জাতি ও ধর্মগত সংখ্যালঘুদের নায্য ও সমতার অধিকার

কাশেম আদনান »

সৌরজগতের প্রান্ত থেকে পৃথিবীকে দেখলে একটি ছোটখাটো বিন্দুর মতো দেখায়। একটি অতি ক্ষুদ্র নীল বিন্দু বিশেষ! সৌর পরিবার পার হয়ে গেলে সেই বিন্দুটিকেও আর দেখা যায় না। সেই বিন্দু রূপ এই সুন্দর পৃথিবীতে বাস করি আমরা প্রায় ৮০০ কোটি মানুষ।
সমগ্র পৃথিবীতেই মানব জাতির বসবাস। আমাদের কারুর গায়ের রং সাদা,কারো বাদামি, হলুদ, পীত, গোলাপি কিংবা ঘোর কৃষ্ণবর্ণ। আমরা বিভিন্ন ধর্মে বিভক্তÑমুসলিম, হিন্দু, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ, শিখ, জৈন, ইহুদি ইত্যাদি।
বিভিন্ন জাতি ধর্ম বর্ণ গোত্র লিঙ্গে বিভক্ত হলেও আমাদের ক্ষুধা-তৃষ্ণা,সুখ দুঃখের অনুভূতি এক। আমাদের সকলের রক্তের রংও একই – লাল। জন্মসূত্রেই আমরা দেহের রং, আকার আকৃতি , ধর্মীয় পরিচয় পেয়ে থাকি। এতে কারো হাত নেই। কিন্তু কি মর্মান্তিক দুঃখের বিষয়, জন্মসূত্রে অর্জিত এই পরিচয়ের কারণেই এখন দেশে দেশে,পদে পদে অপমান ও নিগ্রহের শিকার হতে হচ্ছে মানুষকে। সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় বঞ্চনা, নির্যাতন – নিপীড়নের শিকার হতে হচ্ছে। রাজনৈতিক বিবেচনায় তাদেরকে অধিকারহীন ও কোণঠাসা করা হচ্ছে দেশে দেশে। শত শত বছরের নাগরিকত্ব কেড়ে নিয়ে রাষ্ট্রহীন করে দেওয়ার পাঁয়তারা চালানো হচ্ছে। স্বদেশেই পরবাসীর জীবন যাপনে বাধ্য করা হচ্ছে। কোন কোন জাতিগোষ্ঠীকে বর্বরতম এবং নৃশংস গণহত্যার মাধ্যমে নির্মূল, নির্বংশ এবং দেশত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে এবং হচ্ছে। প্রতিবেশী মিয়ানমারের সেনা জান্তা ইতিহাসের ভয়াবহতম অত্যাচার, নির্যাতন, ধর্ষণ, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ ও গণহত্যার মাধ্যমে লক্ষ লক্ষ রোহিঙ্গা মুসলিম নারী পুরুষ শিশুকে তাদের জন্মস্থান থেকে বিতাড়িত করেছে।
তাদের কি অপরাধ ? শুধু একটিই অপরাধ, আর তা হল,তারা মুসলমান, সংখ্যালঘু। অথচ তারা শত শত বছর ধরে মিয়ানমারে বসবাস করে আসছিল। পাশের দেশ, তথাকথিত সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র চীনেও একই পরিস্থিতি। কেবলমাত্র মুসলিম হওয়ার কারণেই উইঘুরে লক্ষ লক্ষ মুসলিম জনতার ওপর চালানো হচ্ছে অমানবিক, পাশবিক নির্যাতন। শুদ্ধি অভিযানের নামে কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে নিয়ে তাদের ওপর যে বর্বর আচরণ করা হচ্ছে, সে সম্পর্কে জেনে সভ্য সমাজ স্তম্ভিত হয়ে গেছে।
প্রতিবেশী ভারতেও উগ্র বর্ণবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। সে দেশের মুসলমানদের অভিযোগ এবং বিশ্ব গণমাধ্যমের সংবাদ থেকে জানা যায়, সংখ্যালঘু মুসলমানদের নিগৃহীত করার জন্যই বহু বিতর্কিত নাগরিকত্ব আইন সহ বিভিন্ন নিবর্তনমূলক আইন তৈরি করা হয়েছে।ক্ষমতা ও ভোটের রাজনীতির কারণে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ক্রমাগত ঘৃণা ও বিদ্বেষ ছড়ানো হচ্ছে। ফলে সংখ্যালঘু মুসলমানদের ওপর নিপীড়ন নির্যাতন পূর্বের চেয়ে অনেক বেড়ে গেছে। তারা সামাজিক এবং অর্থনৈতিক ভাবে আরো পিছিয়ে পড়ছে। পড়ছে নিরাপত্তাহীনতার সংকটে।
বর্ণবাদ, সাম্প্রদায়িকতা, ঘৃণা-বিদ্বেষ কখনো স্থায়ীভাবে মানব জাতির জন্য কল্যাণকর হতে পারে না। এ ধরনের ঘৃণা-বিদ্বেষ এর রাজনীতি নিঃসন্দেহে সমাজে হিংসা,বিভাজন, দ্বন্দ্ব ও অশান্তির সৃষ্টি করে। এটি অপরাজনীতি। এর মাধ্যমে কোন কোন স্বার্থান্বেষী মহল সাময়িক সুবিধা লাভ করতে পারলেও মানব জাতির জন্য তা কখনো শান্তি বয়ে নিয়ে আসবে না।
মানুষে মানুষে ঘৃণা নয় বরং মানুষে মানুষে ভালোবাসা ও সম্প্রীতিই বেশি প্রয়োজন।এবং একটি সুষ্ঠু রাজনীতির মূলকথাও তাই। বড় বড় পুঁজিপতি এবং কর্পোরেট গ্রুপের প্রতিভূ হিসেবে বর্তমান বিশ্বে চলমান অপরাজনীতি দেশে দেশে বর্ণবাদ এবং সাম্প্রদায়িকতা উস্কে দিয়ে, বিষ-বাষ্প ছড়িয়ে তলে তলে মুনাফা লুণ্ঠনের নিয়ামক হিসেবে কাজ করছে, যা অত্যন্ত ভয়াবহ এবং চরমভাবে নিন্দনীয় । বিশ্বের নানা প্রান্তে সংখ্যালঘু, আদিবাসী, নৃ- গোষ্ঠীর ওপর নিপীড়ন নির্যাতন আজো অব্যাহত রয়েছে। প্রবল প্রতাপান্বিত জাতি-ধর্ম গোষ্ঠী দুর্বল জনগোষ্ঠীকে সকল অধিকার থেকে বঞ্চিত করছে। এমন কি পাশ্চাত্যের অনেক সভ্য দেশেও এ ধরণের অবিচার, অন্যায্যতার কাহিনী আছে। সাম্প্রতিক সময়ে ফিলিস্তিনিদের ওপর জায়নবাদী ইসরাইলি সরকারের বর্বরতা, বোমা হামলায় একটি জনপদ অনেকটা বিপর্যস্ত হয়েছে। ফিলিস্তিনিরা নিজ দেশেই পরবাসী। সিরিয়া, ইরাক, ইয়েমেনে চলছে ভ্রাতৃঘাতি যুদ্ধ, সংঘাত। সা¤্রাজ্যবাদী ও ধনশালী রাষ্ট্রগুলি এই বিভেদ উস্কে দিচ্ছে। শুধু মধ্যপ্রাচ্য নয়, এশিয়া, আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকার নানা দেশে সংঘাত, জাতি-ধর্মে-বর্ণে- গোত্রে। ইউরোপের তথাকথিত সভ্য দেশগুলিও আজ উগ্র জাতীয়তাবাদী, রক্ষণশীল ধারণায় আক্রান্ত। অথচ একটি ভারসাম্যমূলক, মানবিক পৃথিবী গড়তে নায্যতা, সমতা, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, জাতি-ধর্ম- গোত্রগত সম্প্রীতি ও সহিষ্ণু দর্শনের চর্চা আবশ্যক। এ কাজটি শান্তিকামী, বিবেকবান লেখক, বুদ্ধিজীবী, সমাজচিন্তক ও রাজনীতিবিদগণ শুরু করতে পারেন। বিশ্ব শান্তি ও মানবতার জন্য এটি আজ জরুরি।
যে শিশু আজ ভূমিষ্ঠ হয়েছে কোন সংখ্যালঘু বা আফ্রিকার কোন কৃষ্ণাঙ্গ পরিবারে, তার কি অপরাধ? জন্মের অপরাধেই কি সে সারাটা জীবন মার খেয়ে যাবে ? শিকার হতে থাকবে সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় নিগ্রহের? জন্মই কি তার আজন্ম পাপ ?
লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক