলেন, সরকাররে পক্ষ থেকে প্রতি ম-পে ৫০০ কেজি চালের অনুদান থাকে, সেই সাথে সিটি করপোরেশন থেকে ৫ হাজার টাকা করে দেওয়া। এ নিয়ে সোমবার (২৬ সেপ্টেম্বর) মিটিং করে শিগগিরই তা প্রদান করা হবে। সামান্য অনুদান দিয়ে আসলে কিছুই হয়ে ওঠে না।

বৈশ্বিক মন্দার প্রভাবে জিনিস পত্রের দাম বেড়েছে। তা মাথায় রাখতে হবে সকলের। কিন্তু এ পরিস্থিতি সব সময়তো থাকবে না।

এবার চট্টগ্রাম নগরে ২৮৩টি ম-পে পূজা উদযাপন হবে। তারমধ্যে কোতোয়ালীতে ৮৬টি, চকবাজারে ৯, কর্ণফুলীতে ২১, সদরঘাটে ১৬, বন্দরে ২১, বাকলিয়ায় ৬, হালিশহরে ৮, বায়েজিদে ২২, আকবর শাহে ২৩, খুলশীতে ৯, চান্দগাঁওতে ১৯টি, বন্দরে ২১, পাঁচলাইশে ১১টি, ডবলমুড়িং ৪টি, পতেঙ্গা ১১, ইপিজেডে ৬ টিতে পূজা হবে বলে জানান তিনি।

তবে লাভ থাকুক আর নাই থাকুক শরতের কাশফুল, ঢাকের বাদ্য আর প্রতিমা তৈরির কারিগরদের ব্যস্ততা জানান দিচ্ছে দেবী দুর্গার আগমনের বার্তা। আগামী ১ অক্টোবর মহাষষ্ঠীর মধ্যদিয়ে চট্টগ্রামসহ সারা দেশে শুরু হচ্ছে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজা।