নতুন সম্ভাবনা ‘সোনালী লোহা’ বছরে আয় ৪শ’ কোটি টাকা

বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের

নিজস্ব প্রতিনিধি, উখিয়া :
কক্সবাজার-টেকনাফ সড়কের বালুখালী থেকে মাত্র ২ কিলোমিটার পূর্বে ঘুমধুম মৌজার ২৫ একর পাহাড়ি পরিত্যক্ত জমিতে গড়ে উঠা আকিজ গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ এর মালিকানাধীন ‘আকিজ ওয়াইল্ড লাইফ ফার্ম’ নামের কুমির প্রকল্প আয়ের মুখ দেখছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আগামী অর্থ বছরে ওই খামার থেকে কুমির রপ্তানির মাধ্যমে ৪শ’ কোটি টাকা বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সম্ভাবনা রয়েছে। পাশাপাশি এ কুমির শিল্পকে ঘিরে গড়ে উঠা ক্ষুদ্র পর্যটন শিল্পের মনোরম পরিবেশ উপভোগ করতে দূরদূরান্ত থেকে লোকজন ছুটে আসতে দেখা গেছে। দর্শনার্থীদের অভিযোগ কুমির প্রকল্পের ৫০ টাকা ফি নিলেও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন করা হয়নি। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বেড়ে উঠা এ কুমির প্রকল্পটির উন্নয়ন করা হলে পর্যটন খাতে রাজস্ব আয়ের সম্ভাবনা ছিল বলে মনে করছেন পরিবেশবাদী সচেতন মহল।
দক্ষিণ এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম এ কুমির খামারটির কার্যক্রম ২০০৮ সালে শুরু হলেও বাণিজ্যিকভাবে কুমির চাষাবাদ শুরু হয় ২০১০ সালে। কুমিরের এই খামারটি নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা থেকে ৪৫ কিলোমিটার দূরত্বে কক্সবাজার-টেকনাফ সড়কে কাছাকাছি ঘুমধুম পাহাড়ি এলাকার তুমব্রু গ্রামে অবস্থিত। তুমব্রু গ্রামটি মিয়ানমার সীমান্তের এমনই কাছে যে, পাহাড় থেকে দেখা যায় মিয়ানমারও। বর্তমানে ওই খামারে কাজ করছেন দুজন প্রকল্প কর্মকর্তার অধীনে অর্ধশতাধিক কর্মচারী। ২০১০ সালের আগস্টে অস্ট্রেলিয়া ও মালয়েশিয়া থেকে ৫০টি অস্ট্রেলিয় প্রজাতির কুমির আনা হয়। এর একেকটির দাম পড়ে তিন লাখ টাকা। পরে নাইক্ষ্যংছড়ির ওই খামারের উন্মুক্ত জলাশয়ে সেগুলো ছাড়া হয়। এর মধ্যে অজ্ঞতা ও আবহাওয়ার বিরূপ প্রভাবের কারণে মারা যায় ৪টি কুমির। ৪৬টি সুস্থ কুমিরের মধ্যে পরে স্ত্রী কুমিরের সংখ্যা দাঁড়ায় ৩১টি এবং পুরুষ কুমির ১৫টি। সেই ৪৬টি কুমির থেকে নাইক্ষ্যংছড়ির আকিজ ওয়াইল্ড লাইফ ফার্মে বর্তমানে খামারে বাচ্চাসহ ছোট-বড় কুমিরের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ৪শ’টি কুমির। খামারে উন্মুক্ত জলাশয় ও খাঁচার ভেতরে দুভাবেই কুমির রাখা হয়েছে।
প্রাণিবিজ্ঞানীদের মতে, এসব কুমির প্রায় ১০০ বছর বাঁচে। প্রাপ্তবয়স্ক হতে একেকটি কুমিরের সময় লাগে অন্তত ৮ থেকে ১২ বছর। প্রাপ্তবয়স্ক হবার পর তারা হাঁস-মুরগির মতো ডিম দেয়। তবে কুমিরের ডিমের আকৃতি রাজহাঁসের মতো বড়। এরা ডিম দেয় বর্ষাকালে। সাধারণত ২০টি থেকে ৮০টি করে ডিম দেয় একেকটি প্রাপ্তবয়স্ক স্ত্রী কুমির। ৩২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ৮০ থেকে ৮৬ দিনেই ডিম থেকে ক্ষুদে ক্ষুদে ফুমির ছানারা ফুটে বের হয়। এখানে কুমিরের বাচ্চা ফোটানো হয় ইনকিউবেটরে। ডিম ফোটার সঙ্গে সঙ্গেই ক্ষুদে বাচ্চাদের সংগ্রহ করে আরেকটি ইনকিউবেটরে রাখা হয়। কারণ বাচ্চাগুলোর নাভি থেকে কুসুম ছাড়তে সময় লাগে ৭২ ঘণ্টা। এরপর শিশু কুমিরদের নার্সারিতে নিয়ে ৩২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় রাখা হয়। জন্মের পর একটি কুমির প্রায় ১২ ইঞ্চি লম্বা হয়ে থাকে। প্রায় দুই বছর বয়স হবার পর বাচ্চা কুমিরগুলোকে আকার ভেদে পুকুরে স্থানান্তর করা হয়।
কুমির প্রকল্পের কেয়ারটেকার ঝুলন কান্তি দে জানান, ডিসেম্বরের মধ্যেই আকিজ ওয়াইল্ড লাইফ ফার্ম থেকে প্রায় ৪ শতাধিক কুমির মালয়েশিয়ায় রপ্তানি হতে যাচ্ছে। রপ্তানির জন্য তৈরি করা এসব কুমির গড়ে ৫ ফুট লম্বা। এগুলোর ওজন ২০ থেকে ২৫ কেজি। চামড়া ছাড়াও কুমিরের প্রতি কেজি মাংস ৩০ ডলারে বিক্রি হয় বিদেশে। ১২ ডলার দামে বিক্রি হয় ১ বর্গ সেন্টিমিটার চামড়া। কুমির রপ্তানি থেকে বছরে কমপক্ষে ৪০০ কোটি টাকা আয়ের সম্ভাবনা দেখছে প্রতিষ্ঠানটি।
তিনি আরো জানান, কুমিরের চামড়া বেশ দামি। এই চামড়া দিয়ে ব্যাগ, জুতাসহ অনেক দামি জিনিস তৈরি করা হয়। এছাড়া কুমিরের মাংস, হাঁড়, দাঁত এসবও দামি। কুমিরের হাড় থেকে তৈরি হয় পারফিউম। দাঁত থেকে গহনা বানানো হয়। আবার পায়ের থাবা থেকে চাবির রিং তৈরি হয়। কুমিরের মাংস বেশ সুস্বাদু ও পুষ্টিকর। তাই দেশে ও বিদেশে চাহিদা প্রচুর। এক কথায় কুমিরের কোন কিছুই ফেলনা নয়। কুমিরকে বলা হয় গোল্ড আয়রন অর্থাৎ ‘সোনালী লোহা’।