বাংলাদেশ ক্রিকেট দল ও প্রাসঙ্গিক

ড. আনোয়ারা আলম»

অবশেষে বিশ্বকাপ ঘিরে বাংলাদেশের সব আশা একেবারে ধুলোয় মিশে গেল। ভেবেছিলাম কিছুটা মানসম্মান নিয়ে ফিরবে দল। কিন্তু সব যেন মরীচিকা।
এ দেশে ক্রিকেট খেলার সূচনা করেছিল ব্রিটিশরা। আর ক্রিকেট খেলা কিভাবে রাজনীতিতে যুক্ত হয়ে যায় তার একটা উদাহরণ ভারতের আমির খানের সিনেমা ‘লগন’। তবে বাংলাদেশে অতীতে খুব বেশি জনপ্রিয় ছিল ফুটবল খেলা। এ নিয়ে ভানু বন্দোপাধ্যায়ের একটা মজার ক্যাসেট ছিল। তবে স্বাধীনতা পূর্ব পাকিস্তানে ক্রিকেট খেলা নিয়ে ভারত পাকিস্তান খেলা সম্পর্কে নানাধরণের মিথ প্রচলিত ছিল। আমরা মেয়েরাও সেই কাপ্তাই শহরে ফুটবল, হাডুডু বা গোল্লাছুট খেলার সাথে ক্রিকেট ও খেলতাম। মনে মনে বিপক্ষ দল থাকতো ভারত! হায়! তখন কি জানতাম দাবার ছক কিভাবে উল্টে যায়!
ছেলেদের মধ্যেও আমাদের বয়সী অনেকে স্বপ্ন দেখতেন আন্তর্জাতিক মানের ক্রিকেট প্লেয়ার হওয়ার। যেমন শহীদ জুয়েল। ক্র্যাক প্লাটুনের একজন বীর গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা।
তিনি ঢাকা আজাদ বয়েস ক্লাবের সদস্য ছিলেন। এই ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সংসার বিবাগী মানুষ মুশতাক আহমেদ যাকে বলা হতো ক্রিকেট সন্ন্যাসী। যারা ক্রিকেট খেলতেন, তাঁদের সবার অতি প্রিয় মানুষ।
শহীদ জুয়েল স্বপ্ন দেখতেন তিনি দেশের হয়ে বাইরের দেশের সাথে ক্রিকেট খেলবেন। যদিও চরম বৈষম্য ছিল এই অঙ্গনেও। চৌকস খেলোয়াড় ও ছিলেন। কিন্তু সব স্বপ্ন ধূলিস্যাৎ হয়ে গেল সত্তরের নির্বাচন পরবর্তী সময়ে। উত্তাল একাত্তরের ২৬ ফেব্রুয়ারি। ঢাকা টেস্টে ক্রিকেটার রকিবুল হাসান ব্যাটে জয় বাংলা লিখে ক্রিকেট ময়দানে প্রতিবাদের ঝড় তুললেন। জুয়েলও সেই মাঠে।
এলো ২৫ মার্চের কালো রাত। শহীদ হলেন সব খেলোয়াড়ের অতি প্রিয় মুশতাক ভাই। প্রতিজ্ঞা করলেন-জুয়েল এর প্রতিশোধ নেবেন। যোগ দিলেন মুক্তিযুদ্ধে। স্বপ্ন ছিল স্বাধীন দেশের একজন সেরা খেলোয়াড় হবেন। অতঃপর তিনি ২ নাম্বার সেক্টরের ক্র্যাক প্লাটুনের একজন বীর রবিনহুড। সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন অপারেশনের আগে রেকি করতে গিয়ে পাকিদের গুলিতে ডান হাতের তিন আঙুলে আঘাত পান। চিকিৎসারত ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করলেন -‘আমি ক্রিকেট খেলতে পারবোতো?’
২৯ আগস্ট ধরা পড়লেন শহীদ আজাদের মায়ের বাসায় যা ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের একটা সেল্টার হোম।
হায়! পাকিরা তাঁর আঘাতপ্রাপ্ত ব্যান্ডেজ লাগানো আঙুল দেখেই প্রমাণ পেয়ে আঙুল তিনটি সজোরে মুচড়ে কথা বের করার চেষ্টা করেছিল। তিনি শহীদ হলেন আরও অনেক বীর যোদ্ধাদের সাথে। যার স্বপ্ন ছিল – স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে ক্রিকেট খেলবেন।
স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম দিকে ফুটবল ছিল অতি জনপ্রিয় খেলা। ক্রিকেট খেলার গতি ছিল মন্থর। ধীরে ধীরে কিছু নিবেদিত প্রাণ ক্রিকেট খেলার অনুরাগীদের অক্লান্ত পরিশ্রমে নব্বই এর দশকে আমাদের বিশ্বকাপে খেলার স্বীকৃতি। আহা! কি আনন্দ তখন আকাশে বাতাসে।
একুশ শতকে এসে সুনাম ও অনেক। মেয়েরা ও লড়ছে দুর্দান্ত ভাবে।
কিন্তু সমস্যা অন্যখানে। ক্রিকেট খেলাকে ঘিরে নোংরা রাজনীতি। বোর্ডে যাঁরা আছেন যেন বাপ দাদার রাজ্য। খেলোয়াড় বা কোচ নির্বাচন নিয়ে নানাধরণের ষড়যন্ত্র। যার নেতিবাচক প্রভাবে কোন দলই গুছিয়ে উঠে আসতে পারছে না। সামনে এগুনোর প্রত্যাশা নেই, চ্যালেঞ্জ নেবার লক্ষ্যমাত্রা নেই, আছে দলাদলি।
একজন ভালো খেলোয়াড় আশরাফুলকে হারানোর পেছনেও ষড়যন্ত্র ছিল। আরও অনেক প্রতিভাবান খেলোয়াড়েরও একই দশা। এরই মাঝে আশাজাগানিয়া আলো নিয়ে এলো সাকিব আল হাসান এবং তামিম ইকবালের মতো দারুণ খেলোয়াড়েরা।
একটা সময়ে বাংলাদেশের ক্রিকেট মানে সাকিব আল হাসান। তাঁর অবদান কি ভুলে যাওয়ার মতো? কোনভাবেই না।
এবারের বিশ্বকাপে খেলতে যাওয়ার আগেই শুরু হলো খেলার নোংরা রাজনীতি। তামিমকে বাদ! হতভম্ব সবাই। মাহমুদউল্লাহ কে নিয়েও নানা কারসাজি। তবে হ্যাঁ। আমার ব্যক্তি মতামত খেলার আগে তামিমের ভিডিও বার্তা কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এতে ছেলেদের মনোবল ভেঙেছে। দলের টিমস্পিরিট কমেছে। কারণ খেলায় মানসিক শক্তি এক বিশাল ব্যাপার।
আর সাকিবের দশা হচ্ছে নবাব সিরাজদ্দৌলার মতো। যিনি পরাজিত হওয়ার পরে যখন গ্রেফতার হলেন তখন ব্রিটিশরা চক্রান্ত করে সাধারণ মানুষকে ক্ষেপিয়ে দিয়েছিল।
সিরাজদ্দৌলাকে জনতার জুতো ছুঁড়া, গালি দেওয়া ইত্যাদি ইত্যাদি।
যে দলকে একটা সময় সর্বস্ব দিয়ে হিরো হয়েছিল সে এখন সব হারিয়ে জিরো। আমি ভেবে পাইনা ওর মতো একজন ক্ল্যাসিক খেলোয়াড়ের এই দশা বা খেলোয়াড় সাজানোর পেছনে কারণটা কি!!!!
আমরা বড়ো দুর্ভাগা জনতা। আমরা অবলীলায় জাতির পিতাকে হত্যা করতে পারি। আমরা নিষিদ্ধ জামাতের গর্জন শুনি। আমরা পুলিশকে সাপের মতো মারতে মারতে কুপিয়ে হত্যা করতে পারি।
আমরা রাষ্ট্রের সম্পদকে অবলীলায় পুড়িয়ে ফেলতে পারি। কেবলই মনে হচ্ছে ঘনিয়ে আসছে এক ঘনঘোর অন্ধকার।