স্বাধীনতার ঘোষণা সারারাত প্রচার করেছি

তৃণমূলে বঙ্গবন্ধুর সহচর শাহ বদিউল আলম

চট্টগ্রামে কিশোর বয়স থেকে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে যে ক’জন কর্মী কাজ করেছেন তাদের মধ্যে অন্যতম শাহ বদিউল আলম। বর্তমানে ফিরিঙ্গীবাজারের এয়াকুব নগরের বাসিন্দা ৭৯ বছর বয়সী বদিউল আলম ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ার সময় থেকেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাহচার্য পান। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্যরাতের পর গ্রেফতার হওয়ার আগে দেওয়া বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার বার্তা নিয়ে নগরীতে সারা রাত মাইকিং করেছেন। এরপর দিন দুপুরে (২৬ মার্চ) কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন এম এ হান্নান। সম্প্রতি কথা হয় বঙ্গবন্ধুর সেই সহচরের সাথে। কথোপকথনে তিনি জাতির জনকের সাথে বিভিন্ন স্মৃতি তুলে ধরেন সুপ্রভাতের প্রধান প্রতিবেদক ভূঁইয়া নজরুলের কাছে।

সুপ্রভাত বাংলাদেশ : বঙ্গবন্ধুর সাথে আপনার প্রথম দেখা হয় কখন ?

শাহ বদিউল আলম : ১৯৫৫ সালে মুসলিম হাইস্কুলে ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ার সময় লালদীঘি মাঠে একদিন ক্রিকেট খেলছিলাম। তখন দেখি মাঠে স্টেজ নির্মাণের কাজ চলছে। আর দুপুরের পর সেই মঞ্চে আওয়ামী লীগের মিটিং হয়। সেই মিটিংয়ে আবদুল হামিদ খান ভাসানী, জহুর আহমদ চৌধুরীসহ ফর্সা করে আরেকজন লোক বক্তৃতা দিয়েছিলেন। পরে জেনেছিলাম তিনি ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সেই বক্তৃতা শুনে আমি মুগ্ধ হয়ে যাই এবং সভা শেষে আন্দরকিল্লায় গিয়ে উনার সাথে দেখা করি এবং হ্যান্ডশেক করি। তখন জহুর আহমদ চৌধুরী আমার বাবার পরিচয় দিয়ে বঙ্গবন্ধুর সাথে আমাকে পরিচয় করিয়ে দেন। সেই থেকে যতোবার তিনি চট্টগ্রামে আসতেন আমি দেখা করতাম।

সুপ্রভাত  : ১৯৬৬ সালে ছয় দফা ঘোষণার সময় কোথায় ছিলেন?

বদিউল আলম : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছয় দফা দাবি উত্থাপনের সমাবেশে স্বেচ্ছাসেবকের দায়িত্বে ছিলাম। সমাবেশের আগের দিন রাতে বঙ্গবন্ধু দলবল নিয়ে ঢাকা থেকে রাতের ট্রেনে চট্টগ্রামে আসছিলেন। আমি কয়েকজনকে সাথে নিয়ে রাতে ফেনী চলে যাই। ভোরে ফেনীতে বঙ্গবন্ধুকে বহনকারী ট্রেনটি এলে আমি সেই ট্রেনে উঠে বঙ্গবন্ধুর বগিতে চলে যাই। বঙ্গবন্ধু আমাকে দেখে বলে, ‘তুই এখানেও চলে এসেছিস, নে নাস্তা কর।’ তারপর তিনি চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্টেশনে নেমে সদরঘাট শাহজাহান হোটেলের দ্বিতীয় তলার ৭ নম্বর কক্ষে গিয়ে বিশ্রাম নেন। আমাকে বলেন, লালদীঘিতে চলে যা, লোক সমাগম হলে ফোন দিবি। মাঠ লোকে লোকারণ্য হওয়ার পর লালদীঘির পাশে ছিল হোটেল আমানিয়া। সেই হোটেলে গিয়ে বঙ্গবন্ধুকে ফোন করলাম। আর এরপর তিনি সমাবেশ স্থলে এলেন এবং ৬ দফা ঘোষণা দিলেন।

সুপ্রভাত : বঙ্গবন্ধু চট্টগ্রামে এলে কোথায় উঠতেন?

বদিউল আলম : জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান চট্টগ্রামে এলে শাহজাহান হোটেল, ওয়ার্লেস হোস্টেল (বর্তমান মোটেল সৈকত), আর্মেনিয়া হোটেল এবং এম এ আজিজ ও জহুর আহমদ চৌধুরীর বাসায় উঠতেন। এছাড়া আর্মেনিয়া হোটেলের মালিক জাকিরুল হক চৌধুরীর বাসায়ও উঠতেন।

সুপ্রভাত : ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ চট্টগ্রামে কী ঘটেছিল?

বদিউল আলম : ২৫ মার্চ রাতে সোয়াত টিম চট্টগ্রামে অপারেশন শুরু করার কথা ছিল। রাতে আফাজ উদ্দিন নামে এক রিকশা চালক মারা গেল। চৈতন্যগলি কবরস্থানে তাকে দাফন করা হলো। রাত ১১টার পর শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি জহুর আহমদ চৌধুরীর বাসায় যাই। গিয়ে দেখি জহুর আহমদ চৌধুরীর স্ত্রী ডা. নুরুন্নাহার জহুর তৎকালীন চট্টগ্রামে জেলা প্রশাসক মোস্তাফিজুর রহমানের স্ত্রীর সাথে টেলিফোনে কথা বলছেন। কথা শেষ হলে ঢাকায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়িতে ফোন দিলাম। কিন্তু কেউ ফোন ধরছে না। পরে ট্রাঙ্ক কল বুক করার পর জানলাম তিনি গ্রেফতার হয়েছেন। একইসময় জহুর আহমদ চৌধুরী বাসায় এলেন, সাথে ছিলেন শহর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এম এ হান্নানও। তখন জানা গেল বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ডাক দিয়ে গেছেন। আর তা শুনার পর জহুর আহমদ চৌধুরী পাবলিসিটি করার জন্য আমাকে বললেন। তখন মাইক ও ওয়াসার একটি গাড়ি নিয়ে সারা শহরে মাইকিং শুরু করি। বঙ্গবন্ধুর বার্তা সবার মাঝে পৌঁছে দেই। সকাল পর্যন্ত চলে মাইকিং। ২৬ মার্চ দুপুরে এম এ হান্নান কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে জহুর আহমদ চৌধুরীর নির্দেশে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেন। পরবর্তীতে ২৭ মার্চ মেজর জিয়াউর রহমান দুই দফায় স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন।

সুপ্রভাত :  স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আপনার যোগাযোগ কতটা ছিলো?

বদিউল আলম : দেশ স্বাধীনের পরও বঙ্গবন্ধুর সাথে আমাদের যোগাযোগ ছিল। চট্টগ্রাম থেকে আমি ও নুর মোহাম্মদ বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে প্রবেশের অনুমতি পেতাম। একইসাথে আমরা বঙ্গবন্ধু ব্যক্তিগত গোয়েন্দা হিসেবেও কাজ করি।

সুপ্রভাত : গোয়েন্দা হিসেবে কী কাজ করেছেন?

বদিউল আলম : মূলত দলের অভ্যন্তরের খবরাখবর বঙ্গবন্ধুকে আমরা দিতাম। যতটা মনে পড়ে, তিনটি সংবাদ আমরা দিয়েছিলাম। এরমধ্যে কিছু কিছু সংবাদের পরিপ্রেক্ষিতে উনি ব্যবস্থা নিতেন। বঙ্গবন্ধুকে যখন বলা হলো বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম খুব বেড়ে যাচ্ছে। তখন তিনি বলতেন, সেপ্টেম্বরের পর ঠিক হয়ে যাবে। এছাড়া ১৯৭৫ সালের ২৬ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ। সমাবেশে যাওয়ার আগে একজন কর্নেলের সাথে আমাদের পরিচয় হয়। ওই কর্নেলের পোশাকের হাতের অংশটুকু ছেঁড়া ছিল। জানতে চাইলে কর্নেল বঙ্গবন্ধু সরকারের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করেন। পরে বঙ্গবন্ধুকে বিষয়টি জানানো হলে তিনি বলেন, সেপ্টেম্বরের পর ঠিক হয়ে যাবে। পরে জানা গিয়েছিল এই কর্নেল হলো ফারুক। তবে সেপ্টেম্বরের পর কী হবে তা জানার সুযোগ হয়নি, ঘাতকরা ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করেন। এই শোকে স্তব্ধ হয়ে গেলাম। আমি বঙ্গবন্ধুর জন্য চট্টগ্রামে কুলখানির আয়োজন করেছিলাম।