রেলে চড়ে কক্সবাজার

রুশো মাহমুদ »

রেলপথ চট্টগ্রাম আসার গোড়ার কথা

শ্রীহট্টের সুস্বাদু চা-বিলাতি বাবুদের পছন্দের তালিকায় একেবারে ওপরের দিকেই ছিলো। চা পরিবহন ও রপ্তানির জন্য বন্দর ব্যবহারের সুবিধা নিতে চট্টগ্রাম পর্যন্ত রেলপথ বিস্তৃত করা ব্রিটিশ সরকার জরুরি মনে করেছিলো। বাণিজ্যের মসৃণতা নিশ্চিত করাই ছিলো আসামের ডিব্রুগড় থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত একটি মিটারগেজ রেলপথ নির্মাণের মূল উদ্দেশ্য।

 ১৮৮১ থেকে ১৮৮৭। প্রায় সাত বছর ধরে চললো সম্ভাব্যতা যাচাই, জরিপ আর নিরীক্ষা। প্রায় ঝুলে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল প্রকল্পটি। এ নিয়ে এক মজার বিবরণ পাওয়া যায় কবি নবীনচন্দ্র সেনের আত্মজীবনী ‘আমার জীবন’-এ। নবীন চন্দ্র সেন চট্টগ্রামের সন্তান। জন্মেছিলেন রাউজানের এক জমিদার পরিবারে। পরে ডেপুটি কালেক্টর হন। সময়টা ১৮৮৪ সাল। সবে তিনি বদলি হয়ে এসেছেন ফেনীতে।

এখানে আসার পর নবীনচন্দ্র জানতে পারেন বছর কয়েক আগেই ফেনীতে আসাম-বেঙ্গল রেলওয়ের  লাইন বসবে এমন কথা হচ্ছিল। কিন্তু বর্তমানে তাতে সরকারের খুব একটা মন নেই। নবীনচন্দ্র সিদ্ধান্ত নেন, তিনি চট্টগ্রাম বিভাগের কমিশনার ডিআর লায়েল সাহেবকে বুঝিয়ে বলে ফেনীতে রেললাইন আনার ব্যবস্থা করবেন। তবে মুখের কথায় বোঝানোর কাজটি তাঁকে আর বেশি করতে হয়নি।

একবার লায়েল সাহেব গরুর গাড়িতে ফেনী হয়ে কুমিল্লা যেতে গিয়ে মহামুসিবতে পড়েন। পরে ফেনী ছাড়ার আগে তিনি নবীনচন্দ্রকে ডেকে বলেন, ‘আমার এই ঘাট পার হইতে ও এ পথে চলিতে যখন এরূপ বিভ্রাট ঘটিতেছে, তখন সাধারণ লোকের কি কষ্টই না জানি হয়। এতদিনে তোমার রেলওয়ের প্রস্তাবের প্রয়োজনীয়তা আমি বুঝিলাম। আমি আজ হইতে তাহার জন্য যুদ্ধ করিব। তুমি আমার সহায় হইবে।’

অতঃপর ফেনীর ঠিক কোনখান দিয়ে লাইন গেলে লাভ-ক্ষতি কত তা হিসাব করার ভার পড়ল নবীনচন্দ্রের ওপর। সেই হিসাব করতে গিয়ে নবীনচন্দ্র রেললাইনের নকশায় চোখ বুলিয়ে দেখলেন সরকারি রেলবিভাগ এখানে একেবারে হাস্যকর কা- করে বসেছে। প্রস্তাবিত নকশায় আসাম-বেঙ্গল রেলওয়ের লাইন ফেনী থেকে সাত মাইল পশ্চিমে ও নোয়াখালী থেকে ২০ মাইল পূর্বে বসেছে। পরে তিনি প্রস্তাব করেন, রেললাইন পূর্বে সরিয়ে চন্দ্রনাথ পর্বতশ্রেণির পাদদেশ ও ফেনী দিয়ে লাকসাম নিয়ে গেলে প্রচুর অর্থ সাশ্রয় হয়। কারণ তাতে জলপথ নিতান্তই কম, অল্প দৈর্ঘ্যরে সেতুই যথেষ্ট। আর পাহাড় যা আছে তা সমান করে দিলেই হবে, লাইন বসাতে বিশেষ বেগ পেতে হবে না।

রাজ-সরকারের পূর্ত সচিবের কাছে এই প্রস্তাব পাঠালে পয়লা দেখাতেই তিনি তা পছন্দ করেন। পরে অভিজ্ঞ রেলওয়ে তত্ত্বাবধায়ক মেজর স্টোরিও নবীনচন্দ্রের প্রস্তাবিত রেল-নকশার প্রশংসা করে বলেছিলেন, ‘চট্টগ্রাম হইতে লাকসাম পর্যন্ত আপনার মনোনীত লাইন পূর্ব-লাইন হইতে অধিকতর সুবিধার ও অল্পতর ব্যয়সাধ্য বলিয়া আমি গভর্নমেন্টে রিপোর্ট করিয়াছি’। উল্লেখ্য, আসাম বেঙ্গল রেলওয়ে উদ্বোধন হওয়ার পর এর ফেনী অংশের প্রকৌশলী ব্রাউনজারও নবীনচন্দ্রের প্রস্তাবনা মঞ্জুর হওয়ার কারণে তৎকালীন প্রায় ৫০ লাখ টাকা সাশ্রয় হয়েছে বলে মন্তব্য করেছিলেন।

 রেলপথ নির্মাণে বেসরকারি উদ্যোগ

নানা কারণে অর্থব্যয়ের বেলায় কৃপণতা দেখানো ইংরেজ সরকার আসাম-বেঙ্গল রেলওয়ের কাজ পুরোদমে হাত দিতে সময়ক্ষেপণ করছিলো। ১৮৮১ সালের মে মাসে সরকার জানায়, তারা আপাতত নিজেদের মালিকানা-ব্যবস্থাপনায় চট্টগ্রাম থেকে ফেনী পর্যন্ত রেললাইন বসানোর কথা ভাবছে। চট্টগ্রাম থেকে লাইন বসানোর কাজ ঢিমেতালে শুরু হয়ে যায়। কিন্তু আসাম পর্যন্ত লাইন যাবে না জানতে পেরে সাধারণ যাত্রী ও ব্যবসায়ীরা অসন্তুষ্ট হন।

১৮৯২ সালে বেসরকারি উদ্যোগে ‘আসাম-বেঙ্গল রেলওয়ে কোম্পানি’ তৈরির একটা প্রচেষ্টা নেয়া হলো। মূল উদ্যোক্তা দুজন- একজন জেমস মিডো রেন্ডেল, আরেকজন লে. কর্নেল জর্জ হ্যাডলস্টন। এরা দুজন পরে যথাক্রমে আসাম- বেঙ্গল রেলওয়ে কোম্পানির সভাপতি ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক হন। ওই বছরের ১৮ মার্চ লন্ডনে কোম্পানির নিবন্ধন সম্পন্ন হলো। দেড় লাখ পাউন্ডে কোম্পানির তহবিল গঠিত হয়। ইংরেজি সরকারের সঙ্গে আসাম-বেঙ্গল রেলওয়ে একটি চুক্তিও সম্পন্ন করে। সেই চুক্তিতে দুটি গুরুত্বপূর্ণ শর্তের কথা বলা হয়-

১. তহবিল থেকে সরকারকে আসাম-বেঙ্গল রেলওয়ে কোম্পানি ৩ শতাংশ সুদ দেবে;

২. বিনিময়ে সরকার তাদের বিনামূল্যে জমি অধিগ্রহণ করে দেবে ও সার্বিক প্রশাসনিক সহায়তা প্রদান করবে।

আসামÑবেঙ্গল রেলওয়ে কোম্পানি আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মপ্রকাশ করার পর প্রথম দফায় চট্টগ্রাম থেকে কুমিল্লা পর্যন্ত ৯৩ দশমিক ১৪ মাইলের (১৫০ কিলোমিটার) মিটারগেজ রেলপথ বসানো হয়। ১৮৯৫ সালের ১ জুলাই এ রেলপথ উদ্বোধন করা হয়।

একই সালের ৩ নভেম্বর চালু করা হয় চট্টগ্রাম থেকে চট্টগ্রাম বন্দর সেকশনটি। আসাম বেঙ্গল রেলওয়ের ওয়াগনে প্রথম চায়ের চালান যখন চট্টগ্রাম বন্দরে এসে পৌঁছালো, ধরা যেতে পারে তখন থেকেই শুরু হলো আধুনিক চট্টগ্রাম বন্দরের বিকাশ। আসাম বেঙ্গল রেলওয়ের অধিক্ষেত্র ছিল অনুন্নত ভূখণ্ড। এই অঞ্চলে স্টেশনভিত্তিক ছোট ছোট শহর ও ব্যবসা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠায় এই রেলওয়ের অবদান অনস্বীকার্য। ১৯২৯ সালে চালু করা হয় চট্টগ্রাম-হাটহাজারী সেকশনটি এবং ১৯৩০ সালে সেকশনটি হাটহাজারী থেকে নাজিরহাট পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হয়।

একটি শাখা লাইন একটি স্বপ্নের ভিত্তি

বিদ্যমান লাইনটিতে ১৯৩১ সালে চালু করা হয় একটি নতুন শাখা লাইন। ষোলশহর- দোহাজারী সেকশন। এই শাখা লাইনকে ভিত্তি করে দোহাজারি স্টেশনের পর দুর্গম পথে রেললাইন বসিয়ে ব্রক্ষ্মদেশ বা বর্তমান মিয়ানমারের আকিয়াব হয়ে রেঙ্গুন পর্যন্ত রেলপথের বিস্তার ঘটানো হবে এমন পরিকল্পনাও ছিল। আজকের ভাবনাটাই ভাবা হয়েছিলো প্রায় শত বছর আগেই। ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ে করিডোরে যুক্ত হওয়ার ভিত্তি হচ্ছে এই শাখা লাইন।

১৮৯৫ সালে শুরু হওয়া আসাম বেঙ্গল রেলওয়ের সেই যাত্রা পরিপূর্ণতা লাভ করেছিল ১৯০৪ সালে এসে এবং সেই অগ্রযাত্রা অব্যাহত ছিল ১৯৪২ সাল পর্যন্ত। ১৯৪২ সালে ‘আসাম বেঙ্গল রেলওয়ে’ ও ‘ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ে’ যুক্ত হয়ে নতুন কোম্পানি ‘দ্য বেঙ্গল অ্যান্ড আসাম রেলওয়ে’ নামে আত্মপ্রকাশ করে। উনিশ শতকের সেই আসাম বেঙ্গল রেলওয়ে কয়েক হাত ঘুরে এখন ‘বাংলাদেশ রেলওয়ে’।

স্বপ্ন বাস্তবায়নের এক রেলপথ

শত বছর আগে বোনা স্বপ্ন আজ দৃশ্যমান বাস্তবতা। মূলত ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ে করিডোরে সংযোগ স্থাপন, পর্যটন শহর কক্সবাজারকে রেলওয়ে নেটওয়ার্কের আওতায় আনা, পর্যটক ও স্থানীয় মানুষের জন্য সাশ্রয়ী ও পরিবেশবান্ধব যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং সহজে ও কম খরচে পণ্য পরিবহন এই প্রকল্পের লক্ষ্য।

রাজধানী ঢাকা ও পর্যটন নগর কক্সবাজারের সঙ্গে সরাসরি রেলসংযোগের জন্য চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার পর্যন্ত ১০২ কিলোমিটার এবং কক্সবাজার থেকে মিয়ানমার সীমান্তের ঘুমধুম পর্যন্ত আরও ২৮ দশমিক ৭৫ কিলোমিটার রেললাইন নির্মাণের উদ্যোগ নেয় সরকার। নতুন এ রেলপথ স্থাপনের জন্য সরকার ২০১০ সালের ৬ জুলাই প্রকল্পের ডিপিপি অনুমোদন দেয়। ২০২১ সালের ১৯ জুলাই প্রকল্পের সংশোধিত ডিপিপি অনুমোদিত হয়। ওই সময়ই প্রকল্প বাস্তবায়নের মেয়াদকাল স্থির করা হয় জুলাই, ২০১০ থেকে জুন, ২০২২। সরকারের নিজস্ব তহবিল এবং এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের (এডিবি) অর্থে বাস্তবায়নাধীন এ প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয়েছে ১৮ হাজার ৩৪ কোটি ৪৭ লাখ টাকা। এর মধ্যে এডিবির অর্থায়ন ১৫০ কোটি ডলার, অর্থাৎ  প্রায় ১২ হাজার ৭শ ৫০ কোটি টাকা।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১১ সালের ৩ এপ্রিল কক্সবাজারের ঝিলংজা মৌজার চৌধুরীপাড়ার দোহাজারী-রামু-কক্সবাজার এবং রামু-ঘুমধুম সিঙ্গেল লাইন ডুয়েলগেজ রেললাইন নির্মাণ প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। কিন্তু অর্থায়ন নিয়ে জটিলতার কারণে বেশ কয়েক বছর স্থবির থাকে প্রকল্প। এডিবি অর্থায়নে এগিয়ে এলে তাদের সঙ্গে সরকারের প্রথম দফা ঋণচুক্তি হয় ২০১৭ সালের ২১ জুন। আর দ্বিতীয় দফায় আরেকটি চুক্তি হয় ২০১৯ সালের ২৩ মে।

জানা যায়, প্রকল্পের জমি অধিগ্রহণ প্রায় পুরোটাই সম্পন্ন। বন বিভাগের সঙ্গে যে জটিলতা ছিল তা-ও কেটে গেছে। বাংলাদেশ রেলওয়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন কাজ পুরোদমে চালিয়ে যাচ্ছে। দুই লটে প্রকল্পটির নির্মাণকাজ চলছে। একটি লটে কাজ করছে চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না রেলওয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং করপোরেশন (সিআরইসি) ও দেশীয় প্রতিষ্ঠান তমা কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেড। আরেকটি লটে কাজ করছে চায়না সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাক করপোরেশন (সিসিইসিসি) ও দেশীয় প্রতিষ্ঠান ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেড।

প্রকল্প সূত্রে জানা যায়, এ রেলপথ যাবে চট্টগ্রামে চন্দনাইশ, সাতকানিয়া, লোহাগাড়া, চকরিয়া, রামু ও কক্সবাজার সদর উপজেলার ওপর দিয়ে। প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ে দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার পর্যন্ত ১০২ কিলোমিটার মূল রেললাইন এবং ৩৯ দশমিক ২ কিলোমিটার লুপ লাইন- মোট ১৪১ কিলোমিটার নতুন সিঙ্গেল লাইন ডুয়েলগেজ ট্র্যাক নির্মাণের কাজ চলছে। ১০২ কিলোমিটারের মধ্যে বিভিন্ন ভাগে ভাগে ৯০ কিলোমিটার এলাকায় রেলপথ নির্মাণের জন্য মাটি ভরাট বা পূর্তকাজ চলছে। রেলপথের ছয়টি বড় ব্রিজ ইতোমধ্যে নির্মাণ হয়ে গেছে। এখন গার্ডার বসলেই সেতুর কাজ পুরোপুরি সম্পন্ন হবে। ৩৯টি ব্রিজের মধ্যে ৩০টির কাজ শেষ। এগুলোয় এখন গার্ডার ও রেলের স্লিপার বসবে। আরও ১৪৫টি ক্ষুদ্র ব্রিজ ও কালভার্টের বেশিরভাগের কাজ শেষ। বিভিন্ন শ্রেণির ৯৬টি লেভেল ক্রসিং নির্মাণ করা হবে।

হাতি চলাচলের যেসব পথ রয়েছে সেগুলোর জন্য নির্মাণ করা হচ্ছে আন্ডারপাস ও ওভারপাস। দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত স্টেশন থাকবে আটটি। এগুলো হচ্ছে- দোহাজারী, লোহাগাড়া, হারবাং, চকরিয়া, ডুলাহাজরা, ইসলামাবাদ, রামু ও কক্সবাজার। রামুতে হবে জংশন। আর কক্সবাজারের রেলস্টেশনে নির্মাণ করা হবে আইকনিক ইন্টারমডেল টার্মিনাল বিল্ডিং। স্টেশনটি হবে ঝিনুকাকৃতির। কক্সবাজার রেলস্টেশনের পাইলিং কাজ শেষ করে এখন গ্রাউন্ড ফ্লোরের কাজ চলছে।

চট্টগ্রাম থেকে দোহাজারী পর্যন্ত মিটার গেজ রেলপথ থাকলেও নতুন প্রকল্পের মাধ্যমে ডুয়েল গেজে রূপান্তর করা হবে। পাশাপাশি ফৌজদারহাট থেকে একটি কার্ভ বা কর্ডলাইন নিয়ে ষোলশহর রেলস্টেশনে যুক্ত করা হবে। ঢাকা থেকে কুমিল্লা পর্যন্ত একটি কর্ডলাইনও করা হবে। সময় বাঁচাতে ও যাত্রীদের নিরবচ্ছিন্ন সেবা দিতে এই পথে কর্ডলাইন নির্মাণ করা প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। ফলে ঢাকা-চট্টগ্রাম হয়ে সরাসরি রেলপথ সহজে ও কম সময়ে চলে যাবে কক্সবাজার।