Ι চন্দনাইশের শুক্লাম্বর দীঘির মেলা
নিজস্ব প্রতিনিধি, চন্দনাইশ »
চন্দনাইশ উপজেলার বরমা সুচিয়া বাইনজুরী গ্রামে লাখো নারী-পুরুষের উপস্থিতিতে যথাযথ মর্যাদায় সম্পন্ন হলো হিন্দু সম্প্রদায়ের শুক্লাম্বর দীঘির প্রাচীন মেলা।
গতকাল মঙ্গলবার প্রাচীনতম ঐতিহাসিক এ শুক্লাম্বর দীঘির পূণ্য স্থানে এই উৎসব উদযাপন করা হয়। প্রতিবছর পৌষ সংক্রান্তিতে এই মেলা বসে।
উপজেলার বরমার সনাতন সম্প্রদায়ের তীর্থস্থান শ্রী শ্রী শুক্লাম্বর দীঘি ও তৎসংলগ্ন প্রায় ১২/১৫ একর বিশাল এলাকা ও ২/৩ কিলোমিটার সড়ক জুড়ে এ মেলা বসে। একদিন হলেও আগের দিন বিকেল হতে পুণ্যার্থী, তীর্থযাত্রী, দোকানী ও পূজারীদের আগমন ঘটে। সকালে দেখা যায়, মেলাঙ্গনে উপচেপড়া মানুষের ভিড় জমে। কোথাও তিল ধারনের ঠাঁই থাকেনা।
প্রতিবছরের মতো এবারও পৌষ সংক্রান্তিতে চন্দনাইশের শুক্লাম্বর দীঘির মেলায় ঢল নেমেছিল মানুষের। আগের দিন সোমবার বিকেল থেকেই দিঘিরপাড় মুখরিত হয়ে উঠেছিল পুণ্যার্থীদের পদচারণায়। আত্মশুদ্ধি, পাপমুক্তি ও মনোবাসনা পূরণের জন্য দূর-দূরান্ত থেকে পুণ্যার্থীরা এখানে এসেছেন। মনোবাসনা পূরণের জন্য দীঘিতে আসা পুণ্যার্থীদের অনেকে অশ্বত্থ গাছের নিচে কবুতর উড়িয়ে দেন। আবার কেউ কেউ দীঘিতে তীব্র শীত উপেক্ষা করে স্নান করেন। অনেকে দিঘীর জলে ঢেলেছেন তরল দুধ।
মনের ইচ্ছে পূরণের জন্য অশ্বত্থ গাছের ডালে সুতা বাঁধছিলেন মেলায় আগত নবদম্পতি নীলিমা ধর ও তাঁর স্বামী জয় ধর। অনেকের কাছে এই মেলার কথা শুনেছেন তারা, এবার আসতে পেরে ভীষণ খুশি বলে জানালেন তাঁরা। রাউজান থেকে মিনতি ধর, অজয় চক্রবর্তী ও লোহাগাড়া থেকে মেলায় এসেছেন নায়ারণ বিশ্বাস।
তারা জানান, মেলায় এলে মনোবাসনা পূরণ হয়। এখানে এলে কেউ খালি হাতে ফেরে না। কনকনে শীত উপেক্ষা করে পাপমুক্ত নতুন জীবন লাভের আশায় দীঘির জলে স্নান করতে নেমেছিলেন নানা বয়সের নারী-পুরুষ। সনাতন বা হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের অনুষ্ঠান হলেও এখানে অনেকের সমাবেশ ঘটে। তাদেরও সামাজিক উৎসবে পরিণত হয় বিশেষ করে নারীদের উপস্থিতি ছিল লক্ষ্যণীয়।
মেলায় নাগরদোলাসহ বিভিন্ন ধরনের বেতের তৈরি টুকরি, বড় ঝুড়ি, চালুনি, কুলা, মোড়া, দা-বটি-ছোরা, যাঁতা, মাটির ঘটি-বাটি, শীতের সবজি, মানকচু, শাপলা মাছ, ইলিশ, দেশি পুকুরের মাছ, চটপটি, বিনি ধানের খই, যব ধানের খই, বাতাসা, গস্যার টফি, বাদামের টফি, নিমকি বিস্কুট, নকুল দানা, কদমা, গজা, নারকেলের চিড়া ছাড়াও আরো অনেক খাবার, প্রসাধনী ও বিভিন্ন রকমের দোকান বসে। প্রতি বছরের মত এবারও পৌষ সংক্রান্তির মেলায় বিভিন্ন এলাকা থেকে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন বিভিন্ন মানত নিয়ে এ পীঠমন্দিরে আসে তাদের মনোবাসনা পূরণের অভিপ্রায়ে। তাদের বিশ্বাস এ মেলায় যারা বিভিন্ন মনোবাসনা নিয়ে আসেন তাদের সকল মনোবাসনা পূর্ণ হয়।
শুধু পৌষ সংক্রান্তিতে সারা বছর বিভিন্ন মানস পূরণের লক্ষ্যে দীঘিতে দুধ উৎসর্গ, ছাগল ও কবুতর, ফল-ফলাদি ইত্যাদি দেয় বলে জানা যায়। তবে বছরের অন্যান্য দিনের চেয়ে পৌষ সংক্রান্তির মেলায় শুক্লাম্বর দীঘি মিলন মেলায় ভরে উঠে। দিনব্যাপী চলে উৎসব। সে সাথে প্রত্যেকে স্ব-স্ব ধ্যানে-জ্ঞানে মগ্ন থাকেন পূজা অর্চনায়। পুর্ণ্যার্থীদের ভিড়ে এ দিনটি উৎসবমুখর হয়ে উঠে।
উল্লেখ্য, শুক্লাম্বর ভট্টাচার্য ত্রিপাঠির নামেই এই মেলার নামকরণ। প্রায় ৪০০ বছর আগে ভারতের নদিয়া এলাকায় জন্ম হয় তাঁর। ৪০ বছর বয়সে সনাতন ধর্ম প্রচারের জন্য ভারত থেকে চন্দনাইশের বরমায় আসেন তিনি। বরমায় বেশ কিছু জমি কিনে শিবমন্দির তৈরির মাধ্যমে ধর্মপ্রচার ও জনসেবা শুরু করেন। এই শুক্লাম্বর দিঘীর মেলায় সনাতন ধর্মের লোক ছাড়াও প্রতিবছর বিভিন্ন ধর্মের হাজার হাজার নারী পুরুষ মেলা দেখতে আসেন।
শ্রী শ্রী শুক্লাম্বর দীঘি উন্নয়ন কমিটির সিনিয়র সহ-সভাপতি অরুপ রতন চক্রবর্তী ও সদস্য রুবেল দেব জানান, দক্ষিণ এশিয়ায় সনাতন ধর্মাবলম্বীদের জন্য অন্যতম তীর্থস্থান এই শুক্লাম্বর দিঘির মেলা। শুক্লাম্বর ভট্টাচার্য ত্রিপাঠির নামেই এই মেলার নামকরণ। প্রায় ৪০০ বছর আগে ভারতের নদিয়া এলাকায় জন্ম হয় তাঁর। ৪০ বছর বয়সে সনাতন ধর্ম প্রচারের জন্য ভারত থেকে চন্দনাইশের বরমায় আসেন তিনি। বরমায় বেশ কিছু জমি কিনে শিবমন্দির তৈরির মাধ্যমে ধর্মপ্রচার ও জনসেবা শুরু করেন। তিনি আরও জানান, এই শুক্লাম্বর দিঘীর মেলায় সনাতন ধর্মের লোক ছাড়াও প্রতিবছর হাজার হাজার নারী পুরুষ মেলা দেখতে আসেন। এ বছর অন্যান্য বছরের তুলনায় মেলায় পুণ্যার্থীর ভিড় ছিল বেশি। মেলা উপলক্ষে গতকাল দূর-দূরান্ত থেকে আসেন নানান বয়সের দেশি-বিদেশিসহ হাজার হাজার ভক্ত।
মেলা পরিদর্শন করেছেন উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মো. রাজিব হোসেন, থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) ইমরান আল হোসাইন, চন্দনাইশ পৌরসভার সাবেক মেয়র আলহাজ্ব আইয়ুব কুতুবী, চন্দনাইশ উপজেলা বিএনপির সদস্য সচিব আ. ক. ম মোজাম্মেল হক, চন্দনাইশ উপজেলা এলডিপির সাধারণ সম্পাদক আকতারুল আলম, পৌরসভা এলডিপির সভাপতি এম আইনুল কবির, চট্টগ্রাম মহানগর পূজা উদযাপন পরিষদের সহ-সভাপতি অরূপ রতন চক্রবর্তী, চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা পূজা উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রুবেল দেবসহ বিভিন স্তরের নেতৃবৃন্দ।
মেলা চলাকালীন সময়ে, মেলা কমিটির সভাপতি ও দীঘির উন্নয়ন কমিটির সভাপতি হারাধন দেব, সিনিয়র সহ-সভাপতি অরুপ রতন চক্রবতী, সাধারণ সম্পাদক নিপেন্দু দত্ত জানান, ঐতিহ্যবাহী মেলাটি সুশৃঙ্খলভাবে জেলা প্রশাসন, উপজেলা প্রশাসন ও চন্দনাইশ থানা পুলিশসহ সকলের সহযোগিতায় সম্পন্ন করতে পেরেছেন।