বাড়ি ফিরেছেন খালেদা

সুপ্রভাত ডেস্ক »

এক টানা ৮১ দিন হাসপাতালে থাকার পর বাসায় ফিরেছেন খালেদা জিয়া; তবে তিনি এখনও সুস্থ নন বলে জানিয়েছেন তার চিকিৎসকরা।

দুর্নীতির মামলায় দণ্ডিত বিএনপি চেয়ারপারসন সরকারের নির্বাহী আদেশে মুক্ত থাকার মধ্যে অসুস্থ হয়ে এই দফায় গত ১৩ নভেম্বর ঢাকার এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি হন।

এরপর তার লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত হওয়ার খবর প্রকাশিত হয়। তাকে বিদেশ নেওয়ার আবেদনে সরকারের সাড়া না মেলায় বসুন্ধরার বেসরকারি হাসপাতালটিতেই চলে তার চিকিৎসা।

সেখান থেকে মঙ্গলবার সন্ধ্যার পর বাড়ির পথে রওনা হন ৭৭ বছর বয়সী সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া।

এসময় হাসপাতাল প্রাঙ্গণে ভিড় জমিয়েছিল বিএনপির নেতা-কর্মীরা। সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় রওনা হয়ে সেই ভিড় ডিঙিয়ে রাত সাড়ে ৮টায় গুলশানের বাসা ফিরোজায় পৌঁছান তিনি।

বাসায় তখন উপস্থিত ছিলেন র ছোট ভাই প্রয়াত সাঈদ এস্কান্দারের স্ত্রী নাসরিন এস্কান্দার।

বিএনপি নেতাদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, জ্যেষ্ঠ নেতা আমানউল্লাহ আমান, আবদুস সালাম, খালেদা জিয়ার একান্ত সচিব এবিএম আবদুর সাত্তার।

গুলশানের সেই বাসার সামনের সড়কেও তখন উপস্থিত ছিলেন বিএনপির নেতা-কর্মীরা। বাড়িতে ঢোকার সময় স্লোগানের সঙ্গে হাত তুলে দলীয় নেত্রীকে সালাম জানান তারা। মাস্কপরা অবস্থায় গাড়ির ভেতর থেকে হাত নেড়ে তাদের শুভেচ্ছা জানান তিনি।

স্বাস্থ্যগত বিভিন্ন জটিলতা নিয়ে ৮১ দিন চিকিৎসা শেষে মঙ্গলবার এভারকেয়ার হাসপাতাল থেকে বাসায় ফেরেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। হাসপাতালে ভর্তির পর তার লিভার সিরোসিসের খবরটি জানা গিয়েছিল।

২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় সাজার পর খালেদা জিয়াকে কারাগারে পাঠানো হয়েছিল। পরে জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্টের মামলায়ও তার সাজা হয়।

পুরান ঢাকার পুরনো কেন্দ্রীয় কারাগারে তিনি একমাত্র বন্দি হয়ে থাকেন দুই বছর। এই সময়ে কিছুদিন চিকিৎসার জন্য বিএসএমএমইউতেও ছিলেন তিনি।

করোনাভাইরাস মহামারী শুরুর পর পরিবারের আবেদনে ২০২০ বছরের ২৫ মার্চ সরকারের নির্বাহী আদেশে সাজা স্থগিত করে খালেদাকে মুক্তি দেয় সরকার।

কারাগারে থেকে ছাড়া পেয়ে গুলশানের বাড়ি ফিরোজায় ওঠেন তিনি। এরপর কোভিড আক্রান্ত হয়ে দুইবার এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নেন তিনি।

সর্বশেষ গত ১৩ নভেম্বর লিভারে সিরোসিসে আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হন বসুন্ধরার হাসপাতালটিতে। তাকে রাখা হয়েছিল সিসিইউতে। হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক শাহাবুদ্দিন তালুকদারের নেতৃত্বে ১০ সদস্যের মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয় তার জন্য।

মাঝে রক্তক্ষরণে তার অবস্থা সঙ্কটাপন্ন হয়ে ওঠার খবরও দিয়েছিলেন চিকিৎসকরা। তবে দুই মাস পরে পরিস্থিতির উন্নতিতে গত ১০ জানুয়ারি কেবিনে স্থানান্তর করা হয় তাকে। তার ২০ দিন পর বাড়িতে ফেরার ছাড়পত্র পেলেন তিনি।

প্রায় তিন মাস হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে মঙ্গলবার খালেদা জিয়া বাসায় ফেরার আগে সন্ধ্যায় তার স্বাস্থ্যের সর্বশেষ অবস্থা তুলে ধরতে ঢাকার এভারকেয়ার হাসপাতালে সংবাদ সম্মেলন করেন তার চিকিৎসায় গঠিত মেডিকেল বোর্ডের সদস্যরা। ছবি: নয়ন কর

‘স্থিতিশীল, তবে সুস্থ নয়’

খালেদা জিয়া বাড়িতে রওনা হওয়ার আগে সন্ধ্যায় এভারকেয়ার হাসপাতালে সংবাদ সম্মেলন করে তার শারীরিক অবস্থা তুলে ধরে তার কিচিৎসায় গঠিত মেডিকেল বোর্ড।

বোর্ডের প্রধান অধ্যাপক শাহাবুদ্দিন তালুকদার বলেন, খালেদা জিয়া এখনও পুরোপুরি সুস্থ না হলেও মহামারীর এই সময়ে আবার কোভিড সংক্রমণের ঝুঁকি এড়াতে তাকে বাসায় পাঠানো হয়েছে। পরিস্থিতির অবনতি হলে হাসপাতালে ফেরত আনা হবে।

“উনার দুইটা কন্ডিশন। এক নাম্বার, উনি ক্লিনিক্যালি স্টেবল বাট নট কিউর। বাট সি ইজ নট ফ্রি অব ডিজিস। দুই নম্বর হচ্ছে, আমাদের কোভিড পরিস্থিতির জন্য, সেকেন্ডারি ইনফেকশনের জন্য এবং সি ইজ ভেরি মাচ ভালনারেবল। সেজন্য আপাতত উনাকে বাসায় পাঠাচ্ছি। এরপরে যদি কোনো রকম ক্রাইসিস হয়, উই আর রেডি টু রিসিভিং হার এগেইন ইন হসপিটাল।”

খালেদা জিয়ার চিকিৎসার প্রসঙ্গ টেনে অধ্যাপক শাহাবুদ্দিন বলেন, “আমাদের বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে যতগুলো পসিবল ট্রিটমেন্ট ছিল, তা আমরা দিয়েছি। আমরা হসপিটালের ডাক্তারদের সাথে, বাইরের কনসালটেন্টের সাথে, অন্যান্য হাসপাতালের বিশেষজ্ঞদের সাথে আলোচনা করেছি। আমরা বিদেশি কনসালটেন্টদের সাথে ইউকে, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়ার কনসালটেন্টদের সাথে কথা বলেছি। সবারই একই মত যে, আপাতত আমরা কনট্রোল করেছি। বাট সি নিডস টু গো এবরোড ফর হার পারমেন্টে ট্রিটমেন্ট।”

বিএনপি চেয়ারপারসনকে বিদেশ পাঠাতে তার দলের দাবি তোলার পাশাপাশি পরিবারের পক্ষ থেকে আবেদন হলেও আইনি জটিলতার কথা বলে আসছে সরকার।

আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলছেন, খালেদা জিয়াকে বিদেশ যেতে হলে কারাগারে ফিরে আবার নতুন করে আবেদন করতে হবে। তখন সরকার সেই আবেদন বিবেচনা করতে পারে, তার আগে নয়।

স্বাস্থ্যগত বিভিন্ন জটিলতা নিয়ে ৮১ দিন চিকিৎসা শেষে মঙ্গলবার এভারকেয়ার হাসপাতাল থেকে বাসায় ফেরেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। হাসপাতালে ভর্তির পর তার লিভার সিরোসিসের খবরটি জানা গিয়েছিল।

এভারকেয়ার হাসপাতালের ১১ তলার মিলনায়তনে এই সংবাদ সম্মেলনে মেডিকেল বোর্ডের সদস্য অধ্যাপক এফ এম সিদ্দিকী, অধ্যাপক এম এস আরেফিন, অধ্যাপক এ কিউ এম মহসেন, অধ্যাপক শেখ মুহাম্মদ আবু জাফর, অধ্যাপক নুর উদ্দিন আহমেদ, অধ্যাপক লুৎফুল আজিজ, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সাইফুল ইসলাম, অধ্যাপক এ জেড এম জাহিদ হোসেন, অধ্যাপক জাফর ইকবাল, ডা. মুহাম্মদ আল মামুন, ডা. রফিকুল ইসলাম, ডা. শাহরিয়ার সাইদ, ডা. আরমান রেজা চৌধুরী উপস্থিত ছিলেন।

এর আগে বিভিন্ন সময় এই বোর্ডের কয়েকজন চিকিৎসক খালেদার শারীরিক অবস্থা নিয়ে সংবাদ সম্মেলন করলেও বোর্ডের সংবাদ সম্মেলনে আসা এটাই প্রথম।

অধ্যাপক এফ এম সিদ্দিকী জানান, এই দফায় ভর্তির আগে গত নভেম্বরে যখন খালেদা জিয়া এভার কেয়ার হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন, তখন তার একটি টিউমার অপসারণ করা হয়েছিল।

সুস্থ না হলেও কেন ছাড়পত্র মেডিকেল বোর্ড দিচ্ছে- সাংবাদিকরা জানতে চাইলে অধ্যাপক সিদ্দিকী বলেন, “উনার ব্লিডিং আপাতত বন্ধ হলেও তার অসুখের ট্রিটমেন্ট সেভাবে হচ্ছে না। এখন উনার অবস্থা স্থিতিশীল আছে।

“এখন আমরা দেখতে পাচ্ছি যে সারাদেশে করোনা সংক্রমণ ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। জানুয়ারি মাসে এই হাসপাতালে (এভারকেয়ার) ৩৮০ জনের বেশি কর্মকর্তা-কর্মচারী করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। এই অবস্থার প্রেক্ষিতে উনার স্বাস্থ্য ঝুঁকির কথা চিন্তা করে মেডিকেল বোর্ড সিদ্ধান্ত নিয়েছে, এই মুহূর্তে উনার কন্ডিশন যেহেতু স্টেবল, সেহেতু আমাদের তত্ত্বাবধায়নে বাসায় রেখে উনার চিকিৎসা করা প্রয়োজন।”

পুরোপুরি নিশ্চয়তা দেওয়া না গেলেও বড় ধরনের রক্তক্ষরণের আশঙ্কা আপাতত করছেন না এই চিকিৎসক।

লিভার সিরোসিসের চিকিৎসার বিষয়ে অধ্যাপক সিদ্দিকী বলেন, “লিভার সিরোসিসের যে চিকিৎসা, সেটা কিন্তু আমরা করতে পারিনি এখনেও। যে ভ্যাসেল দিয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছে, সেই রক্তের প্রবাহটা বাইপাস করে টিপসের মাধ্যমে যে প্রক্রিয়া, তা আমাদের দেশে নেই। উন্নত চিকিৎসা সেজন্য প্রয়োজন।”

খালেদা জিয়া বহু বছর ধরে আর্থ্রাইটিস, ডায়াবেটিস, কিডনি, ফুসফুস, চোখের সমস্যাসহ নানা জটিলতায় ভুগছিলেন।

সূত্র : বিডিনিউজ