আয়া-ধাত্রী-ঝাড়–দার চালাচ্ছে ক্লিনিক!

নিজস্ব প্রতিবেদক »

দীর্ঘদিন ধরে নগরীর বাকলিয়ার বউ বাজার এলাকায় ‘নিরাপদ প্রসব সেন্টার’ নামে একটি ‘ভুয়া’ ক্লিনিক পরিচালিত হয়ে আসছে শুধুমাত্র আয়া, ধাত্রী ও ঝাড়ুদার দিয়ে। সম্প্রতি ক্লিনিকটিতে এক প্রসূতির মৃত্যুর অভিযোগ আসার পর অভিযানে নামে জেলা প্রশাসনের ভ্রাম্যমাণ আদালত। আর তাতে বেরিয়ে আসে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য।

গতকাল বুধবার বিকেলে বউ বাজার এলাকায় এ অভিযান পরিচালনা করেন চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট প্রতীক দত্ত। এ সময় অভিযানে সহযোগিতা করেন ডেপুটি সিভিল সার্জন ডা. মো. ওয়াজেদ চৌধুরী এবং বাকলিয়া থানা পুলিশ।

জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট প্রতীক দত্ত বলেন, ‘অভিযোগের ভিত্তিতে বাকলিয়ার বউবাজারের সুবর্ণ আবাসিক এলাকায় ‘নিরাপদ প্রসব সেন্টার’ নামে একটি অবৈধ ক্লিনিকে অভিযান চালানো হয়েছে। এ সময় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের লাইসেন্স না থাকায় ক্লিনিকটির পরিচালক শাহাদাত হোসেনকে মেডিক্যাল প্র্যাকটিস এবং বেসরকারি ক্লিনিক ও ল্যাবরেটরি (নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাদেশ ১৯৮২ অনুযায়ী ৫০০০ টাকা জরিমানা করা হয়েছে এবং ৬ মাসের বিনাশ্রম কারাদ- দেয়া হয়েছে। এছাড়া সেখানে ধাত্রী ফাহিমা শাহাদাতকেও হাতেনাতে আটক করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় ডাক্তারের উপস্থিতি ছাড়াই নিজে অপারেশন বা নরমাল ডেলিভারি করার জন্য মামলা দায়ের করা হয়েছে।’

জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান বলেন, ‘আমরা শিশুমৃত্যু ও মাতৃমৃত্যু শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে কাজ করছি। কোন জায়গায় এরকম অবৈধ হাসপাতাল বা ক্লিনিক গড়ে উঠতে দেয়া হবে না। যেখানেই তথ্য পাওয়া যাবে সেখানেই অভিযান চালানো হবে।’

স্থানীয়রা জানিয়েছেন ‘নিরাপদ প্রসব সেন্টার’ ক্লিনিকটিতে নরমাল ডেলিভারির প্রলোভন দেখিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে রোগী এনে টাকা হাতিয়ে নিতো ফাহিমা শাহাদাত ও তার স্বামী শাহাদাত হোসেন। ১৩ জানুয়ারি রাতে নরমাল ডেলিভারি করানোর আশায় এ প্রসব সেন্টারে জান্নাতুল ফেরদৌস নিহা নামের এক প্রসূতিকে ভর্তি করানোর পর তার মৃত্যু হলে রোগীর পরিবারের পক্ষ থেকে অভিযোগ উঠে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে অভিযোগকারী জান্নাতুল ফেরদৌস নিহার মা নাজমা বেগম বলেন, ‘১৩ জানুয়ারি দুপুরে তাদের ফেসবুক পেজে আমরা খবর পায়, ‘নিরাপদ প্রসব সেন্টারে’ নরমাল ডেলিভারি করানো হয়। এরপর সেদিন বিকেলে আমি ও আমার মেয়ে চেকআপ করাতে যায়। আমার মেয়েকে কোনো ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করেই ফাহিমা শাহাদাত বলেন, গর্ভের বাচ্চা নিচের দিকে নেমে এসেছে। যদি এখন বাচ্চা ডেলিভারি করানো না হয় তাহলে মা-বাচ্চা বাঁচবে না। কিন্তু আমার মেয়ের ডেলিভারির তারিখ ছিলো ২৫ জানুয়ারি। কিন্তু তার (ফাহিমা শাহাদাতের) কথা শুনে আতঙ্কিত হয়ে আমি ভর্তি করিয়ে দিই। এ সময় তারা সাদা কাগজে আমাদের কাছ থেকে স্বাক্ষর নেন। সেদিন বিকেলে ভর্তি হলেও রাতে অনেক স্যালাইন দিয়ে মেয়ের প্রসব বেদনা তোলা হয়। নিহাকে একটি রুমে ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করে দেওয়া হয়। এরপর রাত ৩টার দিকে বাচ্চার ডেলিভারি করানো হয়। ১৫ মিনিট পর তারা বলে মেয়ে আর বাচ্চার অবস্থা ভালো না, রক্ত লাগবে। বাইরের হাসপাতালে নিয়ে যান। আমাদের অবস্থা খারাপ দেখে ভেতর থেকে একটি ছেলে এগিয়ে এসে অটোরিকশা এনে দেয়। কয়েকজন ধরাধরি করে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে নিয়ে যাই। সেখানে মেয়ে মারা যায়, দু’দিন পর বাচ্চাটিও মারা যায়।’

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, দীর্ঘদিন ধরে ঐ প্রতিষ্ঠানটি কোন ধরনের আইনি নির্দেশনা ও নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে শুধুমাত্র সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চটকদার বিজ্ঞাপন দিয়ে সেবাগ্রহীতাদের ডেকে আনতো এবং চিকিৎসার নামে রোগীদের ভয়ভীতি দেখিয়ে অর্থ হাতিয়ে নিতো। প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনা করতেন আয়া, বুয়া, ধাত্রীসহ ঝাড়–দার দিয়ে।

অভিযোগ সম্পর্কে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ফাহিমা শাহাদাতের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি।

ক্লিনিকটির পরিচালক শাহাদাত হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন ‘আপনার সাথে পরে কথা বলবো। আমার সামনে পুলিশ ও জেলা প্রশাসনের ম্যাজিস্ট্রেট বসে আছে। ঘটনার বিষয়ে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যেভাবে প্রচার করা হচ্ছে আসলে বিষয়টি সেরকম নয়। আমাকে একটু সময় দিন। আমি বিষয়টি জানাবো।’

বাকলিয়ার বাসিন্দা ফয়সাল মাহমুদ জানান, নগরের বিভিন্নস্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে অজ¯্র ভুয়া ক্লিনিক রয়েছে। তাছাড়া বাকলিয়া মিয়াখান নগর, পুলিশ বিট, বউবাজার, বগারবিল, খাজা হোটেল-সংলগ্ন বেশ কিছু ফার্মেসি দোকান-ভাড়া বাসায়ও এধরনের প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়েছে। চিকিৎসক কিংবা সেবার ছিটেফোঁটা না থাকলেও এমন কিছু প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে নামসর্বস্ব এনজিও সংস্থার নামে।

বউবাজার এলাকার স্থানীয় বাসিন্দা মাসুদ আলম বলেন, ‘আজকে একজন অভিযোগ করেছেন বলেই প্রশাসন তদারকি করেছে। এখানে চিকিৎসার নামে বাণিজ্য হয়। এছাড়া অনেক ফার্মেসিতেও নিজেকে ডাক্তার পরিচয় দিয়ে সব ধরনের চিকিৎসা করানো হয়। যা প্রশাসনের তদারকির প্রয়োজন।’