রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বাড়ছে হত্যাকাণ্ড

আড়াই মাসে ১২ খুন

দীপন বিশ্বাস, কক্সবাজার »

কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফ রোহিঙ্গা ক্যাম্প বর্তমানে সন্ত্রাসীদের আস্তানায় পরিণত হয়েছে। এমন কোন দিন নেই শিবিরগুলোতে খুন, মারামারি, অপহরণ, আধিপত্য বিস্তার, মাদক ও অন্ত্র ব্যবসা, চুরি-ডাকাতি, ধর্ষণ, অগ্নিকা-ের মত সহিংস ঘটনাসহ নানা অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে না। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এই পর্যন্ত এলাকায় আধিপত্য বিস্তারসহ নানা বিষয় নিয়ে খুন হয়েছেন ১২ রোহিঙ্গা। নানা সন্ত্রাসী ঘটনায় আহত হয়েছেন অন্তত শতাধিক রোহিঙ্গা। তার মধ্যে বিশেষ করে সন্ত্রাসীদের টার্গেটে পরিণত হয়েছেন রোহিঙ্গা নেতারা। সাধারণ রোহিঙ্গারা জানিয়েছেন, মাদক ব্যবসা ও আধিপত্য বিস্তার নিয়েই সংঘটিত হয়েছে বেশির ভাগ হত্যাকাণ্ড। ক্যাম্পে একের পর এক হত্যাকা-, মাদক ব্যবসা, আধিপত্য বিস্তারসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড কোনোভাবেই বন্ধ বা রোধ করা যাচ্ছে না।

পরিস্থিতি ক্রমে অবনতির দিকে যাওয়ায় সাধারণ শরণার্থীদের পাশাপাশি নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন আশ্রয়শিবিরে কর্মরত এনজিও সংস্থার কর্মীরা। এছাড়াও ক্যাম্পগুলোর আশপাশের স্থানীয় নাগরিকরাও নিজেদের অনিরাপদ মনে করে দিন দিন উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন।

এদিকে, গতকাল বুধবার সকাল ৭টার দিকে কক্সবাজারের উখিয়ার কুতুপালং-২ ইস্ট রোহিঙ্গা ক্যাম্পের একটি চায়ের দোকানের সামনে সৈয়দ হোসেন (৪০) নামে এক রোহিঙ্গা নেতাকে গুলি করে ও কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তের দল।

রোহিঙ্গা শিবিরের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা ১৪ এপিবিএনের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার অহিদুর রহমান বলেন, বুধবার সকাল ৭টার দিকে কুতুপালং ২ ইস্টের কাছে একটি চায়ের দোকানে কয়েকজন রোহিঙ্গার সঙ্গে নাশতা করছিলেন ক্যাম্প মাঝি সৈয়দ হোসেন। এ সময় ২০-২৫ জনের সন্ত্রাসী গ্রুপ এসে সৈয়দ হোসেনকে দোকান থেকে টেনে-হিঁচড়ে বের করে প্রথমে কোপায় এবং পরে গুলি করে। এ সময় সন্ত্রাসীরা এলোপাতাড়ি গুলি ছোড়ে। খবর পেয়ে এপিবিএন পুলিশের একটি টিম ঘটনাস্থলে পৌঁছালে সন্ত্রাসীরা পালিয়ে যায়। গুলিবিদ্ধ সৈয়দ হোসেনকে পার্শ্ববর্তী এমএসএফ হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। প্রাথমিক তদন্তে এ ঘটনায় আরসার সন্ত্রাসীরা জড়িত বলে জানা গেছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযানে সহযোগিতা করায় আরসা এই হত্যাকা- ঘটাতে পারে বলে পুলিশের ধারণা।

উখিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শেখ মোহাম্মদ আলী জানান, নিহত হেড মাঝি সৈয়দ হোসেনের মরদেহ কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।
এর আগে সোমবার দিবাগত রাত ১টার দিকে উখিয়া ৯ নম্বর ক্যাম্পের সি ব্লকে দুর্বৃত্তের গুলিতে খুন হন নুর হাবিব ওরফে ডাক্তার ওয়াক্কাস (৪০) নামে এক রোহিঙ্গা। নিহত ব্যক্তি ৯ নম্বর ক্যাম্পের নেতা (মাঝি) ছিলেন। এছাড়া তিনি আরসার শীর্ষ কমান্ডার ছিলেন। তাকে মিয়ানমারের আরেক বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন আরকান রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশনের (আরএসও) সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা গুলি করে হত্যা করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। পুলিশ বলছে, আরকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির (আরসা) সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা সৈয়দ হোসেনকে খুন করেছে।

১৪ এপিবিএন পুলিশের অধিনায়ক ও অতিরিক্ত উপ-মহাপরিদর্শক (অতিরিক্ত ডিআইজি) ছৈয়দ হারুনুর রশীদ বলেন, ঘটনায় জড়িতদের গ্রেফতারে পুলিশ অভিযান চালাচ্ছে।
এছাড়া শুক্রবার (৩ মার্চ) দুপুর ১২টার দিকে উখিয়ার ১৯ নম্বর ক্যাম্পের ‘এ’ ব্লকে মোহাম্মদ রফিক (৪০) নামে এক যুবককে গুলি করে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। নিহত যুবক ওই ক্যাম্পের দিল মোহাম্মদের ছেলে।

বিষয়টি নিশ্চিত করে উখিয়া থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শেখ মোহাম্মদ আলী জানান, জুমার নামাজের আগে ৮ থেকে ১০ জনের একটি মুখোশধারী দল হঠাৎ রোহিঙ্গা যুবক রফিককে গুলি করে পালিয়ে যায়। তাকে উদ্ধার করে বেসরকারি সংস্থা এমএসএফ পরিচালিত হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। আমরা হত্যাকারীদের গ্রেফতারে অভিযান চালিয়ে যাচ্ছি।

সূত্র জানায়, রোহিঙ্গা দুর্বৃত্তরা সকাল-সন্ধ্যা ও রাতে ক্যাম্পে এসব হত্যাকা- ও অপরাধ সংঘটিত করছে। গত আড়াই মাসেরও কম সময়ে ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের ৬ নেতা, নারীসহ খুন হয়েছে ১২ জন। চলতি মাসেই একদিনের ব্যবধানে দুই রোহিঙ্গা নেতা (মাঝি) কে খুন করা হয়। এর মধ্যে ফেব্রুয়ারিতে ক্যাম্পে গুলিতে ও কুপিয়ে নারীসহ ৬ জনকে হত্যা করা হয়েছে। এছাড়া পৃথক ঘটনায় দুই শিশুসহ গুলিবিদ্ধ হয়েছেন ৭ জন। এছাড়াও নানা অপরাধে শতাধিক রোহিঙ্গা আহত হয়েছেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দেওয়া তথ্য মতে, গত দুই মাসসহ চলতি মাসের এ পর্যন্ত বিভিন্ন অপরাধে দুই জঙ্গি, কথিত আরসা সদস্যসহ ৩৭ জনকে আটক করা হয়েছে।

রোহিঙ্গা ক্যাম্পের একাধিক সূত্র জানায়, এলাকায় আধিপত্য বিস্তার, মাদক ব্যবসা, চোরাচালানসহ নিজেদের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে হত্যাকা-ের ঘটনা দিন দিন বাড়ছে। এদিকে ক্যাম্পে একের পর এক হত্যাকা-ে মারাত্মকভাবে শঙ্কিত হয়ে পড়েছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, সুশীল সমাজ ও স্থানীয়রা। তাদের দাবি, দ্রুত ক্যাম্পের অপরাধ কর্মকান্ড নিয়ন্ত্রণে আনতে সাঁড়াশি অভিযান পরিচালনা করা দরকার।

উখিয়া উপজেলার কুতুপালং এলাকা স্থানীয় ইউপি সদস্য হেলাল উদ্দিন জানান, সম্প্রতি ক্যাম্পের নানা পরিস্থিতি নিয়ে স্থানীয় জনগণ নিরাপত্তাহীনতায় রয়েছেন। ক্যাম্পভিত্তিক মাঝি (নেতা), সাব-মাঝি, স্বেচ্ছাসেবকদের খুন করে সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা তাদের অবস্থান জানান দিচ্ছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে হত্যাকা- দিন দিন বাড়ছে।

উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সদর রাজাপালং ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর কবির চৌধুরী বলেন, ক্যাম্পের মধ্যে বিভিন্ন সন্ত্রাসী গ্রুপ নিজেদের আধিপত্য বিস্তারের জন্য সবসময় সক্রিয়। সন্ত্রাসীদের ভারি অস্ত্রের ভয়ে অনেকেই প্রতিবাদ করার সাহস পান না। এছাড়া ক্যাম্পে একের পর এক খুনের ঘটনার জন্ম দিচ্ছে সন্ত্রাসীরা। তিনি আশংকা করে বলেন, ক্যাম্পের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে ভবিষ্যতে ভয়াবহ রূপ নিতে পারে।

এলাকার একাধিক সূত্র জানায়, রোহিঙ্গাদের অপরাধ দমনে ক্যাম্পে সাঁড়াশি অভিযান পরিচালনা করা এবং তাদের হাতে থাকা ভারী অস্ত্রগুলো যাতে শীঘ্রই উদ্ধার করা হয় তার জন্য তড়িৎ ব্যবস্থা নেয়া জরুরি।