রোগীদের শেষ ভরসা চমেক হাসপাতাল

কর্মচারী সংকটের কারণে স্বজনেরাই রোগীকে গাড়ি থেকে ট্রলিতে তুলছেন -সুপ্রভাত

সরেজমিন :
রুমন ভট্টাচার্য :
বুধবার বেলা ১২টা ৫০ মিনিট। চমেক হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে একটি অ্যাম্বুলেন্সের ভিতরে নবজাতক কোলে নিয়ে কান্না করছেন মা। তাকে সান্ত¦না দেওয়ার চেষ্টা করছেন এক স্বজন। বাবা ছুটে গেছেন টিকিট কাউন্টারে।
সীতাকু-ের বড় কুমিরা থেকে আসা নবজাতককের মা মিলি আকতার জানান, সন্তানের বয়স মাত্র একদিন। হঠাৎ করে শ্বাসকষ্ট শুরু হলে সকালে নিয়ে যায় সীতাকু- মডেল হাসপাতালে। কিন্তু সেখানে ভর্তি নেয়নি। তাই এখানে আসলাম।
এর আগে বেলা ১২টা ২০ মিনিটে ফটিকছড়ি নাজিরহাট থেকে জ্বর, সর্দি, কাশি উপসর্গ নিয়ে হাসপাতালে আসেন আমেনা বেগম (৫৫)।
আমেনা বেগমকে নিয়ে আসা টেক্সিচালক মোহাম্মদ ইসমাইল জানান, প্রথমে চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতালে নিয়ে গেছি। কিন্তু ওখানে ভর্তি হতে পারেনি। পরে এখানে নিয়ে আসি।
দুপুর ১টা ২০ মিনিটে নগরীর শুলকবহর এলাকা থেকে স্ত্রী শিখা চৌধুরীকে নিয়ে আসেন স্বামী রানা চৌধুরী।
রানা চৌধুরী জানান, প্রেসারের সমস্যা কারণে প্রথমে নগরীর পার্কভিউ হাসপাতালে নিয়ে যায়। কিন্তু সেখানে ডাক্তার নেই বলে জানায়।
হাসপাতাল ঘুরে চিকিৎসা না পাওয়ার এরকম ঘটনা ও চিত্র এখন প্রায় প্রতিদিনের। শুধু এরা তিনজন নয়, আনোয়ারা থেকে পেট ব্যথা নিয়ে স্ত্রী উম্মে হাবিবাকে সাথে নিয়ে আসেন স্বামী সুমন। ফটিকছড়ি থেকে গর্ভবতী স্ত্রী ববি আকতারকে নিয়ে আসেন শাশুড়ি হোসেনে আরা। ফটিকছড়ি উপজেলা হাসপাতাল থেকে আসেন তৈয়বা খাতুন। আগ্রাবাদ মতিয়ারপুলে বিল্ডিংয়ে রংয়ের কাজ করার সময় বিদ্যুৎপৃষ্ঠ কামরুলকে নিয়ে আসেন সহকর্মী কামরুল। নগরীর পাহাড়তলী থেকে কোভিড উপসর্গ থাকা আবুল বশরকে নিয়ে হাসপাতালে নিয়ে আসেন শালা আবু তৈয়ব।
আবু তৈয়ব বলেন, ‘অন্যকোনো হাসপাতালে না গিযে দুলাভাইকে নিয়ে সরাসরি এখানে আনলাম। হয়রানি ও ঝামেলা এড়াতে গরিবের সরকারি হাসপাতালই এখন আমাদের শেষ ভরসা।’
বুধবার (১ জুলাই) সরেজমিন চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে জরুরি বিভাগে গিয়ে পাওয়া যায় এমন তথ্য ও চিত্র ।
চমেক হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, এসব চিত্র এখন প্রতিদিনের। দিন দিন বাড়ছে রোগীর সংখ্যা ও চাপ। তবুও সাধ্যের মধ্যে সর্বোচ্চ চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।
হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, বুধবার সকাল ৮টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত ৯৯ জন রোগী কোভিড ও ননকোভিডসহ বিভিন্ন ওয়ার্ডে ভর্তি হয়েছে। এছাড়া আউটডোরের টিকিট নিয়েছেন ৯৮ জন।
সরেজমিন বেলা ১২টায় দেখা যায়, কিছুক্ষণ পর পর জরুরি বিভাগের সামনে এসে ভিড় করছে অ্যাম্বুলেন্স, ট্যাক্সি, কার ও মাইক্রোসহ বিভিন্ন যানবাহন। মাত্র তিন মিনিটের ব্যবধানে আসল তিনটি অ্যাম্বুলেন্স। টিকিট কাউন্টারের সামনে রোগীদের লম্বা লাইন। ট্রলি ও হুইল চেয়ার ও কর্মচারী সংকটে স্বজনরা রোগীদের নিজেরাই গাড়ি থেকে নামানো ও আনা-নেওয়া করছে। অনেকে রোগীকে পায়ে হাঁটিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
হাসপাতালের ট্রলিচালক সুমন জানান, প্রতিদিন যে হারে রোগী আসে সে অনুযায়ী ট্রলি ও হুইল চেয়ার নেই। একজন রোগীকে ওয়ার্ডে ভর্তি করিয়ে দিয়ে আসতে প্রায় ২০-২৫ মিনিট সময় লাগে। ফলে অনেক রোগীকে অপেক্ষায় বসে থাকতে হয়।
এসব বিষয়ে জানতে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের উপপরিচালক ডা. মো. আফতাবুল ইসলাম সুপ্রভাতকে বলেন, ‘প্রতিদিন রোগীর চাপ বাড়ছে। তবুও সাধ্যের মধ্যে সর্বোচ্চ সেবা দেওয়ার চেষ্টা করছি। বাইরে চিকিৎসাসেবা না পেয়ে অনেকেই এখানেই ছুটে আসছে। বিভিন্ন জেলা ও উপজেলা থেকেও রোগীদের এখানে পাঠানো হচ্ছে। আমরা কোনো রোগীকেই ফেরত দিতে পারি না। কারন এটি সরকারি হাসপাতাল। এখানে চিকিৎসাসেবা পেতে অনেক রোগীই দূর-দূরান্ত থেকে আসে অনেক কষ্ট করে। সেটা আমরা অনুবাধন করি।’
ট্রলি ও হুইল চেয়ার ও কর্মচারী সংকটের কথা স্বীকার করে উপপরিচালক ডা. মো. আফতাবুল ইসলাম বলেন, ‘এসব কিনতে টাকা বরাদ্দ ছিল। কিন্তু আগে যারা দায়িত্বে ছিলেন তারা অন্য খাতে এই টাকা খরচ করে ফেলেছেন। এই কারণে কিনতে পারিনি। তবে আমরা শীঘ্রই কিনব।’ চলতি মাসেই আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে কর্মচারী নিয়োগের চুক্তি করা হচ্ছে এবং ইউএনডিপি থেকে কিছু পরিচ্ছন্ন কর্মী দেওয়া হবে বলে তিনি জানান।
উল্লেখ্য, ১৯৫৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হলেও চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সেবা কার্যক্রম চালু হয় ১৯৬০ সালে। ১২০ শয্যা নিয়ে যাত্রা শুরু হয় এ হাসপাতালের। পরবর্তীতে ১৯৬৯ সালে ৫০০ শয্যা, ১৯৯৬ সালে ৭৫০ শয্যা, ২০০১ সালে ১ হাজার ১০ শয্যা এবং সর্বশেষ ২০১৩ সালে এ হাসপাতালকে ১ হাজার ৩শ ১৩ শয্যায় উন্নীত করা হয়। তবে শয্যা বাড়লেও বাড়েনি জনবল।