সেই গানের পাখিটি গেছে ওড়ে

আরিফুল হাসান »

লতা মঙ্গেশকর বিরানব্বই বছরে জাগতিক সুরের মায়া ছেড়ে অনন্তসুরের জগতে পাড়ি জমান। গানের পাখি এই কিংবদন্তি প্রায় সাত দশক ধরে সঙ্গীতামোদীদের হৃদয়ের খোরাক জুগিয়েছেন। গেয়েছেন ভারতীয় ছত্রিশটি আঞ্চলিক ভাষাসহ বাংলা হিন্দি ও বিদেশি ভাষায় প্রায় তিরিশ হাজার গান। তিনটি প্রজন্মের প্রিয় শিল্পী ছিলেন তিনি। এতো দীর্ঘকাল ধরে নিলাদ্রি জনপ্রিয়তা ধরে রাখা বিস্ময়কর প্রতিভারই প্রকাশ। সুরের জগতে তাই তিনি সেই বিস্ময়কর নাইটিংগেল, যার কণ্ঠের সুধায় আমোদিত হয়ে পথ ভুলে যায় মরুচারী পিয়াসী। অমিয় ঝরনাধারায় তিনি ভরিয়েছেন শ্রোতার প্রাণ। দিলে লাগিয়েছেন দোলা। মধুময়, জাদুময় সুরের খেয়ায় ভাসিয়ে নিয়েছেন অনুপম এক ভিন্নজগতে। তাঁর কণ্ঠের ভেতর শ্রোতা যেন কোথায় হারিয়ে যায়। যেন কোন সুদূরের দিগন্ত থেকে ভেসে আসে ধ্বনির কলতান। সম্মোহনে ডুবে-ডুবে তখন শ্রোতাা, শিল্পী ও সঙ্গীত একাত্ম হয়ে যায়। সুরলোকে জাগে উল্লাস। গান তখন নিজস্ব কোকিলের কণ্ঠে বসন্তধারায় ঝরতে থাকে।
দেশের সীমানা ছাড়িয়ে তারকণ্ঠের কারিশমা ছড়িয়ে গেছে দেশান্তরে। ভাষা ও ভাবের ব্যবধান মুছে এক অনঙ্গ সুরের মায়ায় বেঁধে দিয়েছেন সামগ্রিকতাকে। এ শুধু কণ্ঠের জাদু নয়, আরও বেশি, অন্যমাত্রার এক যোগ্যতা, ছিল যা লতা মঙ্গেশকরের। যা তাঁকে ভারতীয় শ্রেষ্ঠশিল্পীদের থেকেও করে তুলেছে মহান। উপমহাদেশে সাংস্কৃতিক ইতিহাসে তাই তিনি এমন এক উজ্জ্বল উপমা, যিনি শুধু তাঁর আপন আলোতেই পরিমাপ্য। আর এই অসীমতাই তাঁকে করেছে বিশ্ববিধৃত নাগরিকের প্রতিবিম্ব। ইংরেজি সাহিত্যের কথা উঠলেই যেমন উইলিয়াম শেক্সপিয়রের কথা মনে পড়ে, তেমনি ভারতীয় সংগীতের প্রসঙ্গ আসলেই একটানে চলে আসে লতা মঙ্গেশকরের নাম।
তাঁর গান মানুষের ভেতরগত আঘাতকে, ক্ষতকে, এমনকি না-পাওয়ার যন্ত্রণাকে এমন এক রসায়নে ব্যথাহীন অনুভবে নিয়ে যায়, যা যাপিত বর্ণনার অনেক ঊর্ধ্বে। আর তাঁর গায়কির তন্ময়তা শ্রোতাকে ভুলিয়ে দেয় সমস্ত বেদনার বিষাদ-প্রকরণ।
জ্যোতির্ময়ী এই শিল্পী ১৯২৯ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর বর্তমান মধ্যপ্রদেশ, তৎকালীন ইন্দোর রাজ্যের রাজধানী ইন্দোরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ছিলেন একজন মারাঠি ও কোঙ্কিণী সঙ্গীতজ্ঞ এবং মঞ্চাভিনেতা। প-িত দীননাথ মঙ্গেশকরের পারিবারিক আবহ লতাকে সংস্কৃতির দিকে নিয়ে যায়। পিতার হাত ধরেই সঙ্গীতের প্রেমবীজ তার হৃদয়ে প্রথিতহয়। তবে বাবা চাইতেন মেয়ে তাঁর ধ্রুপদি গানের আমেজেই থাকুক। সিনেমার গান তো দূরের কথা, অন্যকোনো সঙ্গীতেই বাবা-দীক্ষকের ছিল ঘোর আপত্তি। কিন্তু প-িত পিতা সংগীতের ক্লাসিকেল জগতে খুব বেশি সুবিধে করতে পারেননি। লতা যখন শৈশব অতিক্রান্তের সময়ে, তখনই থিয়েটার ব্যবসায় টাকা খুইয়ে থিয়েটার কোম্পানি বন্ধ করতে বাধ্য হন বাবা। আর তারও কিছ ুঅব্যবহিত পর ইহলোকের মায়াত্যাগ করে পাঁচ-পাঁচটিসন্তানকে অকূলে ভাসিয়ে পরলোকে পাড়ি জমান। তখন লতা তাঁর কিশোরী বয়সের অবুঝতা নিয়ে সংসারের দায় মেটাতে হতবিহ্বল হয়ে পড়েন। ছেড়ে দেন ইন্দোরের পারিবারিক বাড়ি। সবাইকে নিয়ে ওঠেন পশ্চিমের শহর পুনেতে।
জীবনের টানাপোড়েনে চল্লিশের দশকে শুধুমাত্র গানকে পুুঁজি করে তাঁর বেঁচে থাকাটা অসম্ভব হয়ে উঠলে তিনি সিনেমার জগতে অভিনয়েও নাম লেখান। তবে স্বভাবতই তিনি সেখানে কোনো উল্লেখযোগ্য ছাপ রাখতে পারেননি। আসলে, যে পাখির জন্ম শুধু গান করার জন্য, যে ফুলের সুরভি যে রকম মোহনীয়, তার তো এর ব্যতিক্রম হওয়ার সুযোগ নেই। তাই চলচ্চিত্রে অভিনয়ের পাশাপাশি সুযোগ খুঁজছিলেন সঙ্গীতে কিছু করার। আর সেই সুযোগটিই তাঁর হাতের মুঠোয় এনে দেয় মাস্টার গুলাম হায়দার। ১৯৪৯ সালে ‘মহল’ সিনেমার ‘আয়েগা আনেওয়ালা‘ গানটি তাঁকে নক্ষত্রসম মহামহিমায় উজ্জ্বল করে তোলে। তিনি তারপর আর পেছন ফিরে তাকাননি। একের পর এক গানের মাধ্যমে মানুষের হৃদয়ের নিভৃততম জায়গাটি দখল করে নেন। বলিউডের স্বর্ণযুগের সেই সূচনালগ্নটি থেকে প্রতিভাত পুষ্পের মতো পরবর্তী চার দশকে পাকিজা, মজবুর, আওয়ারা, মুগল-ই আজম, শ্রী ৪২০, আরাধনা, দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে জায়েঙ্গে এবং রোম-কম এর মতো দুই দশক ধরে চলাচ লচ্চিত্রগুলোতে জনপ্রিয় সব গানে কণ্ঠ দেন এই গানের পাখি।
লতা মঙ্গেশকরের কণ্ঠে এমন এক প্রথাহীন স্পর্ধা ছিল, যা নীরবতার ভাষাকেও সঙ্গীতময় করে তোলে অনায়াসেই। সরাসরি শব্দে যা প্রকাশ করা যায় না, যার বর্ণনা কথাপার্বনে বোঝানো সম্ভব নয়, সেই অব্যক্ত-অপ্রকাশিত ভাষার বাহন তাঁর সুরেলা কণ্ঠ। যেন অবিরাম মধুবরিষণ। যেন অবিরাম স্বর্গের ছন্দ নেচে ওঠে হৃদয়ে ও মনস্তাত্ত্বিক পরিধিজুড়ে। সীমান্ত ছাড়িয়ে বাংলা সিনেমা ও সঙ্গীত জগতেও ছিল লতা মঙ্গেশকারের দুর্বার রাজত্ব। প্রায় ২০০টি গানে তিনি কণ্ঠ দিয়েছিলেন টালিউড পাড়ায়। তাঁর গাওয়া অমর গানগুলোর মধ্যেÑ রঙ্গিলা বাঁশিতে, নিঝুম সন্ধ্যায়, কে প্রথম কাছে এসেছি, চলে যেতে যেতে দিন বলে যায়, বলছি তোমার কানে, যারে উড়ে যারে পাখি, সাত ভাই চম্পাÑ অবিস্মরণীয়।
নীরবতার অপর পারে, সন্ধ্যেমাখা সেই ঘোরলাগা কুয়াশা-ভাষার যে বিবমিষা, লতা মঙ্গেশকরের কণ্ঠে সেই অব্যক্ত তীব্র সঙ্গীত মূর্ত হয়ে ধরা দিয়েছে। তাঁর স্বরে এমন অধরাভাব, ভাষাকে বাক্সময় করে তোলা যা অন্য কারো পক্ষে হয়তো সম্ভব ছিল না। মোহাম্মদ রাফি, কিশোর কুমারসহ অপরাপর কিংবদন্তি পুরুষশিল্পীদের সাথে ডুয়েট গানেও তিনি ছিলেন অতুলনীয়া। কাজ করেছেন খ্যাতিমান চলচ্চিত্রনির্মাতা রাজকাপুর, গুরু দত্ত, মণিরতœমসহ আরও অনেকের সঙ্গে। ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকার জন্য যে বিশাল সুরসম্ভার তিনি রেখে গেছেন, প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে তিনি সেসবের মাধ্যমে সুধীমহলে সমাদৃত হয়ে থাকবেন। থাকবেন চিরবরণীয় হয়ে। তাঁর কণ্ঠ এমনই এক অমোঘ আশ্রয়, যেখানে শ্রোতার একাকিত্বকে অবলোকন করে তার নিঃসঙ্গতার ভাষাকে অবমুক্ত করতে পারে। যেখানে শুধুই মায়া, যেখানে শুধুই জীবন। আর জীবনের বয়ে চলা অনন্তে ধ্বনিত অফুরন্ত আনন্দের ফোয়ারা। তাঁর গাওয়া অনেক বাংলাগান হয়তো হাজার বছর ধরে মানুষের মুখে-মুখে ফিরবে। Ñপ্রম একবারই এসেছিল নীরবে, আষাঢ়-শ্রাবণ মানে না তো মন, ও মোর ময়না গো, ও পলাশ ও শিমুল প্রভৃতি গান তাঁকে বাংলা ভাষাভাষীদের কাছে অমর করে রাখবে।
কিছ-ুকিছু মানুষের জীবন শুধুইজীবন। জীবনের পরিভাষা তারা জানে না। কাঠামোগত প্রাত্যহিক বোঝা টেনে দিন শেষে সন্ধ্যাপ্রদীপ জ্বালিয়ে আরতি দেয় কেবল। এর বাইরে অন্য এক অবারিত জীবনের ছোঁয়া তারা পায় না। আবার অনেকে সে জীবন থেকে অতিক্রমণের পর এমন এক মহৎজীবনের আশ্রয় নেয়, যেখানে শুধুই সৌন্দর্যের অবারিত সমাহার, যেখানে অফুরš Íউৎসবের ভেতর অন্য এক নান্দনিক যাপন শাণিত হয়। সেই উজ্জ্বল জন্মযাপনের পথে লতা মঙ্গেশকর প্রথাগত বিয়েশাদি করেননি। সংসার যাপনের ফাঁদে তিনি আটকা পড়েননি। কিন্তু তাই বলে জীবনকে উপভোগের ক্ষেত্রে তিনি কোনোরূপ পরাজিত কেউ নন। সংগীতের সমৃদ্ধ কীর্তি তাঁকে দিয়েছে দুহাত ভরে অগাধ ঐশ্বর্য। ভারতের সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মাননা ‘ভারতরতœ’ (২০০১), দ্বিতীয় সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মাননা ‘পদ্মবিভূষণ’ (১৯৯৯) এবং তৃতীয় সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মাননা ‘পদ্মভূষণ’ (১৯৬৯) সহ দেশে-বিদেশে অসংখ্য পুরস্কার, পদক, সম্মাননা ও সাম্মানিক নাগরিকত্বে ভূষিত হয়েছেন। ১৯৭৪ সালে সবচেয়ে বেশি গান রেকর্ড করার জন্য ‘গিনেজ বুক অব রেকর্ড’Ñএ তাঁর নাম ওঠে। তাঁর গান প্রকৃতি ও প্রতিবেশের ভেতর ভালোবাসাময় এক রহস্যভাষা তৈরি করে। যা শ্রোতাকে এমন এক পর্যায়ে নিয়ে যায় যাতে গানের অন্তর্গত বিষয়-ভাবনাকে শ্রোতা নিজেই মূর্ত ও সার্থক করার জন্য উৎফুল্ল হয়ে ওঠে। তাই তিনি যখন গান করেন, বনের পাখিরাও চুপ হয়ে শোনে যেন তাঁর গান। এই কিংবদন্তি শিল্পীর প্রস্থান বিশ্বসঙ্গীতের এক অপূরণীয় ক্ষতি।