বর্ষা শেষেই চ্যানেলে ড্রেজিং

মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দর

৩৩ কোটি ৫৩ লাখ টাকা পরিশোধে বন্দরকে জেলা প্রশাসনের চিঠি

ভূঁইয়া নজরুল  <
চলতি বছরের বর্ষা শেষেই মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দরের চ্যানেলের চওড়া বাড়াতে শুরু হবে ড্রেজিং। বর্তমানে ২৫০ মিটার চওড়া চ্যানেল থাকলেও বন্দরের জন্য তা আরো ১০০ মিটার বাড়ানো হবে। গত সপ্তাহে কক্সবাজার জেলা প্রশাসন মাতারবাড়ি বন্দরের জন্য ভূমির মূল্য নির্ধারণ করেছে এবং তা পরিশোধের জন্য ১২০ দিন সময় দিয়েছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষকে।
ভূমির অধিগ্রহণ মূল্য প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা মোস্তফা জাবেদ কায়সার বলেন, ‘সরকারি নিয়ম অনুযায়ী আমরা অধিগ্রহণের মূল্য নির্ধারণ করেছি। মৌজা অনুযায়ী ১২৩ একর ভূমিতে নাল জমি, ভিটে বা ঘরবাড়ি, গাছপালা, পুকুর, রাস্তাঘাট সবগুলোর জন্য মূল্য নির্ধারিত হয়েছে ৩৩ কোটি ৫৩ লাখ ৬২ হাজার ১৫৭ টাকা।’
একর প্রতি ক্ষতিপূরণ কতো পেয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ভূমি অধিগ্রহণে সরকারি নবীতিমালা অনুযায়ী তিনগুণ পাওয়ার কথা। সেই হিসেবে মৌজামূল্যের তিনগুণ দেয়া হয়েছে। এছাড়া এরসাথে গাছপালা ও অবকাঠামোর মূল্যও নির্ধারণ করা হয়েছে।
জেলা প্রশাসক মামুনুল হক স্বাক্ষরিত প্রজ্ঞাপনে দেখা যায়, ১২১ দশমিক ১৬ একর নাল জমির জন্য ২৯ কোটি ৯৮ লাখ ৫০ হাজার ৬৬০ টাকা, ১.৩৯ একর ভিটে ভূমির জন্য ১ কোটি ২০ লাখ ৪৮ হাজার ৬৯৮ টাকা, শূন্য দশমিক ৫৬ একর পুকুরের জন্য ২৮ লাখ ৮০১ টাকা, শূন্য দশমিক ১৭ একর পুকুর পাড়ের জন্য ৫ লাখ ৪১ হাজার ৩৪৮ টাকা, শূন্য দশমিক ৬ একর রাস্তার জন্য ১৪ লাখ ৮৪ হাজার ৮৩৮ টাকা ক্ষতিপূরণ নির্ধারণ করা হয়েছে। এছাড়া অবকাঠামো বাবদ মূল্য নির্ধারণ হয়েছে ১ কোটি ৭ লাখ ৩৫ হাজার ৬৪৩ টাকা।
মূল্য নির্ধারণে দীর্ঘসূত্রিতা বিষয়ে কক্সবাজার জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, স্থানীয়রা অতিরিক্ত মূল্য চেয়ে একটি আবেদন করে। কিন্তু সরকারি নিয়মের বাইরে অতিরিক্ত মূল্য দেয়ার কোনো বিধান নেই বলে জানান ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা মোস্তফা জাবেদ কায়সার। তিনি বলেন, আমরা স্থানীয়দের প্রস্তাবনা নৌ মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছি, বিপরীতে সরকারি নীতিমালা অনুযায়ী যা মূল্য আসে তা নির্ধারণ করেছি। এখন যদি পরবর্তীতে নৌ মন্ত্রণালয় বাড়তি দেয় তা তাদের বিষয়।
এবিষয়ে স্থানীয় ধলঘাট ইউনিয়নের চেয়ারম্যান কামরুল হাসান বলেন, আমরা বাড়তি মূল্যের দাবি করেছিলাম। তবে একর প্রতি প্রায় ৮০ লাখ টাকা মূল্য নির্ধারণ হয়েছে বলে শুনেছি। যদি এই মূল্য হয় তাহলে হয়তো স্থানীয়রা মেনে নেবে।
জেলা প্রশাসন থেকে মূল্য নির্ধারণ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সদস্য ( প্রশাসন ও পরিকল্পনা) এবং এই বন্দরের শুরু থেকে দায়িত্বে নিয়োজিত জাফর আলম বলেন, ‘আমরা নোটিশের সফট কপি পেয়েছি। হার্ডকপি হাতে পাওয়া মাত্রই একসাথে পুরো মূল্য পরিশোধ করবো। একইসাথে যাতে স্থানীয়দের দ্রুত টাকা বিতরণ করা হয় সেজন্য জেলা প্রশাসনকে অনুরোধ করবো।’
দ্রুততার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘যেহেতু তা জাপান ইন্টারন্যাশনাল কোঅপারেশন এজেন্সির (জাইকা) অর্থায়নে হচ্ছে তাই তাদের শর্ত হলো আগে ক্ষতিপূরণ পরে কাজ। আর জাইকা চলতি বর্ষা শেষে চ্যানেলে ড্রেজিংয়ের কাজ শুরু করতে চায়। সেজন্য আমরা দ্রুততার সাথে করতে চাচ্ছি।’
তিনি আরো বলেন, বর্তমানে ১৪ দশমিক ৩ কিলোমিটার দীর্ঘ চ্যানেলের চওড়া ২৫০ মিটার রয়েছে। কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্পের আওতায় এই চ্যানেল নির্মাণ করা হলেও বন্দরের জন্য তা আরো ১০০ মিটার চওড়া করতে হবে।
জানা যায়, প্রথম পর্যায়ে বরাদ্দ পাওয়া ভূমিতে প্রথম দফায় দুটি জেটি নির্মাণ করা হবে। এরমধ্যে ৪৬০ মিটার দৈর্ঘ্যরে একটি কন্টেইনার জেটি এবং ৩০০ মিটার দৈর্ঘ্যরে একটি মাল্টিপারপাস জেটি। এই দুই জেটি দিয়েই ২০২৫ সাল থেকে কনটেইনার হ্যান্ডেলিং কার্যক্রমের মাধ্যমে গভীর সমুদ্র বন্দরের সূচনা করতে চায় চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ।
কক্সবাজারের মহেশখালীর মাতারবাড়িতে কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প নেয় সরকার। জাইকার অর্থায়নে সেই প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে বঙ্গোপসাগর থেকে মাতারবাড়ি পর্যন্ত ১৪ দশমিক ৩ কিলোমিটার দীর্ঘ, ১৬ মিটার ড্রাফট (গভীরতা) এবং ২৫০ মিটার চওড়া চ্যানেল নির্মাণ হবে বিদ্যুৎ প্রকল্পের আওতায়। ইতিমধ্যে ১৪ মিটার ড্রাফট করাও হয়েছে এবং আগামী সেপ্টেম্বরে তা ১৬ মিটারে উন্নীতের কথা রয়েছে। এই চ্যানেল নির্মাণ হচ্ছে বলেই পরবর্তীতে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের আওতায় চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ ‘মাতারবাড়ি বন্দর উন্নয়ন প্রকল্প’ নামে প্রকল্পটি নেয়া হয়। এর ব্যয় ধরা হয় ১৭ হাজার ৭৭৭ কোটি ১৬ লাখ ১৩ হাজার টাকা। এর মধ্যে জাইকার ঋণ ১২ হাজার ৮৯২ কোটি ৭৬ লাখ ৫ হাজার টাকা, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের (নিজস্ব তহবিল) ২ হাজার ২১৩ কোটি ২৪ লাখ ৯৪ হাজার টাকা এবং বাংলাদেশ সরকারের ২ হাজার ৬৭১ কোটি ১৫ লাখ ১৪ হাজার টাকা। ২০২৬ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে প্রথম পর্যায়ের কজ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ মাতারবাড়ি বন্দরের অংশ এবং সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগ মাতারবাড়ি বন্দর উন্নয়ন প্রকল্পের সড়ক অংশ বাস্তবায়ন করবে। এছাড়া এই প্রকল্পের আওতায় রেলপথ নির্মাণের জন্য দোহাজারি-কক্সবাজার রেললাইন প্রকল্পের সাথে যুক্ত হওয়ার কথা রয়েছে।
উল্লেখ্য, চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে দেশের ৯২ শতাংশ পণ্য আমদানি-রপ্তানি হয়ে থাকে। দিন দিন আমদানি-রপ্তানি বাড়ছে। কিন্তু এখানে ১৯০ মিটার দৈর্ঘ্যরে বড় জাহাজ ভিড়তে পারে না। এই বন্দরের সর্বোচ্চ গভীরতা ৯ দশমিক ৫ মিটার। তাই বড় দৈর্ঘ্য ও বেশি ড্রাফটের জাহাজ ভেড়াতে মাতারবাড়ির বিকল্প নেই। মাতারবাড়ি চালু হলে এর সাথে চট্টগ্রাম, মোংলা ও পায়রা বন্দরের সাথে নেটওয়ার্ক আরো বাড়বে। কারণ বড় জাহাজগুলো মাতারবাড়িতে পণ্য নিয়ে আসবে। সেখান থেকে ছোটো জাহাজে করে দেশের অন্যান্য বন্দরে পণ্য পরিবহন অনেক সহজ হবে।