হেফাজতের নতুন আমির নির্বাচন নিয়ে জটিলতা

সালাহ উদ্দিন সায়েম :
হাটহাজারী দারুল উলুম মাদ্রাসার বুধবার অনুষ্ঠিত মজলিশে শূরার বৈঠকে আল্লামা শেখ আহমদকে হেফাজতের নতুন আমির নির্বাচন করে ঘোষণা দিয়েছিলেন আল্লামা শাহ আহমদ শফি। কিন্তু শূরার সদস্যরা আহমদ শফির সেই সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করেন। হেফাজতের আমির নির্বাচনের সাথে হাটহাজারী মাদ্রাসার সম্পর্ক নেই জানিয়ে শূরা কমিটির সদস্যরা এ বিষয়ে হেফাজতের সাংগঠনিক কমিটি সিদ্ধান্ত নেবেন বলে জানিয়ে দেন।
জানা গেছে, মজলিশে শূরার বৈঠকের আগে মাদ্রাসার প্রধান পরিচালক ও হেফাজতে ইসলামের আমির আল্লামা শাহ আহমদ শফি তাঁর স্বাক্ষরিত একটি পত্র তুলে দেন শূরার সদস্য ও ঢাকা ফরিদাবাদ মাদরাসার সহকারী পরিচালক মাওলানা মুফতি নুরুল আমীনকে। এতে লেখা ছিল- ‘আমি (আল্লামা শফি) হাটহাজারী দারুল উলূম মাদ্রাসার মুহাদ্দিস মাওলানা শেখ আমদকে হেফাজতে ইসলামের নতুন আমির নির্বাচন করলাম।’
এই পত্রটি আল্লামা শফি সভার শুরুতে শূরার সদস্যদের পড়ে শুনাতে বলেন মুফতি নুরুল আমীনকে। তিনি সভায় পত্রটি পাঠ করার পর শূরার সদস্যদের অনেকে চমকে যান। শেখ আহমদকে আমির নির্বাচনের ঘোষণা শুনে কয়েকজন শূরা সদস্য একে অপরের সাথে কানাঘুষা করেন। এরপর শূরা সদস্যরা সবাই এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে আহমদ শফিকে বলেন, মাদ্রাসার শূরার বৈঠকে আমরা হেফাজতের আমির নির্বাচন করতে পারি না। মাদ্রাসার সাথে হেফাজতের আমির নির্বাচনের কোনো সম্পর্ক নেই। হেফাজতের সাংগঠনিক কমিটি এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে।
জানতে চাইলে শূরা কমিটির সদস্য ও ঢাকা ফরিদাবাদ মাদরাসার সহকারী পরিচালক মাওলানা মুফতি নুরুল আমীন সুপ্রভাতকে বলেন, ‘আল্লামা শফি সাহেব সভা শুরুর আগে আমার হাতে একটা পত্র তুলে দেন। তাঁর স্বাক্ষরিত এ পত্রে তিনি মাওলানা শেখ আমদকে হেফাজতে ইসলামের নতুন আমির নির্বাচন করার কথা উল্লেখ করেন। কিন্তু শূরার সদস্যরা সবাই আল্লামা শফির এ সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করে তাকে বলেন, আমির নির্বাচন হেফাজতের সাংগঠনিক বিষয়। এটা নিয়ে আমরা সিদ্ধান্ত নিতে পারি না। এটার সাথে মাদ্রাসার সম্পর্ক নেই। এরপর আল্লামা শফি এ নিয়ে তিনি আর কোনো কথা বলেননি।’ বৈঠকে অংশ নেওয়া চট্টগ্রামের এক শূরা সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে সুপ্রভাতকে বলেন, ১১ জন শূরার সদস্য হেফাজতের আমির নির্বাচনের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করার পর আল্লামা শফি চেহারা মলিন করে ফেলেন। তিনি অনেক্ষণ চুপ করে থাকেন। এরপর তিনি এ বিষয়টা নিয়ে আর কোনো কথা বলেননি।
জানা গেছে, বৈঠকে মাদ্রাসার সিনিয়র মুহাদ্দিস আল্লামা শেখ আহমদকে মাদ্রাসার ভারপ্রাপ্ত মুহতামীম (প্রধান পরিচালক) করতে চেয়েছিলেন আহমদ শফি। এছাড়া অপর মুহাদ্দিস আল্লামা আহমদ দিদার কাসেমীকে সহযোগী পরিচালক করতে চান তিনি। কিন্তু শূরার সদস্যরা আহমদ শফির এ প্রস্তাব মানেননি। তারা আহমদ শফিকে মাদ্রাসার রেওয়াজ অনুযায়ী আমৃত্যু প্রধান পরিচালক ও মাওলানা শেখ আহমদকে সহযোগী পরিচালক করার সিদ্ধান্ত দেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে শূরা কমিটির সদস্য মুফতি নুরুল আমীন বলেন, মাওলানা শেখ আহমদকে মাদ্রাসার ভারপ্রাপ্ত মুহতামীম করতে চেয়েছিলেন আল্লামা শফি। আর দিদার কাসেমীকে সহযোগী পরিচালক করতে চান। কিন্তু শূরার সদস্যরা তার এই প্রস্তাব মানেননি। কারণ হাটহাজারী মাদ্রাসায় বিগত সময়ে প্রধান পরিচালক যারা ছিলেন তারা আমৃত্যু পর্যন্ত দায়িত্বে ছিলেন। আমরা এ রেওয়াজ ধরে রাখতে চাই।
হেফাজতের নতুন আমির নির্বাচন কীভাবে হবে, কে হবেন?
২০১০ সালের ১৯ জানুয়ারি গঠিত হয়েছিল কওমি আক্বীদাপন্থি অরাজনৈতিক ইসলামী সংগঠন হেফাজতে ইসলাম। হাটহাজারী দারুল উলুম মাদ্রাসার প্রধান পরিচালক আল্লামা শাহ আহমদ শফি সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা। ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষানীতির বিরোধিতার মধ্য দিয়ে হেফাজতের আত্মপ্রকাশ হলেও সংগঠনটি দেশজুড়ে আলোচনায় আসে ২০১৩ সালে ১৩ দফা দাবিতে আন্দোলনের মধ্য দিয়ে।
কিন্তু হেফাজতে ইসলাম প্রতিষ্ঠার ১০ বছর পরও গঠনতন্ত্র তৈরি করতে পারেনি। আর গঠনতন্ত্র না থাকাতে আল্লামা শফির পর নতুন আমির নির্বাচন নিয়ে সংকট ও জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে।
হেফাজতে ইসলামের নেতাদের অনেকে মনে করেন, হাটহাজারী দারুল উলুম মাদ্রাসার নতুন প্রধান পরিচালক যিনি হবেন তিনিই পদাধিকার বলে হেফাজতের আমির হবেন। কিন্তু গত বুধবার হাটহাজারী দারুল উলুম মাদ্রাসার শূরা কমিটির বৈঠকে আল্লামা শফির নতুন আমির নির্বাচনের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান হওয়ার পর এখন প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, হেফাজতের নতুন আমির কীভাবে নির্বাচিত হবে আর কে হবেন। গঠনতন্ত্র না থাকাতে হেফাজতের সাংগঠনিক কমিটি কীভাবে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন?
হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আজিজুল হক ইসলামাবাদীর কাছে জানতে চাইলে তিনি এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে হেফাজতের একজন কেন্দ্রীয় নেতা সুপ্রভাতকে জানান, হাটহাজারী মাদ্রাসার শূরা কমিটি এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত না নেওয়ায় হেফাজতের নতুন আমির নির্বাচন নিয়ে জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে। কারণ হেফাজতের গঠনতন্ত্র নেই। হেফাজতের সাংগঠনিক কমিটির সভায় এ নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে গেলে মতবিরোধ হবে। দুটি পক্ষের মধ্যে অপ্রীতিকর ঘটনাও ঘটতে পারে।
হেফাজতের মহাসচিব জুনায়েদ বাবুনগরীকে মাদ্রাসার সহযোগী পরিচালক থেকে সরিয়ে দেওয়ার পর সংগঠনটির নেতাকর্মীরা দ্বিধাবিভক্ত হয়ে গেছেন। নেতাকর্মীদের একাংশ আছেন হেফাজতের আমির আহমদ শফির সাথে আর একাংশ বাবুনগরীর পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। হাটহাজারী মাদ্রাসার নবনির্বাচিত সহযোগী পরিচালক আল্লামা শেখ আহমদ আহমদ শফির ঘনিষ্ট হিসেবে পরিচিত।