পদ্মা সেতু নির্মাণের নেপথ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় ছিলেন যারা 

সুপ্রভাত ডেস্ক »

বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় অবকাঠামো পদ্মা সেতু শনিবার উদ্বোধনের পর রবিবার থেকেই সেতুটি সর্বসাধারণের জন্য খুলে দেয়া হয়েছে।

প্রায় দুই যুগের পরিকল্পনার ফসল এই সেতুটির সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে বহু মানুষের শ্রম, মেধা এবং সময়। বাংলাদেশের নিজস্ব অর্থায়নে তৈরি এই সেতুটি নির্মাণে অংশ নিয়েছেন দেশ-বিদেশের বিশেষজ্ঞ ও প্রকৌশলীরা।

পদ্মা সেতু নির্মাণে কারা কারা কাজ করেছিলেন, কী ছিল তাদের ভূমিকা, সেসব নিয়ে এই প্রতিবেদন।

পদ্মা সেতুর নকশা করেছে কে?

প্রকল্প পরিচালক মোঃ শফিকুল ইসলাম বিবিসি বাংলাকে বলছেন, ”পদ্মা সেতুর নকশা, নির্মাণ, তদারকি- এসব কাজ অনেক মানুষ মিলে করেছেন। সেখানে একক অবদান কারও কিছু নেই।”

”আমাদের অনেক কনসালট্যান্ট ছিলেন, তারা যখন কোন প্রস্তাব নিয়ে এসেছেন, সেটা আমাদের বিশেষজ্ঞরা যাচাই বাছাই করে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ব্যাপারটা এককভাবে নয়, যৌথভাবে হয়েছে বলা যায়। ”

পদ্মা সেতুর নকশার দায়িত্ব ছিল নিউজিল্যান্ড ভিত্তিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান এইসিওম। নকশা ও প্রকৌশল পরামর্শক প্রতিষ্ঠানটি ১৯৯০ সাল থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে কার্যক্রম শুরু করে। তবে তাদের ওয়েবসাইটে দাবি করা হয়েছে, তাদের প্রতিষ্ঠানের বয়স ১২০ বছর।

নিউ ইয়র্ক স্টক এক্সচেঞ্জে নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠানটি পাঁচটি কোম্পানি একসাথে মিলে তৈরি হয়েছিল। পরবর্তীতে আরও ৫০টি কোম্পানি তাদের সঙ্গে যোগ দেয়।

২০০৯ সালে হংকংয়ে এই কোম্পানির নেতৃত্বে পদ্মা সেতুর নকশা তৈরির কাজ শুরু হয়। তবে তাদের সাথে আরও ছিল অস্ট্রেলিয়ার এসমেক ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড, কানাডার নর্থ ওয়েস্ট হাইড্রোলিক কনসালটেন্টস এবং বাংলাদেশি এসিই কনসালটেন্টস লিমিটেড।

অধ্যাপক শামীম জেড বসুনিয়া বিবিসি বাংলাকে বলছেন, তারা মিলে প্রথম পদ্মা সেতুর একটি নকশা দেয়। সেই নকশা আলাপ আলোচনার মাধ্যমে চূড়ান্ত করা হয়েছিল। বর্তমান সময়ে যেভাবে নকশা হয়, তাতে যে প্রতিষ্ঠান নকশা তৈরি করে, তাদের নামেই পরিচিত হয়, সেখানে ব্যক্তি কারও নাম থাকে না।

তবে প্রকল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পদ্মা সেতুর নকশায় এইসিওম টিমের নেতৃত্ব দিয়েছেন ব্রিটিশ নাগরিক রবিন শ্যাম। লম্বা স্প্যানের নকশা প্রণয়নে বিশেষজ্ঞ হিসাবে তার পরিচিত রয়েছে। নকশা প্রণয়নে ব্যবস্থাপক হিসাবে এসমেক ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেডের হয়ে কাজ করেন অস্ট্রেলিয়ার কেন হুইটলার।

পদ্মা নদীর মতো খরস্রোতা নদীতে সেতুর মতো বিশাল অবকাঠামোর ক্ষেত্রে শুধুমাত্র সেতুর নকশাই যথেষ্ট নয়। তার সঙ্গে নদী শাসনের নকশাও তৈরি করতে হয়।

আর নদী শাসনের নকশা তৈরি করেছিলেন কানাডার ব্রুস ওয়ালেস। তার সঙ্গে ছিলেন জার্মানি আর যুক্তরাষ্ট্রর প্রকৌশলীরাও।

১১ সদস্যের বিশেষজ্ঞ কমিটি

পদ্মা সেতু বাস্তবায়নে বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছিল। সেতু সংক্রান্ত কারিগরি যেকোনো বিষয়ে এক কমিটির মতামত ছিল চূড়ান্ত।

বাংলাদেশের বিশেষজ্ঞ কমিটির প্রধান ছিলেন অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী। তার মৃত্যুর পর এই কমিটির প্রধান হন অবকাঠামো বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক শামীম জেড বসুনিয়া।

এই কমিটিতে আরও আছেন নদী বিশেষজ্ঞ আইনুন নিশাত, পরিবেশ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ফিরোজ আহমেদ ও পাইলিং বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক হোসাইন মোঃ শাহিন। কমিটিতে থাকা মাটি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক এ এম এম সফিউল্লাহ গত বছর মারা যান।

এছাড়া এই কমিটিতে জাপানের দুজন, নেদারল্যান্ডস, ডেনমার্ক ও যুক্তরাষ্ট্রের একজন করে বিশেষজ্ঞ ছিলেন।

পদ্মা সেতুর নকশা, অবকাঠামো, পাইলিং, সংযোগ সড়ক ইত্যাদি বিষয়ে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বা কনসালট্যান্টদের পরামর্শের বিষয়ে এই কমিটি চূড়ান্ত মতামত দিয়েছে। সেই অনুযায়ী সেগুলো বাস্তবায়ন বা পরিবর্তন করা হয়েছে।

এর বাইরে স্টিয়ারিং কমিটি ও প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি ছিল। এসব কমিটির সদস্য সংখ্যা ছিলেন নয়জন করে, যাদের বেশিরভাগই সেতু বিভাগ, অর্থ মন্ত্রণালয় ও বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা। তাদের কাজ ছিল প্রকল্প পর্যালোচনা, মূল্যায়ন ও অগ্রগতি পর্যবেক্ষণ করা।

এদের মধ্যে মোঃ শফিকুল ইসলাম ২০১১ সাল থেকে প্রকল্প পরিচালক হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন। সড়ক ও জনপদ বিভাগের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী পদ থেকে তাকে এই পদে আনা হয়। তার মূল কাজটি ছিল পদ্মা সেতু প্রকল্পের বাস্তবায়ন করা।

২০১৩ সালে তিনি চাকরি থেকে অবসরে গেলেও সরকার তাকে সেই পদেই রেখে দেয়। তার হাত ধরেই পদ্মা সেতু প্রকল্পের সমাপ্তি হয়েছে।

যেভাবে হয়েছে পদ্মা নদী শাসনের কাজ

সারা বিশ্বে খরস্রোতা যতো নদী আছে তার একটি বাংলাদেশের পদ্মা নদী। এই নদীতে প্রবাহিত পানির পরিমাণ, নদীর গভীরতা ও প্রশস্ততা এবং তলদেশে মাটির ধরণ – এসব কিছুর কারণে এর উপর সেতু নির্মাণ করা ছিল অসম্ভব রকমের কঠিন এক কাজ।

পদ্মা নদী একটি অ্যালুভিয়াল নদী অর্থাৎ পলল-শিলার মধ্য দিয়ে এই নদী একে বেঁকে সাপের মতো প্রবাহিত হচ্ছে।

প্রকৌশলীরা বলছেন, এরকম বিশাল ও প্রমত্তা নদীর ওপর এতো বড়ো সেতু নির্মাণের কাজ প্রকৌশলগত দিক থেকে ছিল বিরাট চ্যালেঞ্জ।

পদ্মা সেতু নির্মাণ কাজে বিশেষজ্ঞ দলের একজন সদস্য ড. আইনুন নিশাত, যিনি নদী ব্যবস্থাপনার কাজ তদারকি করেছেন, তিনি বলছেন পদ্মার তলদেশে এবং দু’পাশে নরম মাটি ও বালি। একারণে কাজটা ছিল বেশ কঠিন ও জটিল।

“নরম হওয়ার কারণে নদীর তল অনেক গভীরে চলে যেতে পারে অথবা দুই পাশ ভাঙতে পারে। শীতের সময় পদ্মা নদীতে গভীরতা থাকে ১০০ ফুটের কাছাকাছি। বর্ষার সময় এই গভীরতা দ্বিগুণ হয়ে যায়। একারণে চ্যালেঞ্জ ছিল নদীর ওই গভীরতায় সেতুর যেসব পাইল বসানো হবে সেগুলোর ফাউন্ডেশন তৈরি করা,” বিবিসি বাংলাকে বলেছেন তিনি।

পদ্মা সেতু নির্মাণ করতে গিয়ে ধাপে ধাপে অনেক জটিলতা তৈরি হয়েছে এবং সেসব সামাল দিতে পরিবর্তন করতে হয়েছে সেতুর নকশাও।

আইনুন নিশাত জানান, যখন পদ্মা সেতুর সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয় তখন মাটির গুণাবলীর যেসব খবর নেয়া হয়েছিল তাতে দেখা গিয়েছিল যে তলায় হমোজেনিয়াস সয়েল বা সব একই ধরনের মাটি।

কিন্তু সেতু নির্মাণ করতে গিয়ে দেখা গেল বেশ কিছু পাইলের নিচে কাদামাটির স্তর। তখন কাদামাটির ওই স্তর ভেদ করে আরও গভীরে পাইলের ফাউন্ডেশন নির্মাণ করতে হয়েছে। তিনি বলেন, সেতুর ভার বহন করার জন্য এর যতোটা গভীরে পাইল বসানোর দরকার ছিল সেটা ছিল অসম্ভব এক চ্যালেঞ্জ। এতো গভীরে যেতে হয়েছে কারণ উপরের ৬০ থেকে ৭০ মিটার শুধু পানি, যেখানে পাইলের কোন শক্তি নেই। অনেক গবেষণা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেও শেষ পর্যন্ত ওই গভীরতায় পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। তখন সেতুর নকশা পরিবর্তন করা হয়েছে।

নির্মাণ কাজের তদারক রবার্ট জন এভস

পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজের তদারকি দলের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন নিউজিল্যান্ডের নাগরিক রবার্ট জন এভস।

পদ্মা সেতুর পুরো নির্মাণ কাজ তদারকির কাজ পেয়েছিল কোরিয়ান কোম্পানি কোরিয়া এক্সপ্রেসওয়ে কর্পোরেশন (কেইসি)। তাদের কাজ ছিল পুরো নির্মাণ কাজটি ঠিক মতো হচ্ছে কিনা, সেটা নিশ্চিত করা। সেতু নির্মাণের কাজ পেয়েছিল চীনের মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং।

কেইসি তদারকি কাজের প্রধান হিসাবে নিয়োগ করে রবার্ট জন এভসকে।

অধ্যাপক শামীম জেড বসুনিয়া বলছেন, ”প্রজেক্ট ম্যানেজার রবার্ট এভস খুব দক্ষ একজন ব্যক্তি। খুব ভালোভাবে তিনি সব সামলেছেন। ”

পদ্মা নদীর দুই পাড়ের সংযোগ সড়ক আর সার্ভিস এরিয়া (নির্মাণ কাজের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা যেখানে থাকেন) তৈরির দায়িত্ব পেয়েছিল বাংলাদেশি কোম্পানি আব্দুল মোনেম লিমিটেড। মালয়েশিয়ান একটি কোম্পানির সঙ্গে মিলিত হয়ে তারা কাজটি পায়।

তাদের কাজের তদারকির দায়িত্ব পেয়েছিল বাংলাদেশ সেনাবাহিনী।

পদ্মা সেতু নির্মাণের সঙ্গে অন্তত ২০টি দেশের নাগরিকরা জড়িত ছিলেন। এসব দেশের মধ্যে আছে চীন, ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, জার্মানি, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, নেদারল্যান্ডস, সিঙ্গাপুর, জাপান, ডেনমার্ক, ইতালি, মালয়েশিয়া, কলম্বিয়া, তাইওয়ান, নেপাল ও দক্ষিণ আফ্রিকা।

তার মধ্যে প্রকল্প বাস্তবায়নের সাথে সরাসরি যুক্ত ছিলেন ১৩৮ ব্যক্তি।

পদ্মা সেতু নিয়ে কিছু তথ্য

পদ্মা সেতুতে গাড়ির লেন রয়েছে একেক পাশে দুটো করে এবং একটি ব্রেকডাউন লেন। অর্থাৎ মোট ছয় লেনের সেতু এটি, যদিও একে বলা হচ্ছে ফোর লেনের ব্রিজ।

পদ্মা সেতুর দৈর্ঘ্য (পানির অংশের) ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার। তবে ডাঙার অংশ ধরলে সেতুটির মোট দৈর্ঘ্য নয় কিলোমিটারের বেশি।

দ্বিতল পদ্মা সেতুর এক অংশ মুন্সীগঞ্জের মাওয়ায়, আরেক অংশ শরীয়তপুরের জাজিরায়।

সেতুর ওপরে গাড়ি চলাচল শুরু হয়েছে। রেল চলাচল করতে সময় লাগবে আরও।

পদ্মা সেতু নির্মাণে মোট খরচ করা হচ্ছে ৩০ হাজার ১৯৩ দশমিক ৩৯ কোটি টাকা। খরচের মধ্যে রয়েছে সেতুর অবকাঠামো তৈরি, নদী শাসন, সংযোগ সড়ক, ভূমি অধিগ্রহণ, পুনর্বাসন ও পরিবেশ, বেতন-ভাতা ইত্যাদি।

সূত্র : বিবিসি বাংলা