স্মৃতির পাতায় গফুর হালী ভাই

মো. সিরাজুল মোস্তফা »

চট্টগ্রাম তথা বাংলাদেশের অহংকার, মরমী, মাইজভা-ারী ও আঞ্চলিক গানের কিংবদন্তি গীতিকার, সুরকার ও শিল্পী আবদুল গফুর হালী। ১৯৯০ সাল থেকে তাঁর সাথে আমার হৃদয়ের সম্পর্ক। প্রথমে সেই গল্পটা বলি।
হযরত শাহসুফী সৈয়দ আহমদুল হক (র.) প্রতিষ্ঠিত আল্লামা রুমী সোসাইটিতে বাংলাদেশের মাসিক আলোচনা সভা ও ছেমা মাহফিল হতো। চট্টগ্রামের বাঘঘোনাস্থ রূহ আফজা কুটিরে সেই মাহফিলে আলোচক হিসাবে উপস্থিত থাকতেন আল্লামা রুমী সোসাইটি বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা হযরত শাহসুফী আহমদুল হক (র.), চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ড. জামাল নজরুল ইসলাম, এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ভিসি ড. আর আই চৌধুরী, ইতিহাসবিদ ড. আবদুল করিম, দৈনিক আজাদীর সম্পাদক অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ, ব্যারিস্টার বজলুস সাত্তার, পিএইচপি ফ্যামিলির চেয়ারম্যান আলহাজ সুফী মোহাম্মদ মিজানুর রহমানসহ সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা। সেই সময় আমি ছিলাম আল্লামা রুমী সোসাইটির সাংস্কৃতিক সম্পাদক। সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার সুবাদে আমার মাধ্যমে প্রথম সুফী মিজান সাহেবের সাথে গফুর হালী ভাইয়ের একটা সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে। পরবর্তীতে আন্তরিক ও পারিবারিক সম্পর্কে পৌঁছে যায়।
গফুর হালী ভাইয়ের গ্রামের বাড়ি পটিয়ার রশিদাবাদে আর আমার বাড়ি চন্দনাইশের মোহাম্মদপুর গ্রামে। দুটি গ্রাম পাশাপাশি এবং একই এলাকার বাসিন্দা হওয়ায় তাঁর সাথে আমার গভীর সম্পর্ক গড়ে ওঠে। পরবর্তীতে সেই সম্পর্ক আরো গভীর হওয়ার কারণ ছিল দুইজন একই তরিকার অনুসারী হওয়ার কারণে। তাঁর পীর ছিলেন গাউছুল আজম মাইজভা-ারী হযরত শাহসুফী সৈয়দ গোলামুর রহমান (র.) বাবাজান কেবলার ছোট শাহজাদা পীরে তরিকত হযরত শাহসুফী সৈয়দ শফিউল বশর (র.) মাইজভা-ারী হুজুর। আর আমার পীর ছিলেন বাবাজান কেবল কাবার খলিফা শাহসুফী সৈয়দ আবদুছ ছালাম ঈছাপুরী (র.)। গফুর ভাই প্রায় সময় আমাকে ম্যানেজার বলে ডাকতেন, তিনি মাঝে মাঝে বলতেন, ‘অ ভাই মোস্তফা সাব, ভা-ারী ভা-ারী হই হই জীবন কাডাইলাম, ভা-ারীয়ে কবুল গইল্য কি না হইত ন পাইল্যাম’। আমি বলতাম, গফুর ভাই আপনার কোন চিন্তা নেই, ভা-ারী আপনাকে অবশ্যই কবুল করবেন।
২০০৪ সালের কোনো একদিন গফুর ভাই আমাকে হঠাৎ ফোন করে মোমিন রোডের একটি গান রেকর্ডিং স্টুডিওতে যেতে বলেন। সেখানে যাওয়ার পর আমাকে জিজ্ঞাসা করেন আমার সাথে গানের ডায়েরি আছে কিনা। আমি হ্যাঁ বলার পর তিনি বলেন, ‘আমার ইচ্ছে আপনাকে দিয়ে কয়েকটি গান রেকর্ডিং করব।’ আমি বললাম, আমার তো এখন কোন প্রস্তুতি নেই। তখন তিনি বললেন, ‘কোনো প্রস্তুতির দরকার নেই, আপনি শুরু করেন’। সেই মুহূর্তে গফুর হালী ভাইয়ের অনুপ্রেরণায় আমি একসাথে ৮টি গান রেকর্ড করি, যা আমার জীবনে অমূল্য স্মৃতি হয়ে আছে।
সুফী মিজান সাহেবের তৃতীয় সন্তান, পিএইচপি ফ্যামিলির ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী মোহাম্মদ আনোয়ারুল হক চৌধুরী (প্রকাশ আনু শাহ) যাকে নামের সাথে শাহ্ উপাধি দিয়েছিলেন সৈয়দ আহমদুল হক, সেই আনু ফকির গফুর হালী জ্ঞানের গভীরতা দেখে তাঁর ভক্ত হয়ে যান এবং গফুর হালীর সৃষ্টিকর্মকে ধরে রাখার জন্য এবং পরবর্তী প্রজন্ম সেই গান সম্পর্কে বিশদ জানতে পারে সে জন্য গফুর হালীর গান ও নাটক নিয়ে স্বরলিপিসহ তিনটি গীতিকাব্য ‘সুরের বন্ধন’ ও ‘চাটগাঁইয়া নাটকসমগ্র’ সম্পাদনা করেছেন সাংবাদিক নাসির উদ্দিন হায়দার এবং গীতিকাব্য ‘শিকড়’ সম্পাদনা করেছেন মোহাম্মদ আলী হোসেন সোহাগ। আর মোহাম্মদ মহসিন সম্পাদিত ‘দিওয়ানে মাইজভা-ারী’। এসব বই চাটগাঁইয়া গানের ইতিহাসে একটা মাইলফলক বলে বিবেচিত হচ্ছে।
গফুর ভাই সবসময় বলতেন, ‘পিএইচপি ফ্যামিলির চেয়ারম্যান সুফী মিজান সাহেব, তার ছেলেরা বিশেষ করে আনোয়ারুল হক না থাকলে হয়তো আমার জীবনের সকল কর্ম ও সাধনা বৃথা যেত’। তিনি আরো বলতেন, ‘মোস্তফা ভাই, আপনি বিশ্বাস করুন পিএইচপি পরিবার আমার জন্য সবরকম সাহায্যের হাত বাড়িয়ে না দিলে আমার সঙ্গীত-সাধনা কঠিন হতো। আমার ভা-ারী দয়া করে তাদেরকে উসিলা করে দিয়েছেন’। গফুর হালী তার আর একজন দরদীর কথা সবসময় বলতেন, তিনি হলেন সাংবাদিক নাসির উদ্দিন হায়দার।
গফুর হালী বলতেন, তার দুটি সত্তা আছে। একটি হলো মাইজভা-ার আর অন্যটি হলো তাঁর গান। তাঁর গান সমূহ উপলব্ধি করলেই তাঁর সংগীত সাধনার স্বরূপ সম্পর্কে বোঝা যায়। তিনি গানের মাধ্যমে ¯্রষ্টার তালাশ করতেন। সৈয়দ আহমদুল হক আবদুল গফুর হালীকে লালন ফকির ও রমেশ শীলের সাথে তুলনা করতেন। আবদুল গফুর হালী চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানে বিশেষ অবদান রেখেছেন। তিনি সহ¯্রাধিক আঞ্চলিক গান রচনা করেছেন, তার গান গেয়ে দেশজোড়া খ্যাতি পেয়েছেন শেফালী ঘোষ, শ্যামসুন্দর বৈষ্ণব, কল্যাণী ঘোষ, শিমুল শীল ও নয়ন শীলের মতো শিল্পী। কবিয়াল রমেশ শীল, আস্কর আলী প-িতসহ চট্টগ্রামের কালজয়ী শিল্পীদের গানগুলো সংগ্রহ করে বিভিন্ন শিল্পীর মাধ্যমে নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরেছেন, এটা তার অনন্য কৃতিত্ব।
গফুর হালীর গান নিয়ে এখন আন্তর্জাতিক পর্যায়ে গবেষণা হচ্ছে-এটা সহজ কথা নয়। অথচ গফুর হালীর মতো একজন গুণির কদর আমরা করতে পারিনি, জীবদ্দশায় তাঁর যোগ্য মূল্যায়ন হয়নি। গফুর হালীর আসল দরদী ছিলেন সুফী মিজান সাহেব, তিনি গফুর হালীর মনের অবস্থা বুঝেন, যে কারণে মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত সুফী সাহেব তাঁর পাশে ছিলেন। গফুর হালীর শেষ ইচ্ছে পূরণের জন্য তাঁকে হেলিকপ্টারে করে মাইজভা-ার দরবারে নিয়ে গেছেন আনোয়ারুল হক। শুধু তাই নয়, গফুর হালীর জীবনের শেষ ইচ্ছে মাইজভা-ার দরবার জেয়ারত, বাবাজান কেবলার রওজার সামনে মাটিতে ধুলি ধূসরিত হওয়ার যে বাসনা, সেভাবেই তার নামাজে জানাজার ব্যবস্থা করা হয়। জানাজায় ইমামতি করেন শাহসুফী সৈয়দ শফিউল বশর মাইজভা-ারীর (র.) ছোট শাহজাদা সৈয়দ ডা. দিদারুল হকসহ অন্যান্য আওলাদ ও হাজার হাজার আশেক ভক্তবৃন্দ।
আমার মনে পড়ে, অন্তিম দিনে গফুর হালী ভাই বারবার তাঁর শেষ বই ‘দিওয়ানে মাইজভা-ারী’ নড়াচড়া করছিলেন, ইশারাতে আমাকে কী যেন বোঝাতে চাইছিলেন, হাতের আঙ্গুল দিয়ে বইটাতে কী যেন লিখেছিলেন। কিন্তু আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। পরে সাংবাদিক নাসির হায়দার আমাকে বললো, ‘কাকু, গফুর হালী চাচা সুস্থ থাকতে আমাকে বলেছিলেন, ‘দিওয়ানে মাইজভা-ারী’ বইয়ে যেন আপনার একটা লেখা নেওয়া হয়। সেটাই এখন তিনি আপনাকে বুঝাতে চাইছেন’। আমি অবাক হয়ে নাসির কাকুর দিকে তাকিয়ে রইলাম আর ভাবলাম এটাই ভা-ারীর নিদর্শন, না হয় আমার মতো একজন মুর্খ মানুষকে কেন তাঁর মহামূল্যবান বইয়ে তাও তাঁর জীবনের শেষ বই, সেখানে লেখা দিতে বলবেন।
সুফী মিজান ভাই গফুর হালীর কেমন দরদী ছিলেন সেটা বোঝা যায় তাঁর মৃত্যুল আগের দিনের ঘটনায়। ২০১৬ সালের ২০ ডিসেম্বর বিকালে মাউন্ট হাসপাতালে তখন নির্বাক গফুর হালী। পৃথিবীতে তার সবচেয়ে কাছের যে মানুষ সেই সুফী মিজানকে দেখতে চাইলেন গফুর হালী। সুফী সাহেব তখন শহরের আরেক প্রান্তে ছিলেন। গফুর ভাইয়ের ইচ্ছের কথা শুনে ছুটে আসলেন সুফী মিজান, তাঁর ছেলে মোহাম্মদ মহসিন ও আনোয়ারুল হক। সুফী মিজান সাহেবের কণ্ঠ শোনার পর সাথে সাথে চোখ খুললেন গফুর হালী, সুফী মিজানের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। অনেকক্ষণ বুকে ধরে রাখলেন প্রিয় মানুষকে। চোখের পানিতে বুক ভেসে যাচ্ছে গফুর হালীর, কথা বলতে চান, কিন্তু পারলেন না। ইশারায় খাতাÑকলম আনতে বলেন। সেখানে তিনি তাঁর জীবনের শেষ কথাটি লিখলেন। সেটা তাঁর পরম বন্ধু সুফী মিজান সাহেব সম্পর্কে। সুফী মিজান সম্পর্কে গফুর হালীর জীবনের শেষ যে কথা সেটা এখানে উল্লেখ করার সুযোগ নেই, কারণ এটা তাসওয়াফ জগতের কথা।
আমার মনে পড়ে, সেদিন ডাক্তার মামুন গফুর ভাইকে অনেক ডাকাডাকি করলেন, একটু কথা বলানোর জন্য, কিন্তু পারলেন না। ওই সময় আমি বললাম, ‘গফুর ভাই অনরলাই আর উগ্যা ভাবি চাইয়ুমনি? একই কথার প্রতিধ্বনি করলেন সুফী মিজান ভাইও, এই কথা বলার সাথে সাথে হেসে উঠলেন গফুর হালী। কী প্রাণখোলা হাসি! এটাই ছিল গফুর হালীর শেষ হাসি। মধুরতম হাসি দিয়ে পরদিন ভোর রাতে তিনি বিদায় নিলেন, চিরবিদায়। আমাদের এত ভালোবাসা, হৃদয়ের বন্ধন তিনি ছিন্ন করলেন। আমার মনে তুফান তুলল গফুর হালী ভাইয়ের সেই গান।
আমাদের সবার প্রিয় গফুর হালী ভাই ২০১৬ সালের ২১ ডিসেম্বর ভোর বেলা সবাইকে ছেড়ে চলে গেলেন, না ফেরার দেশে। রেখে গেলেন কিছু স্মৃতি আর কিছু কর্ম। দোয়া করি পরম করুণাময় দয়াল আল্লাহ তাঁকে বেহেস্তের আলা মোকাম দান করুন আমীন।
এতদিনে বুঝিত পাইল্যাম
আঁর লাই বলি তোর নাই আদর
ওরে হাতর উয়র হাত্তান রাখি হঅলি
ন ভুলিবি আঁরে জনমভর॥
লেখক : সভাপতি,
মাইজভা-ারী মরম গোষ্ঠী ও
উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক, পিপলস্ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড