বাংলাদেশের আশা নিরাশার বিশ্বকাপ

আজাদ মজুমদার »

এবারের ক্রিকেট বিশ্বকাপটা বাংলাদেশের খুব ভালও যেতে পারে, খারাপও যেতে পারে। খারাপ কেন যেতে পারে সেটা মোটামুটি সবারই জানা। ভাল যাওয়ার সম্ভাব্য কারণগুলো তাই শুরুতে জানা যাক। আগে থেকেই ধারণা করা গিয়েছিল, এই বিশ্বকাপটা হবে মোটামুটি তক্তা উইকেটে। প্রথম কয়েকটি প্রস্তুতি ম্যাচ দেখে সেই ধারণা সবার মনে আরো পোক্ত হয়েছে। সাথে এই ধারণাটাও সবার মনে ফিরে এসেছে, উইকেটে তেমন কোনো বিপদ না থাকলে বাংলাদেশের ব্যাটারদের জন্য কাজটা মোটামুটি সহজ। সহজাত প্রতিভা বাংলাদেশ দলের অনেকেরই আছে। যেটা নেই তা হলো বিরুদ্ধ পরিবেশে টিকে থাকার উপযুক্ত টেকনিক। উইকেটে সামান্য স্পিন ধরলে কিংবা বাড়তি একটু মুভমেন্ট থাকলে বাংলাদেশ দলের অনেকেই লেজে গোবরে করে ফেলেন। এবার যেহেতু সেই আশঙ্কা কম নিজেদের সহজাত দক্ষতায় তারা উৎরে যেতেও পারে। বাংলাদেশের ভাল কিছু আশা করার সম্ভাব্য দ্বিতীয় কারণটি অবশ্যই সাকিব আল হাসান। মন থেকে চাইলে এখনো সাকিব বিশ্বের যে কোনো প্রতিপক্ষের জন্যই বিপজ্জনক। এবারের বিশ্বকাপে তিনি এটা আন্তরিক ভাবেই চাইবেন বলে সবার বিশ্বাস। সাকিব হয়তো আগেও তা-ই করেছেন, কিন্তু নিজেকে উজাড় করে দেওয়ার প্রাণান্তকর যে চেষ্টা সেটা সব ম্যাচেই যে ছিল এমনটা হয়তো তার পাঁড় ভক্তও দাবি করবেন না। এবার তার অন্যথা করার সুযোগ কম। সেটা তিনি কেবল অধিনায়ক বলেই নয়। বাংলাদেশের অধিনায়ক তিনি আগেও ছিলেন। কখনো আগ্রহ ভরে এই দায়িত্ব পালন করেছেন। কখনো বা সেটা তার উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। তবে পরিস্থিতি যেমনই হোক আগে কখনো নিজের উপর চাপ টেনে নেননি তিনি যা এবার করেছেন তামিম ইকবাল ইস্যুতে গরম গরম বক্তব্য দিয়ে। সাকিব স্পষ্টত প্রমাণ করেছেন যে দলটা নিয়ে তিনি ভারত গিয়েছেন এতে তিনিই সর্বেসর্বা। প্রত্যেকটা সদস্য এখানে দলভুক্ত হয়েছে তার ইচ্ছায়। দল নিয়ে তার অভিযোগ করার কিছু নেই। নিজেরও গা ছাড়া ভাব দেওয়ারও কোনো সুযোগ নেই। বিশ্বকাপে বাংলাদেশ দলের ফলাফল যদি বিপর্যয়কর কিছু হয় এর দায়ভার যে অনেকটাই তার উপর এসে পড়বে সেটা না বোঝার মতো কম বুদ্ধিমান আর যে-ই হোন সাকিব আল হাসান অন্তত নন। এ ধরনের সম্ভাব্য বিপর্যয় এড়াতে সাকিব তাই প্রাণপণ লড়াই করবেন বলেই আশা করা যায়। সাকিব এই আশা পূরণ করলে, অর্থাৎ তার সব কিছু দিয়ে লড়লে বাংলাদেশের কাজটা যে অনেক সহজ হয়ে যায় সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। আরো কিছু বিষয় আছে যা বাংলাদেশের অনুকূলেই থাকবে। গত দু’একবারের তুলনায় এই বিশ্বকাপে বাংলাদেশের কাছে প্রত্যাশা কম। আর প্রত্যাশা যখন কম থাকে বাংলাদেশ বরাবরই ভাল করে। পরিস্থিতি যখন এলোমেলো থাকে তখন ঘুরে দাঁড়ানোর দৃষ্টান্ত বাংলাদেশ অতীতেও একাধিকবার স্থাপন করেছে। দুটো উদাহরণ স্মৃতিতে ভাসছে। ২০০৮ সালে আইসিএল কান্ডে বাংলাদেশের ক্রিকেট যখন টালমাটাল, সে সময় দ্বিপাক্ষিক সিরিজ খেলতে নিউজিল্যান্ড দল আসে বাংলাদেশে। নিয়মিত একাদশের প্রায় অর্ধেক খেলোয়াড় আইসিএল চলে গেলেও প্রথম ম্যাচটাই জিতে যায় বাংলাদেশ। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে যে কোনো ফরম্যাটে সেটাই ছিল বাংলাদেশের প্রথম জয়। দ্বিতীয় উদাহরণটি আরো সাম্প্রতিক। ২০১৯ সালে বাংলাদেশ দলের ভারত সফরের আগের রাতে জুয়াড়ির সাথে সংস্রবের দায়ে নিষিদ্ধ হন সাকিব। সেই সফরেও প্রথম ম্যাচটি জিতে যায় ভারত। ভারতের বিরুদ্ধে ভারতের মাটিতে এখন পর্যন্ত ওটাই বাংলাদেশের একমাত্র জয়। তবে উপরের এই দুটো ঘটনার কোনটিই সেই সময়কার বাস্তবতাকে নির্দেশ করে না। এর বড় প্রমাণ, সেই সিরিজ দুটির কোনোটিতেই পরে জয়ের ধারববাহিকতা ধরে রাখতে পারেনি বাংলাদেশ। এবারও তাই প্রথম দুয়েকটি ম্যাচ জিতে গেলেই বাংলাদেশের সব ঠিক হয়ে গেছে ভেবে আহ্লাদে গদ গদ হয়ে যাওয়ার কোনো কারণ নেই। এই বিশ্বকাপে বাংলাদেশ কেন ভাল করতে পারে সেই আলোচনা তো এতক্ষণ করলামই। কেন এটি হতে পারে বাংলাদেশের জন্য লজ্জার একটি বিশ্বকাপ এবার সেই দিকে দৃষ্টি ফেরানো যাক। দল ঘোষণায় দেরি হওয়ায় বিশ্বকাপ যাত্রার আগে মানসিক ভাবে প্রস্তুত হওয়ার জন্য খেলোয়াড়দের যে সময়টা দরকার ছিল সেটা যে তারা পায়নি সেকথা বলাই বাহুল্য। কেউ কেউ হয়তো বলতে পারেন দু’একজন ছাড়া অধিকাংশই খেলোয়াড়ইতো জানতো তারা যাচ্ছেন, কিন্তু অনেক সময় দেখা যায় দুই একজন নিয়ে অনিশ্চয়তা থাকলে দলে কার কি ভূমিকা থাকবে সেটা নিয়ে অন্যদের মাঝেও এক ধরণের অনিশ্চয়তা ভর করে। এই অনিশ্চয়তার মাঝেই তামিম ইকবালের বাদ পড়াটা প্রায় সবার জন্য একটা বড় ধাক্কা হয়েই আসে। ইনজুরি জনিত কারণে এর আগে অনেক গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়কে ছাড়া বিশ্বকাপ খেলেছে বাংলাদেশ। কিন্তু ২০১১ সালে মাশরাফি কিংবা ২০১৯ সালে তাসকিনের যে পরিস্থিতি ছিল, তামিমের বিষয়টা ছিল এবার কিছুটা ভিন্ন। মাশরাফি আর তাসকিনের ক্ষেত্রে প্রায় সবাই জানতো তারা বিশ্বকাপ যেতেও পারেন, না-ও পারেন। তামিমের বিষয়টা তা নয়। পিঠের ইনজুরি স্বত্বেও শেষ সময়ের এই নাটকটার আগে সবাই তামিমকে বিশ্বকাপ দলের সদস্য ধরেই নিয়েছিল। কিন্তু শেষ মুহূর্তে এভাবে ছিটকে পড়ায় তাতে একটু হলেও দলের অন্য সদস্যদের চিন্তা ভাবনায় ছেদ পড়েছে। তানজিদ তামিম যেমন জানতেন বিশ্বকাপ যদি যান তবে দুই একটি ম্যাচে তিনি সুযোগ পেলেও পেতে পারেন। আবার না-ও পেতে পারেন। শেষ সময়ে এসে তিনি জানলেন, তার হয়তো সব ম্যাচই খেলতে হতে পারে। এত দ্রুত এসব পরিস্থিতিতে মানিয়ে নেওয়া যে কারো জন্যই একটু কঠিন। দল ঘোষণা পরও যে খেলোয়াড় (দলে) নেই তাকে নিয়ে অধিনায়কের অহেতুক বক্তব্যও বাংলাদেশের জন্য শেষ পর্যন্ত বুমেরাং হতে পারে। যে সময়টায় সাকিব আল হাসানের প্রয়োজন ছিল প্রতিপক্ষ নিয়ে ভাবার, সেই সময়টায় দেখা গেল তিনি নিজেরই এক সময়কার সতীর্থের উপর তোপ দাগাচ্ছেন। এতে করে নিজের অজান্তেই হয়তো সাকিব নিজেকে বড় ধরনের চাপে ফেলে দিলেন, যার চড়া মূল্য তাকে দিতে হতে পারে বিশ্বকাপে চরম বাজে ফলাফল করে। এমনিতে সাকিবের নিজেকে প্রমাণ করার কিছু নেই। চার বছর আগে ইংল্যান্ডে যেভাবে খেলেছেন তাতে বাংলাদেশের ক্রিকেট কিংবা বিশ্বকাপ কোনোটাই তাকে বাদ দিয়ে লেখা সম্ভব নয়; কিন্তু সাকিব নিজেই স্বীকার করেছেন দলে এবার তার ভূমিকাটা ভিন্ন। আগেরবার যেমন তিনি কেবল নিজের ব্যাটিং-বোলিং নিয়েই ভেবেছেন এবার চাইলেও সেটা সম্ভব নয়। এই বিশ্বকাপে বাংলাদেশের পুরো দলটাই তার। সাফল্য-ব্যর্থতা ও সব তারই থাকবে। লেখক-যুগ্ম বার্তা সম্পাদক, নিউ এইজ