করোনাকালে বিপর্যস্ত শিক্ষাব্যবস্থা : উদ্বিগ্ন অভিভাবক, শিক্ষার্থী

করোনা মহামারির কারণে দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো ১৪ মাস যাবত বন্ধ রয়েছে। এর ফলে সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থায় যেমন বিপর্যয় নেমে এসেছে, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরাও উদ্বিগ্ন অবস্থায় রয়েছেন। সরকার থেকে নানামুখি পদক্ষেপ নেওয়া হলেও সেসব ফলপ্রসূ হয়নি। আমাদের দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মুখি, দীর্ঘদিন ক্লাসমুখি না হওয়ায় লেখাপড়ার প্রতি আগ্রহ যেমন কমেছে, তেমনি শিক্ষার্থীদের মধ্যে মানসিক চাপও তৈরি হয়েছে। দুটি বেসরকারি সংস্থার জরিপে বলা হয়েছে, প্রাথমিক পর্যায়ে ১৯ ভাগ এবং মাধ্যমিক পর্যায়ে ২৫ শতাংশ শিক্ষার্থী শিখন ঘাটতি বা শিখতে না পারার ঝুঁকিতে রয়েছে। এমনিতে স্বাভাবিক সময়েও প্রাথমিক এবং মাধ্যমিকে ঝরে পড়ার বিষয়টি থাকলেও এবার করোনা মহামারিতে তা আরও মারাত্মক হয়েছে। ৩৩ শতাংশ দরিদ্র শিক্ষার্থী স্কুল ছেড়ে দেওয়ার আশঙ্কায় আছে। এমনিই বলা হয়েছে গবেষণায়, ১৫ শতাংশ শিক্ষাথী মানসিক চাপে রয়েছে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের ৯৫ শতাংশ অভিভাবক স্কুল খোলার পক্ষে মত দিয়েছেন। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেটরি রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) ও ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব ডেভেলাপমেন্ট অ্যান্ড গভর্নেস (বিআইজিডি) যৌথভাবে এই জরিপ পরিচালনা করে। গবেষণায় বলা হয়, সমাজের দরিদ্র শ্রেণিভুক্ত শিশুরা মহামারিতে সংকটাপন্ন, শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া, অর্থনৈতিক সমস্যাসহ দীর্ঘমেয়াদি নানা ঝুঁকি বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে প্রাথমিক থেকে উচ্চ শিক্ষা পর্যায়ভুক্ত প্রায় ৪ কোটি শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবন অনিশ্চিত অবস্থায় পড়েছে। মহামারির এই পরিস্থিতি কবে শেষ হবে কেউ বলতে পারছেনা বরং পরিস্থিতি দিনদিন খারাপ হচ্ছে। শিক্ষার ব্যয়ভার নিয়ে গ্রাম শহরের অভিভাবকরা উদ্বিগ্ন। মধ্যবিত্ত, নি¤œবিত্ত গরিব সকল স্তরের মানুষ খাদ্য, পুষ্টি, নিত্যপ্রয়োজনীয় খাতে ব্যয় কমাতে বাধ্য হয়েছেন। শিক্ষার ব্যয় যদি সরকার না দেয় কিংবা বরাদ্দ না বাড়ায় তবে এ ক্ষেত্রে পরিস্থিতি আরো জটিল হয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। গবেষণায় বলা হয়, দীর্ঘদিন স্কুল বন্ধ থাকায় বেশ কিছু শিশু মাদ্রাসায় ভর্তি হয়েছে। করোনার সময় এগুলি খোলা ছিল। সম্প্রতি সরকার তা বন্ধ করেছে। দূর শিক্ষণ শিক্ষা পদ্ধতি গ্রহণ করতে পেরেছে মাত্র ১০ শতাংশ শিক্ষার্থী। এ ছাড়া অনলাইনে ক্লাসের সুযোগ পাচ্ছে মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত পরিবারের শিক্ষার্থীরা, গ্রাম শহরের দরিদ্র, নি¤œবিত্ত পরিবারের সন্তান এ সুযোগ থেকে বঞ্চিত। এর ফলে ধনী-দরিদ্র, গ্রাম-শহর পর্যায়ে শিক্ষা বৈষম্য বাড়বে যা জাতির জন্য মঙ্গলজনক হবে না। করোনার সময় বাল্যবিয়ের কারণে কিশোরীদের ঝরে পড়ার হারও বেড়ে গেছে, অর্থনৈতিক কারণে শিশু-কিশোর শিক্ষার্থীরা পড়া ছেড়ে দিতে বাধ্য হচ্ছে। সংসারের অভাব-অনটন কমাতে অল্প বয়সে কাজে নেমে পড়ছে তারা। উচ্চ শিক্ষার স্তরে তরুণদের মানসিক চাপ বেড়ে যাচ্ছে, এক ধরণের ক্ষোভ, রাগ, অসহিষ্ণুতা, মানসিক অবসাদ এবং ভবিষ্যৎ লক্ষহীনতা তাদের গ্রাস করছে।
সরকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ-খোলা, সিলেবাস কমানো, পরীক্ষা এসব নিয়েই তাদের পরিকল্পনা সীমাবদ্ধ; সামগ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থায় যে বিপর্যয় নেমেছে তা মোকাবেলায় দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা, শিক্ষায় বরাদ্দ বাড়ানো, শিক্ষার্থীদের পরিবারের সামগ্রিক ক্ষতি মেটানো-এসব বিষয়ে ভাবতে হবে। স্কুল পর্যায়ে মিড ডে মিল, শিক্ষা বরাদ্দ বৃত্তি বাড়ানো, অভিভাবকদের আর্থিক সহায়তা, সিলেবাস সংক্ষিপ্ত করা, পর্যায়ক্রমে ক্লাস শুরু করার উদ্যোগ, শিক্ষক-কর্মচারীদের টিকাদান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, সকল সময়ের জন্য স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালন-এসব পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।
শিক্ষার বর্তমান সংকট মোকাবেলায় বিশেষজ্ঞদের নিয়ে জাতীয় পর্যায়ে আলাপ-আলোচনা চালানো প্রয়োজন হয়ে পড়েছে।