ব্লু ইকোনমির সম্ভাবনা কাজে লাগাতে হবে

চেম্বারের গোলটেবিল বৈঠক

দ্য চিটাগাং চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির আয়োজনে ‘বাংলাদেশে ব্লু ইকোনমির সম্ভাবনা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক শনিবার সকালে অনলাইন প্ল্যাটফর্মে অনুষ্ঠিত হয়।

সিসিসিআই রিসার্চ ডেভেলাপমেন্ট ট্রেনিং সাব-কমিটির উদ্যোগে বাংলাদেশে ব্লু ইকোনমিতে বিভিন্ন খাতে সম্ভাবনাসমূহ চিহ্নিতকরণ ও বিনিয়োগ বৃদ্ধির লক্ষ্যে এ আলোচনার আয়োজন করা হয়। স্বাগত বক্তব্য রাখেন চিটাগাং চেম্বার সভাপতি মাহবুবুল আলম। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সদস্য (প্রশাসন ও পরিকল্পনা) জাফর আলম, প্যানেল আলোচক হিসেবে বক্তব্য রাখেন সাবেক নৌ-প্রধান ও বাংলাদেশ মেরিন ফিশারিজ অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএফএ)’র ১ম সহ-সভাপতি ভাইস এডমিরাল (অব.) জহিরুল উদ্দিন আহমেদ, কক্সবাজার চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি’র সভাপতি আবু মোর্শেদ চৌধুরী (খোকা), চিটাগাং চেম্বার সিনিয়র সহ-সভাপতি তরফদার মো. রুহুল আমিন, কর্ণফুলী শিপ বিল্ডার্স’র চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইঞ্জিনিয়ার আবদুর রশিদ, রিলায়েন্স শিপিং অ্যান্ড লজিস্টিক’র চেয়ারম্যান মোহাম্মদ রাশেদ, প্রান্তিক গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইঞ্জিনিয়ার মো. গোলাম সারওয়ার, কেএসআরএম গ্রুপের উপ ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও চেম্বার পরিচালক মো. শাহরিয়ার জাহান। আরো বক্তব্য রাখেন সিসিসিআই রিসার্চ ডেভেলাপমেন্ট ট্রেনিং সাব-কমিটির ডাইরেক্টর ইনচার্জ ইঞ্জিনিয়ার ইফতেখার হোসেন ও কনভেনর মো. সালাউদ্দিন ইউসুফ, মিডিয়া পার্টনার দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড’র চট্টগ্রাম ব্যুরো চিফ শামসুদ্দিন ইলিয়াছ ও দৈনিক বণিক বার্তা’র চট্টগ্রাম ব্যুরো চিফ রাশেদ এইচ চৌধুরী।

অন্যদের মধ্যে চেম্বার সহ-সভাপতি সৈয়দ মোহাম্মদ তানভীর, পরিচালকবৃন্দ মো. অহীদ সিরাজ চৌধুরী (স্বপন), অঞ্জন শেখর দাশ, মো. ওমর ফারুক, মো. ইফতেখার ফয়সাল, মোহাম্মদ আদনানুল ইসলাম, তানভীর মোস্তফা চৌধুরী, সাব-কমিটির জয়েন্ট কনভেনর ইঞ্জিনিয়ার এস এম শহীদুল আলম, সদস্যবৃন্দ আকিব কামাল, আরিফ ইফতেখার মাহমুদ ও মো. আবু হোরায়রাসহ অনেকেই গোলটেবিল বৈঠকে অংশগ্রহণ করেন।

চেম্বার সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, প্রায় ৭১০ কিমি দীর্ঘ উপকূলীয় অঞ্চলসহ ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গ কিলোমিটারের বৈচিত্র্য ও সম্পদে পূর্ণ বিশাল জলসীমা বাংলাদেশের ব্লু ইকোনমিকে অত্যন্ত সম্ভাবনাময় করে তুলেছে। এ সকল সম্ভাবনার অধিকাংশই এখনো উন্মোচিত হয়নি এবং এ বিষয়টি উপলব্ধি করে আমাদের সরকার ভিশন ২০৪১ নামে একটি নির্দিষ্ট চ্যাপ্টার অন্তর্ভুক্ত করেছে। এই লক্ষ্যে যথাযথ প্রণোদনা ও আইন প্রণয়নের মাধ্যমে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ উৎসাহিত করতে নীতিমালা ও কৌশলগত কাঠামো জরুরি।

চেম্বার সভাপতি ব্লু ইকোনমিতে মেরিন ট্রেড (পোর্ট অপারেশন এবং লজিস্টিকস/ ফ্ল্যাগশিপিং), মেরিন হেভি ইন্ডাস্ট্রিজ (শিপ বিল্ডিং অ্যান্ড রিস্লাইকিং), মেরিন এনার্জি এক্সপ্লোরেশন অ্যান্ড রিনিউয়েবল এনার্জি, মেরিন ফিশিং (ডিপ সি ফিশিং অ্যান্ড মেরিন এ্যাকুয়াকালচার), সমুদ্রগামী ও উপকূলীয় মেরিন ট্যুরিজম ও মেরিন এগ্রিকালচার (লবণ) ইত্যাদি খাতে বিনিয়োগের সম্ভাবনা তুলে ধরেন।

তিনি বলেন, ২০১৮ সালে বাংলাদেশ সরকার ডেল্টা প্ল্যান-২১০০ প্রস্তুত করে। এই পরিকল্পনায় ব্লু ইকোনমির কৌশলগত ও সমুদ্র সম্পদ ব্যবস্থাপনার বিভিন্ন পদ্ধতি সম্পর্কে দিক নির্দেশনা দেয়া হয়েছে এবং ডেল্টা প্ল্যান-২১০০ অনুযায়ী শিপ বিল্ডিং অ্যান্ড শিপ রিসাইকিøং; সামুদ্রিক মাছের মজুদ জরিপ, উপকূলীয় ও গভীর সমুদ্রে মৎস্য শিকার, আন্তর্জাতিক জলসীমায় মৎস্য শিকার, মেরিন এ্যাকুয়াকালচার ও ম্যারি কালচার এবং দীর্ঘমেয়াদে মাছের প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে জীববৈচিত্র্যের ভারসাম্য বজায় রাখা; কোস্টাল ট্যুরিজম; নবায়নযোগ্য জ্বালানী; সমুদ্র পৃষ্ঠ বা উপকূলীয় এলাকার ভূমি উদ্ধার; ব্লু ইকোনমির বিভিন্ন খাতে উন্নয়নের জন্য পর্যাপ্ত গবেষণা এবং দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলা; বাংলাদেশের সমুদ্র এবং উপকূলীয় অঞ্চলের বিনিয়োগ সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো; টেকসইভাবে সমুদ্রে জীববৈচিত্র্য ও ভারসাম্য রক্ষার্থে শীঘ্রই প্রণয়ন করা এবং এর মাধ্যমে বাংলাদেশের ব্লু ইকোনমিতে সুশাসন নিশ্চিত করাসহ খাতসমূহকে প্রাধান্য/অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে উল্লেখ করেন। ব্লু ইকোনমিতে বেসরকারি খাতের মূল সম্ভাবনাসমূহ চিহ্নিত করা এবং এ সম্ভাবনাগুলো কাজে লাগানোর জন্য কি কি ধরনের সহায়ক নীতিমালা ও তথ্য দরকার তা চিহ্নিত করার পাশাপাশি এখান থেকে উঠে আসা প্রস্তাবনাসমূহ সংশ্লিষ্ট সরকারি দপ্তরে প্রেরণ করা হবে বলে তিনি জানান।

চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সদস্য (প্রশাসন ও পরিকল্পনা) জাফর আলম সভায় ব্লু ইকোনমির বিভিন্ন দিক উল্লেখ করে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন এবং ৬টি সুপারিশসমূহ পেশ করেন। ১. চিটাগাং চেম্বার ব্লু ইকোনমির উপর একটি আরএন্ডডি সেল গঠন করতে পারে যা ৮ম পঞ্চ বার্ষিকী পরিকল্পনার লক্ষ্য অর্জনের বাস্তবায়নযোগ্য প্রকল্পসমূহ চিহ্নিত করতে সহায়তা করবে। পাশাপাশি এই সেল পোর্ট অ্যান্ড শিপিং এর বিভিন্ন সাব গ্রুপের সাথে পোর্ট অ্যান্ড মেরিটাইম সাপ্লাই চেইন এ বিনিয়োগের সম্ভাবনা যাচাই করবে। ২. ব্লু ইকোনমি সম্প্রসারণের লক্ষ্যে বতর্মান শিপিং পলিসিকে আরো যুগোপযোগী করে তুলতে সরকারকে প্রস্তাবনা প্রদান। ৩. মেরিটাইম ট্রেডকে প্রমোট করতে অংশীজনদের সম্পৃক্ততার মাধ্যমে প্রাইভেট পোর্ট পলিসি তৈরিতে চেম্বার সরকারকে প্রস্তাবনা দিতে পারে। ৪. রাজধানীর কাছাকাছি পিপিপি’র আওতায় আইসিডি নির্মাণে চেম্বার প্রেসার গ্রুপ হিসেবে কাজ করতে পারে। ৫. বঙ্গবন্ধু শিল্প নগর থেকে বে-টার্মিনাল ও মাতারবাড়ী বন্দরের সাথে সড়ক, নৌ ও রেলপথ সংযোগ স্থাপন করা। ৬. চট্টগ্রাম বিভাগে চকরিয়ার কাছাকাছি আইসিডি নির্মাণের সম্ভাব্যতা যাচাই করা ইত্যাদি।

সাবেক নৌ-প্রধান ও বাংলাদেশ মেরিন ফিশারিজ অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএফএ)’র ১ম সহ-সভাপতি ভাইস এডমিরাল (অব.) জহিরুল উদ্দিন আহমেদ বলেন, গভীর সমুদ্র থেকে মাছ ধরে তা বিক্রয় করার ক্ষেত্রেও ভ্যালুয়েশন করা যাচ্ছে না। তাই এ সেক্টরে কোন কোন খাতে বিনিয়োগ করলে তা রিটার্ন আসবে সেই বিষয়ে নেই কোন উল্লেখযোগ্য গবেষণা। এছাড়া টুনা মাছ বিশ্বব্যাপী চাহিদা থাকলেও এ বিষয়ে পর্যাপ্ত কোন তথ্য নেই আমাদের কাছে। ফলে সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও এই মাছ আহরণে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী হচ্ছে না বিনিয়োগকারীরা।

কক্সবাজার চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি’র সভাপতি আবু মোর্শেদ চৌধুরী (খোকা) উপকূলীয় অঞ্চল নির্ভর মাল্টিডাইমেনশনাল ট্যুরিজম উন্নয়ন, ব্যবসায়ীদের জন্য অনবোট ফিশ প্রিজার্ভেশন ও অর্গানিক ড্রাইফিশ প্রসেসিং এর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা, কোস্টাল লাইনে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে লবণ উৎপাদন, নিষেধাজ্ঞার সময়ে জেলেদের জন্য বিকল্প কাজের ব্যবস্থা করা, ৬০-৭০ নটিকেল মাইলের অধিক গভীরে গিয়ে মাছ শিকারের জন্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জেলেদের ভর্তুকি প্রদান করা, খাতওয়্যারী নীতিমালা ও ৩-৫ বছর মেয়াদী পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং ব্লু ডাটা ব্যাংক ও ওয়ান স্টপ সার্ভিস পয়েন্ট চালু করার সুপারিশ করেন।

চিটাগাং চেম্বার সিনিয়র সহ-সভাপতি তরফদার মো. রুহুল আমিন বলেন, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নৌপথগুলোকে কাজে লাগাতে ব্যবসায়ীদের জন্য জরুরি ভিত্তিতে সরকারের পক্ষ থেকে বিশেষ তহবিল প্রয়োজন। নৌপথকে নেভিগেশনের আওতায় আনা গেলে সড়ক পরিবহনের উপর যেমন চাপ কমবে তেমন সময় ও অর্থ সাশ্রয় হবে। একটি মাত্র সেল দিয়ে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। এজন্য একটি মন্ত্রণালয় গঠন করে তাদের ম্যাজিস্ট্রেসি পাওয়ার দিয়ে কাজগুলো করতে হবে। ব্লু ইকোনমিকে কাজে লাগাতে হলে ৫-১০ বছরের প্রায়রিটি প্রজেক্ট গ্রহণ করতে হবে বলে তিনি জানান।

কর্ণফুলী শিপ বিল্ডার্স’র চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইঞ্জিনিয়ার আবদুর রশিদ বলেন, কক্সবাজার ও কুয়াকাটায় জেটি নির্মাণ করা যায় তবে সমুদ্রপথে ভ্রমণ বৃদ্ধির পাশাপাশি মেরিন ট্যুরিজমকে সমৃদ্ধ করা সম্ভব। তিনি সমুদ্রপথে হজ যাত্রী পরিবহনের পরিকল্পনার কথাও জানান।
রিলায়েন্স শিপিং অ্যান্ড লজিস্টিক’র চেয়ারম্যান মোহাম্মদ রাশেদ বর্তমানে ১৯টি আইসিডি রয়েছে যা কমপক্ষে ২৫টিতে উন্নীত করা প্রয়োজন উল্লেখ করে চট্টগ্রাম বন্দরের প্রবেশপথ সম্প্রসারিত যানজট করা ও যানজট নিয়ন্ত্রণের উপর গুরুত্বারোপ করেন। পাশাপাশি মেরিন অ্যাম্বুলেন্স, হেলিকপ্টার এবং ইমার্জেন্সি উদ্ধারকারী দল সংযোজন করা প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেন।

প্রান্তিক গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইঞ্জিনিয়ার মো. গোলাম সারওয়ার সমুদ্রগামী জাহাজ নির্মাণের ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ ইন্ডাস্ট্রি নেই উল্লেখ করে এ বিষয়ে উন্নয়নের উপর গুরুত্বারোপ করেন।

চেম্বার পরিচালক মো. শাহরিয়ার জাহান বলেন, যদি নিজেদের এক হাজার জাহাজ তৈরি করতে পারি তাহলে প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব হতে পারে। সরকার সম্প্রতি ফ্রেইট আর্নিং এর উপর যে ৩% কর ছিল তা অব্যাহতি দিয়েছে, যা এই শিল্পের জন্য অত্যন্ত ইতিবাচক এবং এ খাতে ৫০ হাজার কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা সম্ভব তা আমাদের অর্থনীতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন।

চেম্বার পরিচালক ও সিসিসিআই রিসার্চ ডেভেলাপমেন্ট ট্রেনিং সাব-কমিটির ডাইরেক্টর ইনচার্জ ইঞ্জিনিয়ার ইফতেখার হোসেন জানান, এ আয়োজনের উদ্দেশ্য হলো ব্লু ইকোনমিতে এ সকল খাতের সম্ভাবনাগুলো চিহ্নিত করা এবং সম্ভাবনাগুলোকে কাজে লাগানোর জন্য কি ধরনের নীতিমালাগত তথ্য ও আর্থিক প্রণোদনা প্রয়োজন সেই বিষয়ে আলোচনা করা।

সিসিসিআই রিসার্চ ডেভেলাপমেন্ট ট্রেনিং সাব-কমিটির কনভেনর মো. সালাউদ্দিন ইউসুফ ব্লু ইকোনমি ও এ সংশ্লিষ্ট খাতে বিনিয়োগ সম্পর্কে ব্যবসায়ীদের মাঝে সচেতনতা তৈরির পাশাপাশি প্রাইভেট সেক্টরের সাথে গ্যাপ দূরীভূত করে মিনিস্ট্রিতে এড্রেস করা প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেন। বিজ্ঞপ্তি