সাহিত্য-সংস্কৃতির অভীকযাত্রীকে শুভেচ্ছা

আবুল মোমেন :

একালে গুরুর অভাব প্রকট। সমাজ ক্রমে অভিভাবকহীন হয়ে পড়ছে। বয়স বাড়লেও কেউ থামছেন না, অবসরের পরেও অন্য কাজে যোগ দিচ্ছেন। তাতে পাড়া-মহল্লাগুলো অভিভাবকহীন হয়ে পড়ছে। আগে শিক্ষকরা পেশার গুণেই সমাজে অভিভাবকের মর্যাদা পেতেন। তাঁরাও সে মর্যাদা রক্ষা করতেন। কিন্তু এখন দিনে দিনে লেখাপড়া পরীক্ষাকেন্দ্রিক, ডিগ্রিমুখী, সনদনির্ভর হয়ে পড়েছে। ছোটোবেলা থেকে স্কুলের চেয়ে কোচিংকেন্দ্র, পাঠ্যবইয়ের চেয়ে নোটবই, শিক্ষকের চেয়ে টিউটর এবং পড়াশোনার চেয়ে পরীক্ষাকে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে দেখছে নতুন প্রজন্ম। তাতে শিক্ষকের মূল ভূমিকা খাটো হয়ে যাচ্ছে। শিক্ষকরাও বর্তমান সময়ে ডামাডোলে যেন প্রান্তিকজন। এই সময়ে নাট্যকার-কবি অভীক ওসমান তাঁর কয়েকজন শিক্ষককে স্মরণ করে দিয়েছেন গুরুদক্ষিণা। প্রথম গুরু হিসেবে পিতাও সেখানে অন্তর্ভুক্ত, যিনি নিজেও অবশ্য ছিলেন শিক্ষক। তাঁর কালে শিক্ষকের দায় স্কুলেই শেষ হতো না, চলত জীবনব্যাপী, স্কুলের পরে ঘরে ও বাইরে সর্বত্র। তিনি সবার মাস্টার, সর্বক্ষণের। যে কারণে ওসমান তাঁর সম্পর্কে ছোট্ট মন্তব্যে বলেছেনÑ ‘সবারই সবকিছুর অভিভাবক তিনি’ (পৃ. ১০২)।

গুরুদক্ষিণা বইতে পিতার বাইরে লেখক স্মরণ করেছেন তাঁর শিক্ষাজীবনের পাঁচজন শিক্ষককেÑ কলেজজীবনে উচ্চমাধ্যমিক পর্বের রীতা দত্ত, সম্মানপর্বের নাট্যব্যক্তিত্ব মমতাজউদ্দীন আহমদ এবং বিশ্ববিদ্যালয়জীবনের খ্যাতকীর্তি জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, লেখকের ভাষায় ‘বহুমাত্রিক মনিরুজ্জামান’ এবং ‘রূপবান রাজীব হুমায়ুন’। এর বাইরে সমাজবিজ্ঞানী অনুপম সেনের একটি কবিতার বইয়ের আলোচনা লিখে তাঁকে অভিভাবক গুরু হিসেবে অর্ঘ্য দিয়েছেন।

এই ছয়জনের মধ্যে চারজন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন, যার মধ্যে তিনজনের কাছে স্নাতকোত্তর পর্যায়ে ওসমান পাঠ নিয়েছেন। আনিসুজ্জামান তাঁদের বঙ্কিম ও রবীন্দ্রনাথের কবিতা পড়িয়েছেন, মনিরুজ্জামান মাইকেলের মেঘনাদবধ কাব্য এবং রাজীব হুমায়ুন পড়াতেন ভাষাতত্ত্ব। কলেজজীবনে রীতা দত্ত পড়িয়েছেন উচ্চমাধ্যমিকের লজিক বা তর্কশাস্ত্র, মমতাজউদ্দীন নাটক। আর শিক্ষার্থীজীবন শেষ করে ওসমানের ভাষায়, ‘আশির দশক থেকে তাঁর সান্নিধ্য-সাহচর্য যখন পেতে শুরু করেছি, তখন তাঁকে প্রত্যক্ষ করেছি সাহিত্য-সংস্কৃতির আচার্য হিসেবে’ (পৃ. ৬৩)। মন্তব্যটি অনুপম সেন প্রসঙ্গে।

ওসমানের সহজাত টান ছিল নাটক ও কবিতার প্রতি। নাটকের প্রতি টান থাকলে তাই হয় প্রবল, আর তার সাথে যদি মমতাজউদ্দীন আহমেদের মতো আপাদমস্তক নাটকের মানুষকে শিক্ষক হিসেবে পান তবে তাঁর আকর্ষণ একজন তরুণ অভীক ওসমানের কাছে অপ্রতিরোধ্য হবেই। ওসমানের কলমে বাসা থেকে শিক্ষকের কলেজ যাওয়ার বর্ণনাও চমৎকার ফুটে উঠেছেÑ ‘লম্বা খদ্দর বা রাজশাহী সিল্কের পাঞ্জাবি, সাদা পাজামা এবং বিখ্যাত বিদ্যাসাগরী চটি হাতে খাঁটি লেদারের হরিণ কিংবা ব্যাঘ্র চামড়ার বড়ো ব্যাগ নিয়ে তিনি সকাল ১১:০০ টার রৌদ্র সমুজ্জ্বল আকাশ মাথায় নিয়ে বাসা থেকে নামতেন’ (পৃ. ১৭)। তারপরেও এ বর্ণনায় চলে মেধাবী মানুষটির মোহনীয় রূপ ফুটিয়ে তোলার কাজ।

মনিরুজ্জামানকে পেয়েছেন উপকারী বন্ধু হিসেবে। তবে তাঁর মধুসূদন পড়ানোর বর্ণনায় তখনকার সাহিত্যের শিক্ষকের আবেগকে লেখক যথার্থই গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করেছেন Ñ ‘তখন আবেগে পায়ের বুড়ো আঙুলের উপর দাঁড়িয়ে পাঠ করতেনÑ ‘মহাশোকে শোকাকুল কহিলা রাবণ’ ইত্যাদি (পৃ. ৫০)। সত্যিই কবিতা বা সাহিত্যপাঠে আগ্রহী শিক্ষক কোথায় এখন? পাব্লিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো আর কনসাল্টিংয়ে ব্যস্ত, কলেজ শিক্ষকরা টিউশন দিচ্ছেন, স্কুল শিক্ষকরা কোচিং নিয়ে পড়ে আছেন। কে শিক্ষার্থীদের কাছে সাহিত্যের প্রাণ খুলে দেবেন? ওসমান তার তরুণ শিক্ষক রাজীব হুমায়ুনকে পেয়েছেন তাঁর তারুণ্যের রূপ আর বন্ধুত্বের সামর্থ্যসহ। তাতে তাঁর প্রতি তৈরি হয়েছে প্রীতিময় সম্পর্ক। অনুপম সেন আর রীতা দত্তের বহুমুখী প্রতিভা ও আগ্রহও আজ প্রবীণের দলে পড়া সাহিত্য-সংস্কৃতির এই অভীকযাত্রীর সাথে দীর্ঘ দৃঢ় বন্ধন তৈরি করেছে।

ওসমান নিজেকে ভাগ্যবান ভাবতে পারেনÑ জনক থেকে শুরু করে যাত্রাপথে এত গুরুর স্নেহ ও সান্নিধ্যে স্নাত-ধন্য হওয়ার জন্যে।