বিশ্ব নাগরিক সমাজ ও গণতন্ত্র

রায়হান আহমেদ তপাদার »

গণতন্ত্রের বাতিঘর হিসেবে পরিচিত যুক্তরাষ্ট্র এমন এক নেতাকে বেছে নিয়েছে প্রেসিডেন্ট হিসেবে, যিনি গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও প্রতিষ্ঠানগুলোকে পায়ে দলে আত্মম্ভরিতা প্রদর্শনকেই সবচেয়ে বেশি প্রেসিডেন্ট সুলভ বলে মনে করছেন। চীনে দেখা মিলবে একজন সি চিন পিংয়ের, যিনি দেশটিকে এক ব্যক্তির শাসনের দিকেই নিয়ে যাচ্ছেন। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের উত্থান ও ক্ষমতা সুসংহত করার গল্প এখন পুরোনো। আছেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন। কিছুদিন আগে দেশটিতে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে তিনি তাঁর ক্ষমতা আরও দৃঢ় করেছেন। আজ থেকে প্রায় ত্রিশ বছর আগে মার্কিন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ফ্রান্সিস ফুকুয়ামা ইতিহাসের সমাপ্তি এবং উদারনৈতিক গণতন্ত্রের বিজয় ঘোষণা করেছিলেন। সমাজতান্ত্রিক কেন্দ্র সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলোপের প্রেক্ষাপটেই এ ঘোষণা দিয়েছিলেন ফুকুয়ামা।
কিন্তু সেই সময় তিনি যার বিজয় ঘোষণা করেছিলেন, তারও যেন মৃত্যুঘণ্টা শোনা যাচ্ছে এখন। তিন দশক আগে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার এবং এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশের সামরিক শাসকদের পতনের পর আমরা সবাই গণতন্ত্রের তৃতীয় তরঙ্গ নিয়ে আলাপ-আলোচনা করতাম। ওই সময় আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো উদীয়মান গণতন্ত্রের দেশগুলোকে তাদের সদ্যোজাত গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো জোরদার করার কর্মকৌশল শেখানোর জন্য কারিগরি বিশেষজ্ঞ সরবরাহে ব্যস্ত সময় পার করছিল। কিন্তুু তাও যেন ব্যর্থতার আড়ালে চলে যাচ্ছে।
গণতান্ত্রিক সংহতির চাবিকাঠি হলো রাজনৈতিক সদিচ্ছা। কিন্তু যে রাজনৈতিক সদিচ্ছার পরিবেশ আমাদের গণতান্ত্রিক চর্চাকে আত্মস্থ করতে সক্ষম করে তুলতে পারে, সেই পরিবেশ কীভাবে আমরা তৈরি করতে পারব তার কোনো সহজ উত্তর আমাদের জানা নেই। ১৯৯০-এর দশকের মাঝামাঝি গণতন্ত্রের বিশেষজ্ঞ ও পর্যবেক্ষকেরা গণতন্ত্রের অবক্ষয় নিয়ে লেখালেখি শুরু করেছিলেন।
১৯৯৭ সালে ফরিদ জাকারিয়া একটি লেখায় বলেছিলেন, সদ্য গণতন্ত্রের উত্তরণ ঘটা দেশগুলোর অর্ধেকই অনুদার গণতন্ত্রে পরিণত হচ্ছে এবং তিনি হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন, এসব অনুদার গণতন্ত্র দ্রুতগতিতে একটি বিকাশমান শিল্পে পরিণত হচ্ছে। চলমান শতকের গোড়া থেকেই বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের চালানো জরিপে দেখা গেছে, উদীয়মান গণতন্ত্রের অনেকগুলোতে যদিও নিয়মিত নির্বাচন হচ্ছে এবং সেসব জায়গায় সামরিক শাসনও নেই, কিন্তু সেখানে নির্বাহী প্রশাসনের ক্ষমতাচর্চার জবাবদিহি সীমিত হয়ে পড়েছে। অনেক দেশেই নির্বাহী শাখা বিচার বিভাগের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করেছে এবং পার্লামেন্টকে পাশ কাটিয়ে এসেছে। এসব দেশে নির্বাচনগুলো অবাধ ও স্বচ্ছ হয় না। এসব দেশে ক্ষমতাসীনেরা ভোটের ফল নিজেদের দিকে টানতে নানা ধরনের স্থূল ও সূক্ষ্ম কারসাজি করে থাকে। এর ফলে সত্যিকারের প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচনের মাধ্যমে ভোটাররা তাঁদের পছন্দের প্রার্থী নির্বাচন করতে পারেন না। রাজনৈতিক দলগুলো জনগণের স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করতে ব্যর্থ হয়েছে এবং তারা ক্ষমতাবান বিশেষ স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর কবজায় চলে গেছে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে গণতন্ত্র নিয়ে গবেষণা করা প্রতিষ্ঠানগুলো নতুন গজিয়ে ওঠা আর একটি প্রবণতা, যেটিকে স্বৈরাচারীকরণ হিসেবে আখ্যায়িত করা হচ্ছে, সেটির দিকে মনোযোগ দিয়েছে।
গণতন্ত্রবিষয়ক অনেক জরিপ শুধু বিভিন্ন দেশের গণতন্ত্রায়নের মাত্রাই নয়, বরং একই সঙ্গে স্বৈরাচারীকরণের মাত্রারও পরিমাপ করেছে। এর আগে গবেষণায় যেমন গণতন্ত্রের বিভিন্ন তরঙ্গ নিয়ে আলোচনা করেছে, আজকাল অনেকে গবেষণা শুরু করেছেন স্বৈরাচারীকরণের বিভিন্ন তরঙ্গ’কে চিহ্নিত করতে। যেখানে গণতন্ত্র কখনো সুসংহত হয়নি বা গণতন্ত্রের শিকড় গভীরে প্রোথিত হয়নি, সেসব জায়গার দুর্বল উদীয়মান গণতন্ত্র স্বৈরাচারীকরণের ‘প্রথম তরঙ্গ’-এর শিকার হয়ে থাকে। তবে তুরস্ক, হাঙ্গেরি ও ফিলিপাইনে তুলনামূলক অবাধ ও স্বচ্ছ নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসা সরকারও যখন স্বৈরাচারী হয়ে উঠল, তখন গণতন্ত্র পর্যবেক্ষকেরা চিন্তিত হয়ে উঠলেন। এরপর যখন যুক্তরাষ্ট্রে ট্রাম্প, ভারতে মোদি এবং ব্রাজিলে বোলসোনারোর মতো নেতা নির্বাচিত হয়ে এলেন, তখন উদার গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে মানুষের দুশ্চিন্তা নতুন উচ্চতায় গিয়ে ঠেকল।
প্রতিবছর কোন দেশে কতটা গণতন্ত্রায়ন এবং কতটা স্বৈরতন্ত্রীকরণ হলো, তা জরিপ করে থাকে ভি ডেম (ভ্যারাইটিস অব ডেমোক্রেসি) ইনস্টিটিউট নামের একটি সংস্থা, যা সুইডেনে অবস্থিত। তাদের সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আমরা এখন স্বৈরতন্ত্রীকরণের তৃতীয় তরঙ্গে প্রবেশ করছি, যে তরঙ্গের সূচনা হয়েছিল অর্থাৎ প্রথম তরঙ্গটি দেখা দিয়েছিল ২০০১ সালে। তারপর থেকে ক্রমাগত বহু দেশই স্বৈরশাসনের পথে হাঁটছে।
বর্তমানে বিশ্বের জনসংখ্যার ৩৫ শতাংশই স্বৈরতন্ত্রীকরণের শিকার হওয়া দেশে বাস করে। ২০০৮ সালে যেখানে উদার গণতন্ত্রের দেশ ছিল ৪৪ টি, ২০১৮ সালে সেই সংখ্যা ২৯টিতে নেমে এসেছে। ভি ডেমের ওই প্রতিবেদনে গণতন্ত্র নতুন তিনটি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
যেমন: এখন গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারগুলোর মধ্যে গণমাধ্যম ও সুশীল সমাজকে নিয়ন্ত্রণ কিংবা সেগুলোকে নানা কারসাজির মাধ্যমে নিজের মতো করে ব্যবহার করার প্রবণতা বাড়ছে এবং সেখানে নির্বাচন প্রক্রিয়ার গ্রহণযোগ্যতাও ক্রমাগত অপসৃত হচ্ছে। রাজনৈতিক নেতারা ঘৃণা ছড়ানো ভাষণ দিচ্ছেন। এর ফলে জনসাধারণের মধ্যে বিষাক্ত মেরুকরণ দেখা দিয়েছে। এতে বিরোধী মতের প্রতি শ্রদ্ধা এবং জনগণের সহিষ্ণুতা কমে যাচ্ছে। যার কারণে জনগণের মধ্যে পরস্পরবিরোধী শিবির গড়ে উঠেছে। এবং ডিজিটালাইজেশনের কারণে ভুয়া তথ্য ও গুজব এখন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে এবং যুক্তরাষ্ট্রের মতো ‘সুসংহত’ গণতন্ত্রের দেশেও এসব গুজব নির্বাচন প্রক্রিয়ায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। বিদেশি রাষ্ট্রও অন্য রাষ্ট্রের নির্বাচনী প্রচারণার ওপর প্রভাব ফেলছে। এবং তার ফলে নির্বাচনের ফলাফলের ওপরও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হচ্ছে। ২০১৬ সালের যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের ওপর রাশিয়ার হস্তক্ষেপ নিয়ে বহুল আলোচনা হয়েছে। ভি ডেমের প্রতিবেদনে স্বৈরতন্ত্রীকরণের মারাত্মক রূপ নেওয়ার প্রাথমিক হুঁশিয়ারিমূলক পূর্বাভাস হিসেবে গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ ও সুশীল সমাজ দমন করাকে শনাক্ত করা হয়েছে।
গত ৩ দশক আগে আমরা সবাই গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে যে উচ্চাশা পোষণ করেছিলাম, আজ তা উল্লেখযোগ্য মাত্রায় অপসৃত হয়েছে। নিয়মিত নির্বাচনের মধ্য দিয়ে বেসামরিক রাজনৈতিক নেতারা ক্ষমতায় আসবেন এবং তাঁরাই দেশ চালাবেন-গণতন্ত্রের এই একটি মাত্র দিকের ওপর মাত্রাতিরিক্ত জোর দিতে গিয়ে আমরা আইনের শাসন, ব্যক্তির মৌলিক স্বাধীনতা, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতা, বহুমতের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা সুশীল সমাজ, মুক্ত গণমাধ্যম ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা প্রভৃতির মতো গণতন্ত্রের জন্য সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ অপর বিষয়গুলোকে যে অবহেলা করে এসেছি, তা এখন আমরা টের পাচ্ছি। এদিকে মনোযোগ কম দেওয়ার সুযোগে অনেক ‘দায়সারা গোছের’ গণতন্ত্রের নেতাদের পক্ষে স্বৈরতন্ত্রীকরণে ঢোকা সহজ হয়েছে
যুক্তরাষ্ট্রে ট্রাম্প এবং ভারতে মোদির মতো নেতা নির্বাচিত হওয়ার বিষয়টি এখন সারা বিশ্বের উদার গণতন্ত্রপন্থীদের জন্য রূঢ় সতর্কবার্তা হিসেবে হাজির হয়েছে। আর যা-ই হোক, যুক্তরাষ্ট্র একটি সংহত গণতন্ত্রের দেশ বলে পরিচিত, যেখানে সরকারের তিনটি শাখা ভারসাম্য মেনে চলে এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতাসহ ব্যক্তির মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা দেয়।
সেই দেশে কেউ এটি আশা করেননি, একজন মার্কিন প্রেসিডেন্ট সিএনএনের মতো প্রতিষ্ঠিত সংবাদমাধ্যমগুলো ভুয়া খবর সরবরাহ করছে বলে প্রতিনিয়ত মন্তব্য করবেন। ভারতে দেশটির স্বাধীনতা লাভের পর থেকে ৭০ বছর ধরে গণমাধ্যম স্বাধীনতা ভোগ করে এলেও ক্ষমতাসীন মোদি সরকারের আমলে তা আক্রমণের মুখে পড়ে গেছে।
আমাদের গণতান্ত্রিক আকাক্সক্ষার পথে সর্বশেষ ও সবচেয়ে ভয়ানক চ্যালেঞ্জ হলো গণমাধ্যম। বিভিন্ন দেশে স্বৈরাচারীকরণের বিরুদ্ধে ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষায় নাগরিকদের বিক্ষোভে নামার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। মূলত ২০০৯ সাল থেকে স্বৈরাচারীকরণের প্রবণতা বাড়তে শুরু করে এবং তখন থেকেই স্বৈরাচারীকরণ ও সরকারের অন্যায্য কার্যকলাপের বিরুদ্ধে নাগরিক বিক্ষোভ বেড়ে যায়। সম্প্রতি আমরা হংকং, সুদান, তিউনিসিয়া, যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতে নাগরিকদের দীর্ঘ আন্দোলন প্রত্যক্ষ করেছি। যুক্তরাষ্ট্রে করোনা মহামারির মধ্যেও ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার আন্দোলন হয়েছে। হংকং ও থাইল্যান্ডে গণতন্ত্রের আন্দোলনকারীরা আবার রাস্তায় ফিরে এসেছেন। দিল্লির শাহীনবাগে ২০১৯ সালে তীব্র শীতের মধ্যেও সাধারণ নারীরা রাস্তায় অবস্থান নিয়ে আন্দোলন করেছেন এবং শুধু করোনাভাইরাস মহামারির জন্য লকডাউন ঘোষণার পরই তাঁদের ঘরে ফেরানো গেছে।
ভারতে বিভিন্ন প্রদেশে হঠাৎ লকডাউনের পর অন্য প্রদেশের অভিবাসী শ্রমিকদের যে দুর্দশা হয়েছে এবং তাঁদের সঙ্গে অমানবিক আচরণ করার প্রতিবাদে আন্দোলন হয়েছে। সর্বশেষ কথা হলো, বৃহৎ পরিসরে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও গণতন্ত্রের জন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছা সৃষ্টির জন্য শুধু নাগরিকদের আন্দোলনই যথেষ্ট নয়। সুবিধাবঞ্চিত, দরিদ্র ও সমাজের বাইরে ছিটকে পড়া মানুষের সম-অধিকার প্রতিষ্ঠায় সক্ষম গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য অনস্বীকার্য মৌলিক ও দীর্ঘমেয়াদি সংস্কারকাজ এসব অসংগঠিত ও বিক্ষিপ্ত আন্দোলন দিয়ে নিশ্চিত করা সম্ভব নয়।
পশ্চিমা দেশগুলো গণতন্ত্রের ফেরিওয়ালা হিসেবে যা ফেরি করেছে, তার গোড়ায় রয়েছে নির্বাচন। বহু গণতান্ত্রিক দেশে আমরা কতটা বৈষম্যমূলক ও অন্যায্য সমাজব্যবস্থার মধ্যে বাস করি, তা এই করোনা মহামারি খোলাসা করে দিয়েছে। এর ফলে এই ব্যবস্থাগুলোর আমূল সংস্কার দরকার। যখন দেশে দেশে বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে থাকা ভিন্ন ভিন্ন প্রতিরোধ স্ফুলিঙ্গ সুসংহত হয়ে একটি টেকসই সংগঠন ও নেতৃত্ব তৈরি করতে পারবে এবং দীর্ঘমেয়াদি প্রতিশ্রুতি নিয়ে তা এগিয়ে যেতে পারবে, কেবল তখনই সত্যিকার গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছা বিনির্মাণের পথে আমরা এগিয়ে যেতে পারব।

লেখক : গবেষক ও কলামিস্ট
ৎধরযধহ৫৬৭@ুধযড়ড়.পড়স