শুধু নামেই বড় প্রকল্প …

বে টার্মিনাল #

ভূঁইয়া নজরুল »

বে টার্মিনালকে বলা হচ্ছে আগামীর বন্দর। এ নিয়ে অনেক হাকডাক আর অতিকথনও হয়েছে। ২০১০ সালে এই বন্দর নিয়ে আলোচনা শুরু হওয়ার পর ২০১২ সালে পরিকল্পনা গ্রহণ, ২০১৪ সালে জেলা প্রশাসনের কাছে ভূমি বরাদ্দের আবেদন এবং একই বছরে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) থেকে অনুমোদনের জন্য আবেদনের পর ১০ বছর অতিবাহিত হলেও বাস্তবিক অর্থে এই প্রকল্পের অগ্রগতি নেই। অথচ ২০১৭ সালে মাতারবাড়ি বন্দর আলোচনায় এসে ইতোমধ্যে পরামর্শক প্রতিষ্ঠানও নিয়োগ হয়ে গেছে। নির্মাণ হয়ে গেছে ব্রেক ওয়াটার ও ১৮ মিটার ড্রাফটের কৃত্রিম চ্যানেল। বিপরীতে ভৌগোলিক সুবিধাজনক অবস্থান এবং সড়ক ও রেলপথের সংযোগের আওতায় থাকা বে টার্মিনাল প্রকল্প আলোচনার টেবিল ও মিডিয়ায় ঝড় তুললেও বাস্তব অগ্রগতি শূন্যের কোঠায়।

চট্টগ্রাম ইপিজেডের পেছন থেকে দক্ষিণ কাট্টলী রাসমনি ঘাট পর্যন্ত সাগরপারে সাড়ে ৬ কিলোমিটার দীর্ঘ এলাকায় বে টার্মিনাল নির্মাণের পরিকল্পনা নেয়া হয়। আগামীর বন্দর বলে খ্যাত বে টার্মিনালে দিন-রাত ২৪ ঘণ্টা জাহাজ চলাচল করতে পারবে। প্রসঙ্গত, বর্তমান জেটিতে জোয়ার ভাটার নির্ভরতা রয়েছে। এছাড়া বিদ্যমান জেটিতে কোনো জাহাজকে বার্থ করতে হলে সাগর থেকে ১৫ কিলোমিটার ভেতরে প্রবেশ করতে হয় কিন্তু বে টার্মিনাল হলে এক কিলোমিটারের মধ্যে জেটিতে বার্থ করতে পারবে জাহাজগুলো। বিদ্যমান বন্দরের জেটিতে একসাথে ১৯টি জাহাজ ভিড়তে পারলেও বে টার্মিনালে প্রায় ৩৫টি জাহাজ একসাথে বার্থ করতে পারবে। এমন  অনেক সুবিধা রয়েছে বে টার্মিনালের। তারপরও পিছিয়ে কেন?

পিছিয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই জানিয়ে চিটাগাং চেম্বার অব কমার্সের প্রেসিডেন্ট মাহবুবুল আলম বলেন, ‘দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য সবার আগে প্রয়োজন বে টার্মিনাল। সাগরের উপকূলের এই ভূমির পাশে ঢাকা-চট্টগ্রাম হাইওয়ে, পর্যাপ্ত ভূমি এবং রেললাইনসহ সব ধরনের সুযোগ সুবিধা রয়েছে। যে হারে আমদানি রপ্তানি বাড়ছে সেজন্য এখনই তা প্রয়োজন।’

জন্ম থেকেই পিছিয়ে বে টার্মিনাল

পিছিয়ে থাকার কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে দেখা যায়, বে টার্মিনাল প্রকল্প আতুরঘর থেকেই পিছিয়ে। ২০১৪ সালের ৩ আগস্ট প্রকল্পটির অনুমোদনের জন্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) কাছে আবেদন করা হয়। সাধারণত ৪৫ দিনের মধ্যে সিডিএ কোনো প্রকল্পের অনুমোদন দিলেও দেশের গুরুত্বপূর্ণ এই প্রকল্পটির অনুমোদন দিতে সময় নেওয়া হয় হয় ১৭ মাস। ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে ১২ শর্তে এর অনুমোদন দেয় সিডিএ।

সিডিএ যেখানে ১৭ মাস পর অনুমোদন দেয় সেখানে ভূমি বরাদ্দ আরো দীর্ঘায়িত হয়। ২০১৪ সালের মে মাসে জেলা প্রশাসনের কাছে ভূমি বরাদ্দের পৃথক দুটি আবেদন করে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। প্রকল্পের আওতায় ৮৮৮ একর ভূমির মধ্যে ৬৮ একর অধিগ্রহণ প্রক্রিয়ায় বরাদ্দের জন্য এবং ৮২০ একর আবেদন করা হয় বন্দোবস্ত প্রক্রিয়ায় বরাদ্দের জন্য। অধিগ্রহণ প্রক্রিয়ায় আবেদন করা ৬৮ একরের মধ্যে ৬৭ একরের (এক একর বাদ যায়, প্রকল্প এলাকায় থাকা খালগুলোর জন্য) বরাদ্দ পায় ২০১৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর। তাহলে দেখা যাচ্ছে চার বছর চার মাস সময় লেগেছে গুরুত্বপূর্ণ এই প্রকল্পের ভূমির বরাদ্দ পেতে।

বাকি ৮২০ একর জায়গা কোথায়? সেই ভূমি বরাদ্দের খবর কী? এখানেও পিছিয়ে এই প্রকল্পটি। ২০১৪ সালে বন্দোবস্ত প্রক্রিয়ায় ভূমি বরাদ্দের জন্য যে আবেদন বন্দর কর্তৃপক্ষ করেছিল তা যথাযথ ছিল না। এই ভূমি বরাদ্দ দিতে গিয়ে ভূমি মন্ত্রণালয় দেখতে পায়, ২৪ বছর আগে (১৯৯৬-৯৭ সালে) সাগরের উপকূলের এসব খাস জমি জেলা প্রশাসন ৫০টি ব্লকে ভাগ করে রেজিস্ট্রি দলিলের মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যক্তির কাছে ৯৯ বছরের জন্য লিজ দিয়েছিল। আর লিজ দেয়া জমি বন্দোবস্ত প্রক্রিয়ায় বরাদ্দ দেয়া যায় না, অধিগ্রহণের মাধ্যমে বরাদ্দ নিতে হয়। বন্দোবস্ত প্রক্রিয়ায় ৮২০ একর ভূমি বরাদ্দ দেয়া সম্ভব নয় বলে পরবর্তীতে ২০১৮ সালের জুনে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ দ্বিতীয় দফায় ভূমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়ায় বরাদ্দের জন্য আবেদন করে। সেই আবেদনে এখনো ভূমি বরাদ্দ পাওয়া যায়নি। তবে এ বিষয়ে আশাবাদ ব্যক্ত করে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার এডমিরাল এস এম আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘ভূমি বরাদ্দের বিষয়টি শিগগিরই চূড়ান্ত হয়ে যাওয়ার কথা রয়েছে।’

কনটেইনার ডেলিভারি ইয়ার্ড নির্মাণ হয়নি

২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে ৬৭ একর ভূমি বরাদ্দ পাওয়ার পর জেলা প্রশাসনকে ৩৫২ কোটি ৬২ লাখ টাকার চেক হস্তান্তর অনুষ্ঠানে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের তৎকালীন চেয়ারম্যান রিয়ার এডমিরাল জুলফিকার আজিজ ঘোষণা করেছিলেন, ‘এক বছরের মধ্যে বে টার্মিনালে কনটেইনার ডেলিভারি ইয়ার্ড নির্মিত হবে। আর তা হলে চট্টগ্রাম বন্দরে প্রতিদিন আসা যাওয়া করা প্রায় চার হাজার ট্রাক-লরিকে নগরের ভেতরে প্রবেশ করতে হবে না।’ কিন্তু এখন পর্যন্ত সেই ইয়ার্ড নির্মিত হয়নি। অবাক করা বিষয় হচ্ছে, কনটেইনার ডেলিভারি ইয়ার্ড নির্মাণের জন্য যে প্রকল্পটি নৌ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছিল সেই প্রকল্পটি অনুমোদনই পায়নি। কিন্তু অনুমোদনের আগেই নৌ কল্যাণ সংস্থাকে দুটি ইয়ার্ড নির্মাণের মাটি ভরাটের কাজের অনুমোদন দেয়। ধীরলয়ে মাটি ভরাটের কাজ চলমানও রয়েছে।

সবার আগে প্রয়োজন মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়ন

বে টার্মিনালে সবার আগে প্রয়োজন মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়ন করা। এবিষয়ে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের বর্তমান চেয়ারম্যান রিয়ার এডমিরাল এস এম আবুল কালাম আজাদ বলেন, বে টার্মিনাল নিয়ে একটি পরিপূর্ণ পরিকল্পনা অর্থাৎ একটি মাস্টারপ্ল্যান করার প্রয়োজন ছিল। সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের পর সেই মাস্টারপ্ল্যান বা পরিপূর্ণ স্টাডির কাজটি একটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান তৈরি করতো। সেই পরিকল্পনার ভিত্তিতে কনটেইনার ডেলিভারি ইয়ার্ড নির্মাণসহ পুরো বে টার্মিনালের সামগ্রিক কাজ করা হতো। কিন্তু সেই স্টাডি তো হয়নি। আমি এখন সেই স্টাডি করার জন্য পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ দিচ্ছি। সব চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। সরকারের অনুমোদন পাওয়া গেলেই পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের নাম ঘোষণা করা হবে।

তিনি আরো বলেন, পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের স্টাডি রিপোর্ট পাওয়ার পর ব্রেক ওয়াটার ও চ্যানেল নির্মাণে অর্থায়ন কে করবে এবং টার্মিনাল নির্মাণের দায়িত্ব কাকে দিয়ে করা হবে সেই সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। কিন্তু সবকিছু নির্ভর করছে স্টাডি রিপোর্টের ওপর।

বে টার্মিনাল নিয়ে ভূ-রাজনীতি

বে টার্মিনালের বিষয়ে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের একাধিক শীর্ষ কর্মকর্তা এবং ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দের সাথে কথা বলে জানা যায়, বে টার্মিনাল নিয়ে ভূ-রাজনীতি চলছে। চট্টগ্রাম বন্দরকে এই ভূ-রাজনীতিকে মাথায় নিয়েই সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। সরকার সরকার কোন দেশকে তা নির্মাণের দায়িত্ব দেবে এটা সরকারের বিষয়। ইতিমধ্যে কোরিয়া, সিঙ্গাপুর, দুবাই, ভারত, অস্ট্রেলিয়া, সৌদিআরবসহ বিভিন্ন দেশ থেকে অনেক প্রতিষ্ঠান বে টার্মিনাল নির্মাণে আগ্রহ দেখিয়েছে। এখন কার কেমন স্বার্থ, কে কী প্রস্তাব দেয় তা দেখার বিষয় রয়েছে। এগুলোর সাথে রয়েছে ব্রেক ওয়াটার (সাগরের ঢেউকে বাধা দেয়ার জন্য একটি দেয়াল) ও চ্যানেল নির্মাণ  (যে পথ দিয়ে জাহাজ জেটিতে ভিড়বে)। আর চ্যানেলটি গতিশীল রাখার জন্য নিয়মিত ড্রেজিং কার্যক্র তো রয়েছে। এসব কিছু বিবেচনার পর কোনো দেশ প্রস্তাবনা দেবে। পিপিপি এর ভিত্তিতে প্রস্তাবনা দিলে প্রস্তাবনাকারী প্রতিষ্ঠান কিছু ঝুঁকি বন্দরের উপর চাপিয়ে দিতে পারে। তাই সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।

জানা যায়, এই প্রকল্পটি পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ পদ্ধতিতে বাস্তবায়ন  হবে সেটি চূড়ান্ত, কিন্তু এটি কে নির্মাণ করবে? বে টার্মিনালে তিনটি টার্মিনাল (দুটি কনটেইনার ও একটি মাল্টিপারপাস টার্মিনাল) হবে। এই তিনটি কি একটি প্রতিষ্ঠান না অনেকগুলো উপভাগে ভাগ করে নির্মাণের দায়িত্ব দেয়া হবে? এধরনের অনেকগুলো প্রশ্নের সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এসব সিদ্ধান্ত সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে আসতে হবে।

উল্লেখ্য, ইপিজেড থেকে দক্ষিণ কাট্টলী রাসমনি ঘাট পর্যন্ত সাগরের ভেতরের প্রায় ২৩০০ একর জায়গায় বে টার্মিনাল নির্মাণের প্রকল্প নেয় বন্দর কর্তৃপক্ষ। জোয়ার-ভাটা, দিন-রাত, বাঁকা চ্যানেল কিংবা ড্রাফটের বিবেচনা কর্ণফুলী নদীর জেটিতে ভিড়লেও বে-টার্মিনালের ক্ষেত্রে সেই সীমাবদ্ধতা নেই। বে টার্মিনাল নির্মাণ হলে যেকোনো দৈর্ঘ্য ও প্রায় ১২ মিটার ড্রাফটের জাহাজ এখানে ভিড়তে পারবে। বিপরীতে বর্তমান চ্যানেলে মাত্র ১৯০ মিটার দৈর্ঘ্য ও সাড়ে ৯ মিটার ড্রাফটের জাহাজ কর্ণফুলীতে প্রবেশ করতে পারে। সেইক্ষেত্রেও জাহাজকে দুটি বাঁক অতিক্রম করতে হয় এবং দিনের মাত্র চার ঘণ্টা সময় পাওয়া যায়। কিন্তু বে টার্মিনালে ২৪ ঘণ্টা জাহাজ পরিচালনা করা যাবে। বন্দরের জেটির দৈর্ঘ্য চার কিলোমিটার হলেও বে টার্মিনালের দৈর্ঘ্য হবে ৬ দশমিক ৫ কিলোমিটার। মিরসরাইয়ে বঙ্গবন্ধু শিল্পনগর, কর্ণফুলীর ওপারে চায়না ইকোনমকি জোন এবং আগামীতে উপকূলীয় এলাকায় গড়ে উঠা শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোতে খুব সহজে সাপোর্ট দিতে পারবে ল্যান্ড লর্ড পদ্ধতিতে চালু হতে যাওয়া এই বে টার্মিনাল।