দুই দিনের দূরত্বকে করেছে দেড় ঘণ্টা

আলীকদম-পোয়ামুহুরী সড়ক

সুপ্রভাত ডেস্ক »

বান্দরবানের সীমান্তবর্তী কুরুকপাতা ইউনিয়নের দুর্গম এলাকা পোয়ামুহুরী। সেখান থেকে হেঁটে অথবা নৌকায় আলীকদম উপজেলা সদরে আসতে স্থানীয়দের সময় লাগত দুইদিন। মাঝখানে কোনো পাড়ায় উঠে রাতযাপন করতে হতো। সেই দুইদিন হয়েছে এখন দেড়ঘণ্টা! আলীকদম থেকে পোয়ামুহুরী পর্যন্ত ৩৭ কিলোমিটার দীর্ঘ সড়কটি তাই বদলে দিচ্ছে দুর্গম কুরুকপাতা ইউনিয়নের মানুষের জীবনযাপন। সড়কটি স্থানীয়দের কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবায় সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর পাশাপাশি ভূমিকা রাখবে পর্যটনেও। খবর বিডিনিউজের।

বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ৩৪ ইঞ্জিনিয়ার কনস্ট্রাকশন ব্রিগেডের অধীনে ১৬ ইঞ্জিনিয়ার কনস্ট্রাকশন ব্যাটালিয়ন (ইসিবি) ৪৭৪ কোটি ৪০ লাখ টাকা ব্যয়ে সড়কটির নির্মাণকাজ শেষ করেছে বলে জানিয়েছেন প্রকল্প কর্মকর্তা মেজর মো. ইশরাকুল হক।

সোমবার আলীকদম-পোয়ামুহুরী সড়কে ১০ কিলোমিটার এলাকায় মিনিপাড়া ভিউ পয়েন্টে সাংবাদিকদের বিফ্রিংকালে মেজর ইশরাকুল জানান, ২০১৭ সালে আলীকদম-জানালিপাড়া-কুরুকপাতা-পোয়ামুহুরী পর্যন্ত সড়ক নির্মাণের দায়িত্ব পায় সেনাবাহিনী।

৩৭ কিলোমিটার দীর্ঘ সড়কটির নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছিল ৫০৯ কোটি ২৯ লাখ টাকা, কিন্তু গুণগত মান বজায় রেখে সড়কটির নির্মাণকাজ শেষ করা হয়েছে ৪৭৪ কোটি ৪০ লাখ টাকায়। এ ছাড়া ২০২২ সালের ৩০ জুনে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও ৬ জুনই প্রকল্পের কাজ শেষ হয়। ফলে সাশ্রয় হয়েছে পাঁচ কোটি টাকা।

এই প্রকল্পের আওতায় নির্মাণ করা হয়েছে ১০টি ব্রিজ, ১১টি কালভার্ট ও চারটি ভিউ পয়েন্ট। এ ছাড়া ক্রস ড্রেন, সাইট ড্রেন, রিটেইনিং ওয়াল, আর্থ ওয়াটার ড্যাম ও রোড সাইন নির্মাণ করা হয়েছে বলে জানান এই প্রকল্প কর্মকর্তা।

মেজর মো. ইশরাকুল হক জানান, সড়কটি নির্মাণের ফলে স্থানীয়দের কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবাসহ নানা সুযোগ-সুবিধা বাড়বে। উঁচু নিচু এই সড়কের বিভিন্ন স্থানে পর্যটকদের জন্য আকর্ষণীয় স্থানও নির্মিত হয়েছে। ফলে পর্যটন শিল্পের বিকাশ স্থানীয়দের জীবনমান উন্নয়নেও ভূমিকা রাখবে।

এই সড়কটি নির্মাণের আগে কুরুকপাতা ইউনিয়নের বাসিন্দাদের উপজেলা সদরে আসতে হতো হেঁটে অথবা নৌকায়। বর্ষা মৌসুমে কখনও কখনও সব ধরনের যাতায়াত ব্যবস্থাই বিচ্ছিন্ন হয়ে যেত। যার ফলে চিকিৎসাসেবা, কৃষিপণ্য বাজারজাতকরণ ও শিক্ষা ক্ষেত্রে চরম ভোগান্তিতে পড়ত এলাকার বাসিন্দারা।

সম্প্রতি আলীকদম-পোয়ামুহুরী সড়কে গিয়ে দেখা যায়, মাতামুহরী নদীর কোল ঘেঁষে নির্মিত সড়কটির একদিকে নদীর আঁকাবাঁকা দৃশ্যের দেখা মেলে; আর অন্যদিকে উপভোগ করা যায় সবুজ পাহাড়ের সৌন্দর্য।

সড়কের কোথাও কোথাও পাহাড়চূড়ায় বানানো হয়েছে দৃষ্টিনন্দন ভিউ পয়েন্ট। সেখান থেকে উভয় পাশের অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়।
তবে সড়কটিতে এখনও যাত্রীবাহী পরিবহন চালু করা হয়নি। ভাড়ায়চালিত মোটরসাইকেলে যাতায়াত করে স্থানীয়রা। এ ছাড়া স্থানীয় কৃষিপণ্যের জন্য ছোট ছোট মিনি ট্রাকের চলাচল রয়েছে সড়কটিতে।

প্রকল্প কর্মকর্তা মেজর মো. ইশরাকুল হক আরও বলেন, সড়কটি নির্মাণের কারণে এর মধ্যে ম্রো ও ত্রিপুরাসহ পাহাড়ি বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর আর্থ-সামাজিক জীবনে উন্নয়নের ছোঁয়া লেগেছে। পাহাড়িদের তাঁত ও অন্যান্য হস্তশিল্পের বাজার বাড়ছে। যোগাযোগ ব্যবস্থা তৈরি হওয়ায় স্থানীয় ফল ও ফসল দ্রুত শহরে পৌঁছে যাচ্ছে।
তাছাড়া আলীকদম-জানালিপাড়া-কুরুকপাতা-পোয়ামুহুরী সড়কটি ৩১৭ কিলোমিটার সীমান্ত সড়কের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। ফলে সড়কটি দেশের ভূখ- রক্ষা ও সীমান্তে নিরাপত্তা বৃদ্ধিতেও ভূমিকা রাখবে।

সড়কটি বান্দরবানের অদেখা সৌন্দর্য উন্মোচন করবে পর্যটকদের সামনে। পর্যটনকে কেন্দ্র করে স্থানীয়দের অর্থনীতি আরও প্রসারিত হবে বলেও জানান তিনি।
কুরুকপাড়ার ইউপি চেয়ারম্যান ক্রাতপুং ম্রো বলেন, আগে পোয়ামুহুরী থেকে উপজেলা সদরে আসতে দুই দিন সময় লাগত। কুরুকপাতা থেকে সময় লাগত একদিন। মাঝখানে কোনো পাড়ায় উঠে রাতযাপন করতে হতো। দুর্গম এলাকায় কেউ অসুস্থ হলে চিকিৎসার জন্য চরম ভোগান্তিতে পড়তে হতো।

‘এখন মোটরসাইকেলে পোয়ামুহুরী থেকে দেড় ঘণ্টায় আর কুরুকপাতা থেকে ৪০ মিনিটে আলীকদম সদরে পৌঁছে যেতে পারি। এতে সময় ও খরচ সাশ্রয় হয়েছে। যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে উৎপাদিত কৃষি পণ্য ও জুমের ফসলাদি দ্রুত বাজারে নিয়ে যেতে পারবে চাষিরা। ফলে কৃষকরা ফসলের ন্যায্যমূল্য পাবে।’

কুরুকপাতা ইউনিয়ন পরিষদের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার মেনরোয়া ম্রো বলেন, ‘কিছু এলাকায় প্রতি বছর বর্ষার মৌসুম শুরুর আগে ডায়রিয়ার প্রকোপ দেখা দেয়। দুর্গম এলাকা হওয়ায় চিকিৎসা সুবিধা থেকে বঞ্চিত হতে হয়। হাসপাতালে নিয়ে চিৎকিসা করানোর উপায় ছিল না।’

ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে কিছু শিশু মারাও যায়। সড়ক হওয়ায় এখন থেকে দ্রুত চিকিৎসা করার সুযোগ পাওয়া যাবে বলে জানান তিনি।

১২ কিলোমটিার এলাকায় জিরা পাড়ার বাসিন্দা রামবতি ত্রিপুরা ও রামবাহাদুর ত্রিপুরা বলেন, সড়ক নির্মাণের পর থেকে স্থানীয়রা জুমচাষের পাশাপাশি বিভিন্ন ফলের বাগান করা শুরু করেছে। আগে বাগান করার সুযোগ থাকলেও পরিবহনের কথা চিন্তা করে কেউ বাগান করত না।

আগে এ এলাকায় উৎপন্ন হওয়া আদা ও হলুদ নৌকায় করে উপজেলা সদর নিয়ে বিক্রি করতে হতো। তাতে লাভের অংশ নৌকার খরচে চলে যেত। কিন্তু সড়ক নির্মাণ হওয়ায় এখন ব্যাপারীরা পাড়ায় এসেই মণকে মণ আদা ও হলুদ নিয়ে যায়।

এখন কৃষিপণ্যের ন্যায্য মূল্য পাওয়া যাচ্ছে জানিয়ে তারা আরও বলেন, এখন আগের তুলনায় বিভিন্ন এলাকায় চাষও বাড়ছে। আর কৃষিপণ্যের উৎপাদন বাড়তে থাকলে স্থানীয়দের মধ্যে আর্থিক স্বচ্ছলতাও আসবে।