বিশ্বে বাংলা ভাষার মর্যাদা

মো. আবদুর রহিম »

ইউনেস্কো ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। সেই থেকে সারা বিশে^র সকল নাগরিকের সত্য ও ন্যায়ের অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রেরণার উৎস আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। বিশে^র ২৬ কোটির বেশি মানুষের ভাষা বাংলাকে জাতিসংঘের অন্যতম সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দানের জন্য বাংলাদেশ জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে দাবি উত্থাপন করেছে। ভাষার জন্য প্রাণ দিয়ে বাঙালি তরুণরা বিশে^ সৃষ্টি করেছে এক অনন্য উদাহরণ। পরিসংখ্যান মতে বিশ^জুড়ে মোট বাংলাভাষীর সংখ্যা ২৬ কোটি ৫০ লাখের কিছু বেশি। তবে ভাষা গবেষকরা বলছেন, বিশে^ ২৮ কোটি মানুষ বাংলায় কথা বলেন। ক্রমিক বিচারে সারা বিশে^র ভাষাগুলোর মধ্যে বাংলার অবস্থান পঞ্চম।
শুধু বাংলাদেশ নয় গোটা বিশ^ই একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন করেছে। বিশ^ব্যাপী ছড়িয়ে থাকা সাধারণ মানুষের মাধ্যমে বাংলা ভাষা পাচ্ছে বৈশি^ক ব্যাপ্তি। ব্যবসায়িক প্রয়োজন, উচ্চ শিক্ষা কিংবা চাকুরি সহ বুদ্ধিভিত্তিক কর্মকা-ে নিযুক্ত প্রবাসী বাংলাভাষীদের সংখ্যাও ক্রমে বাড়ছে। আর তাদের অনেকেই দ্বিতীয় প্রজন্মের কাছে বাংলা ভাষাকে তুলে ধরতে প্রবাসে প্রতিষ্ঠা করেছেন বাংলা ভাষাভাষি বিভিন্ন বিদ্যালয়। ইউরোপ, আমেরিকা, জাপান ও কানাডা থেকে বাংলা ভাষার বর্তমানে একাধিক সংবাদপত্র প্রকাশিত হয়, টিভি-বেতার চ্যানেলে বাংলা ভাষায় অনুষ্ঠান সম্প্রচারিত হয়। এসব বাংলা ভাষা ও সাংস্কৃতিক ভিত্তিক অনুষ্ঠানগুলোর উদ্দেশ্য হচ্ছে বাংলা ভাষাকে বিদেশের মাটিতে নতুন ভাবে তুলে ধরা।
বিশে^ বিভিন্ন দেশ থেকে অনলাইনে বাংলা পত্রিকা পাওয়া যাচ্ছে। বিশে^র প্রায় ১০টি দেশের রাষ্ট্রীয় বেতারে বাংলা ভাষার আলাদা চ্যানেল রয়েছে। এ ছাড়াও আরো ১০টি রেডিওতে বাংলা ভাষার আলাদা অনুষ্ঠান সম্প্রচার করা হয়। যুক্তরাজ্য থেকে প্রায় এক ডজন বাংলা সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ হয়। বেতার বাংলা নামে সেখানে একটি রেডিও স্টেশন রয়েছে।
স্বাধীনতার পর থেকে গত আশির দশক পর্যন্ত বাংলা চর্চার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে সোভিয়েত ইউনিয়ন বা রাশিয়া। মস্কোর প্রগতি প্রকাশনের উদ্যোগে রুশভাষার ধ্রুপদি বইগুলোর বাংলা অনুবাদ প্রকাশিত হতো এবং নামমাত্র মূল্যে সেগুলো বিক্রি হতো। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যাবার পর এ উদ্যোগ থেমে গেছে। তবে বিশে^র দেশে দেশে বাংলা ভাষা শিক্ষাদান সহ গবেষণার পরিধি বাড়ছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, জীবনানন্দ দাশ, লালন সাই, চর্যাপদ এবং মধ্যযুগীয় সাহিত্য নিয়ে গবেষণা করছে বিদেশি ভাষা গবেষকরা। জাপান, চীন, কোরিয়া, সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়াও বাংলা ভাষা নিয়ে গবেষণা হচ্ছে। তবে এ ক্ষেত্রে জাপান ও গণচীন এগিয়ে আছে। জাপানে প্রায় ৭০ বছর আগে কাজুয়ো আজুমা রবীন্দ্রপ্রেম থেকে বাংলা ভাষার চর্চা শুরু করেন। গণচীনের রেডিও পিকিং থেকে দীর্ঘদিন বাংলায় অনুষ্ঠান সম্প্রচার করা হচ্ছে। বেশ কিছু বাংলা অনুবাদ কর্মও প্রকাশিত হয়েছে গণচীন থেকে। বেশ কিছুদিন থেকে সেখানে বাংলা ভাষা নিয়ে ব্যাপক কাজ হচ্ছে। বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথ নিয়ে বাংলা থেকে চীনা ভাষায় অনুবাদের কাজ চলছে। তারা বাংলা ভাষা নিয়ে রীতিমতো প্রকল্প প্রণয়ন করে কাজ করছে।
বাংলাদেশের সাথে গণচীনের ব্যবসায়িক সম্পর্ক বৃদ্ধির সাথে সাথে চীনাদের মাঝে বাংলা ভাষা শেখার ব্যাপারে আগ্রহ বেড়েছে। সেখানে একাধিক বিশ^বিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা নিয়ে গবেষণা শুরু হয়েছে। সাথে বাংলা ভাষার কোর্সও চালু হয়েছে বেশ কয়েকটি বিশ^বিদ্যালয়ে। সম্প্রতি বেইজিং বিশ^বিদ্যালয় ও রেইসিং ইউনিভার্সিটি অফ ফরেন স্টাডিজ নামে বিশ^বিদ্যালয় দু’টিতে বাংলা ভাষা কোর্স চালু হয়েছে। এমনকি সেখানে বাংলা বিষয়ে অনার্স কোর্স চালু রয়েছে। সেখানে চীনা ছাত্র-ছাত্রীরা অধ্যায়ন করছেন। আর বাংলা শিক্ষা দান করছেন ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটের প্রাক্তন বাংলা ভাষার চীনা শিক্ষার্থীরা। ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, বেলজিয়াম, পোল্যান্ড ও চেক প্রজাতন্ত্রে বাংলা ভাষার চর্চা ও গবেষণা চলছে। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন বিদ্যালয় ও বিশ^বিদ্যালয় থেকে শুরু করে বিশে^র নানা দেশে বাংলা শেখার পর্যাপ্ত সুযোগ ও চাহিদা রয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নতির সাথে সাথে বাংলার চাহিদা বাড়ছে।
অষ্ট্রেলিয়ার শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে সে দেশের বিদ্যালয়গুলোর যে সব এশীয় ভাষা শেখার অনুমতি দিয়েছে এবং যে সব ভাষা শেখার গুরুত্ব দিয়েছে তার মধ্যে বাংলার অবস্থান তৃতীয়। আর বাংলাদেশের সীমানা থেকে বহুদূরে অনেকের কাছেই অপরিচিত আফ্রিকার একটি দেশের প্রধান দাপ্তরিক ভাষা বাংলা। বিশে^র বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষের নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি রক্ষায় অমর একুশের চেতনা অনুপ্রেরণার অবিরাম উৎস। এ চেতনাকে ধারণ করে পৃথিবীর নানা ভাষাভাষী মানুষের সাথে নিবিড় যোগসূত্র স্থাপিত হচ্ছে। লুপ্তপ্রায় ভাষাগুলো আপন মহিমায় নিজ নিজ সম্প্রদায়ের মধ্যে সুপ্ত হোক, গড়ে উঠুক নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতির বর্ণাঢ্য বিশ^।
লেখক : প্রাবন্ধিক