জমে উঠেছে শুঁটকি পল্লী

উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ৫০ টন

সংবাদদাতা, আনোয়ারা »

ইলিশের জোয়ার-ভাটা কাটিয়ে, মাছের সুদিন-দুর্দিন পেরিয়ে চট্টগ্রামের উপকূলে এখন জমে উঠেছে শুঁটকি পল্লী।

জানা গেছে, তরতাজা ইলিশ মাছের স্বাদ নেওয়া শেষে উপকূল জুড়ে চলছে এখন মাছ শুকিয়ে শুঁটকি তৈরি করার ব্যস্ততা। তাই পরিবার নিয়ে জেলেরা এখন ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন রূপচাঁদা, ছুরি, কোরাল, সুরমা, লইট্টা, পোপা, চিংড়ি, ছুড়িসহ বিভিন্ন মাছের শুঁটকি তৈরিতে। আর কম দামে এসব শুঁটকি কিনে আসল স্বাদ পেতে উপজেলার বিভিন্ন প্রান্তসহ চট্টগ্রামের শুঁটকি ব্যবসায়ী, আড়তদার এবং খুচরা ক্রেতারা ভিড় জমাচ্ছেন সমুদ্রের উপকূলে। সরকারি পর্যবেক্ষণ, অনুদানের মাধ্যমে যদি এই শিল্পের প্রতি সুদৃষ্টি দেওয়া হয় তাহলে এই শিল্পকে অনেক দূর এগিয়ে নেওয়া সম্ভব হবে বলে মনে করেন গহিরা এলাকার শুঁটকি কারিগর এবং ক্রেতারা।

উপজেলার উপকূলের বাচা মিয়া মাঝির ঘাটে দেখা গেছে, চাঠাই, প্লাস্টিক বিছিয়ে শুকানো হচ্ছে ছোট ছোট নানা রকমের মাছ। জেলেরা বাতাসের বিপরীতে দাঁড়িয়ে ঝেরে ঝেরে ছোট শুকনা চিংড়ি শুঁটকিগুলো থেকে ময়লা আবর্জনা আলাদা করছে। আর ছোট ছোট মেয়েরা ছোট-বড় শুঁটকি আলাদা আলাদা করে বেছে রাখছে। আবার অনেকেই দেখা যায়, বাঁশ দিয়ে মাচা তৈরি করে টাঙিয়ে শুকাচ্ছে ছুরি, কোরাল, সুরমা, লইট্টা ও পোপা মাছসহ হরেক রকমের সামুদ্রিক মাছ। জেলেরা সারিবদ্ধভাবে বেঁধে বেঁধে এসব মাছ শুকাচ্ছে। শুঁটকি তৈরি হওয়ার পর ড্রাম, লাই, বস্তায় ভরে ট্রাকে করে এসব নেওয়া হচ্ছে আশেপাশের হাটবাজারসহ বিভিন্ন জেলায়।

চিংড়ি মাছের শুঁটকি তৈরির কারিগর মোহাম্মদ ইসমাঈল জানান, মসজিদ কমিটি থেকে জায়গা ভাড়া নিয়ে এখানে প্লট ভাগ করে করে তেরপাল, প্লাস্টিক দিয়ে চিংড়ি শুকানোর জন্য তা প্রস্তুত করি। তারপর সাগর থেকে চিংড়ি এনে বিক্রি করা জেলেদের থেকে চিংড়ি মাছ কিনে তেরপালে শুকিয়ে শুঁটকি তৈরি করি। প্রতিবছর এই ঘাটে প্রায় ২-৩ হাজার মানুষ এই শুঁটকি তৈরি করার কাজে নিয়োজিত থাকে। আমাদের প্লটে আছে ৩০-৩৫ জন।

এই শুঁটকি ১দিনেই তৈরি হয়ে যায়, এগুলো কেজি ৬০০-৮০০ পর্যন্ত বিক্রি করি। ১০-১১ দিন পর পর তেরপালসহ সব কিছু পরিবর্তন করে আবার নতুন করে জায়গা তৈরি করি। এরকম এক ডালায় শ্রমিকের মজুরি, মাছের দাম, জিনিসপত্র সব মিলে লাখ টাকার উপর খরচ হয়। তবে সব মিলিয়ে বেশির ভাগ সময় লাখ-দেড় লাখ টাকা লাভ হয়। এইভাবে শীত মৌসুমে ৩-৪ মাস পর্যন্ত এই শুঁটকি তৈরির কাজ চলবে বলেও তিনি জানান।

রূপচাঁদা, ছুরি, কোরাল, সুরমা, লইট্টা, পোপাসহ বিভিন্ন বড় মাছের শুঁটকি কাজে কর্মরত আবুল কালাম বলেন, এসব শুঁটকি তৈরি করতে সপ্তাহ থেকে ১০ দিন মতো সময় লাগে। একবার শুঁটকি তৈরি করতে এই আড়তে ১ লাখ থেকে ১ লাখ ২০ হাজার মতো খরচ হয়। খরচ পুষিয়ে প্রায় ৫০ হাজার থেকে লাখ টাকা পর্যন্ত লাভবান হওয়া যায়।

ব্যবসায়ীরা জানান, এখানকার শুঁটকি বিক্রি হয় চট্টগ্রামের চাক্তাই এলাকার শুঁটকির আড়তগুলোতে। একেকটি শুঁটকি মহাল সপ্তাহে দুই থেকে তিন মণ শুঁটকি বিক্রি করে। কোন ধরনের কীটনাশক প্রয়োগ ছাড়াই প্রাকৃতিক উপায়ে উৎপাদিত এসব শুঁটকির দেশের বিভিন্ন স্থানে ব্যাপক চাহিদা রয়েছে বলে এখানকার শুঁটকি ব্যবসায়ীরা জানান।

গহিরা উপকূলের মাছ ব্যবসায়ী আব্দুল নবী বলেন, আমরা সমুদ্র থেকে আনা মাছ সংগ্রহ করে শুঁটকি ব্যবসায়ীদের কাছে ১৫০০ থেকে ২০০০ টাকায় বিক্রি করি। তারা এসব মাছ শুকিয়ে শুঁটকি তৈরি করে। আমি ছাড়াও এখানকার অনেক মাছ ব্যবসায়ী শুঁটকি ব্যবসায়ীদের কাছে মাছ বিক্রি করে লাভবান হচ্ছে।

উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা রাশিদুল হক বলেন, শীত মৌসুমের শুরু থেকেই উপজেলার উপকূলে শুঁটকি উৎপাদন শুরু হয়েছে। গত বছর ৩০ টন মতো শুঁটকি উৎপাদন করা হলেও এবার উৎপাদন বেড়ে ৫০ টনের মতো হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এছাড়াও বিষমুক্ত শুঁটকি উৎপাদনের ক্ষেত্রে শুঁটকি ব্যবসায়ীদেরও সচেতনতামূলক পরামর্শ দেওয়া হয়েছে এবং ডিডিটি পাউডার বা কীটনাশক না মেশালে শুঁটকির প্রকৃত স্বাদ পাওয়া যায় বলেও তিনি জানান।