ভয়ংকর অপরাধেও রেহাই পেতে যাচ্ছেন বাঁশের কেল্লার পলাতক অ্যাডমিন!

প্রতিটি মামলার বাদি ও সাক্ষী সবাই পুলিশ । ৭ বছর ধরে কেউ সাক্ষ্য দিচ্ছেন না

লাতক বাঁশের কেল্লার অ্যাডমিন কে এম জিয়া উদ্দিন ফাহাদ। ছবি: সংগৃহীত

নিজস্ব প্রতিনিধি, বাঁশখালী »

বাদি ও সাক্ষীরা বারবার অনুপস্থিত থাকায় বিদেশে পলাতক বাঁশের কেল্লার অ্যাডমিন রাষ্ট্রবিরোধী অপরাধে জড়িত আলোচিত কে এম জিয়া উদ্দিন ফাহাদ গত ২৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকা সাইবার ট্রাইব্যুনালের বিচারক এ এম জুলফিকার হায়াতের আদালতে এক মামলায় খালাস পেয়েছেন। একই আদালতে চলমান পৃথক অপর ২টি মামলা গত ১৫ মে এবং গত ২০ মে সাক্ষীর জন্য ধার্য তারিখ থাকলেও বাদি এবং সাক্ষী কেউ উপস্থিত না হওয়ায় রাষ্ট্রপক্ষের পিপি সময় নিয়েছেন। ওই দুই মামলার সাক্ষীর জন্য আগামী ২ জুন ও ৫ জুন নতুন ধার্য তারিখ রাখা হয়েছে। সংশ্লিষ্টদের শঙ্কা একই কারণে এই ২টি মামলা থেকেও আসামিরা খালাস পেয়ে যেতে পারেন।

বাঁশখালীর পুলিশ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বিদেশে পলাতক বাঁশের কেল্লার প্রধান অ্যাডমিন জিয়া উদ্দিন ফাহাদের ব্যাপারে তার ভাই সাধনপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান কে এম সালাহ উদ্দিন কামালের কাছে বার বার তথ্য চাইলেও তথ্য দিচ্ছে না ।

আদালত সূত্রে জানা গেছে, নিয়ম রয়েছে বাদি ও সাক্ষী অনুপস্থিত থাকলে প্রথমে সমন জারি, পরে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি, তাতেও উপস্থিত না হলে অজামিনযোগ্য গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি, সর্বশেষ পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেওয়ারও বিধান রয়েছে। এতসব আইনি কাঠামো এড়িয়ে চাঞ্চল্যকর মামলা থেকে আলোচিত পলাতক আসামি খালাস পাওয়ার খবরে বাঁশখালীতে ব্যাপক আলোচিত হচ্ছে। আসামিরা মামলা থেকে খালাস পেতে আসামির প্রভাবশালী নিকটজন কিংবা আদালতকে একটি মহল বিভ্রান্ত করেছে বলে ধারণা করছেন বিভিন্ন আইনজীবী। বাঁশখালী আদালতের প্রবীণ আইনজীবী ও বারের সাবেক সভাপতি শামসুল ইসলাম বলেন, বিষয়টি তদন্ত করলে প্রকৃত সত্য বের হবে।

অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, ২০১৫ সালে তাকে গ্রেফতারের এক মাস আগে বাঁশখালীর সাধনপুর লটমনি পাহাড়ের র‌্যাব অভিযান চালিয়ে শহীদ হামজা ব্রিগেডের সামরিক প্রশিক্ষণ ঘাঁটি জঙ্গি আস্তানা উদ্ধারের ঘটনায় তার সম্পৃক্ততার কারণে তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য র‌্যাব ওই সময় জিয়া উদ্দিন ফাহাদকে বাঁশখালী সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে এনেছিল। রহস্যজনক কারণে ওই মামলায় চার্জশিটে তার নাম নাই এবং জঙ্গি আস্তানার জায়গা ও খামার বাড়ির মালিক তার নিকটাত্মীয় হাফেজ মোবারকেরও নাম নেই। সন্ত্রাস দমন বিশেষ ট্রাইব্যুনাল, চট্টগ্রামের আদালতে মামলা নম্বর এনটিটি ৪/১৮ চলমান সন্ত্রাস দমন আইনের এই মামলারও  সাক্ষীরা সাক্ষ্য দিতে দীর্ঘদিন ধরে অনুপস্থিত। বাদি সাক্ষ্য দিয়েছেন। ওই মামলায় আবারো সাক্ষীর জন্য আগামী ধার্য তারিখ ১৮ জুলাই।

ঢাকা সাইবার ট্রাইব্যুনালের পাবলিক প্রসিকিউটর (পি পি) মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম শামীম বলেন, বাদি ও সাক্ষীকে যাবতীয় প্রসেসে আদালতে ডাকা হয়েছিল কিন্তু কেউ আসেননি এমনকি আইজিপিকে পর্যন্ত ওদের বিষয়ে জানানো হয়েছে। এ কারণে ২০১৫ সালের মিরপুর মডেল থানার মামলার প্রেক্ষিতে ঢাকা সাইবার ট্রাইব্যুনাল মামলা ১০৩/২০১৭ থেকে চলতি বছরের ২৫ ফেব্রুয়ারি পলাতক আসামি কে. এম. জিয়াউদ্দিন ফাহাদ ও অপর আসামি ডা. শেখ শিবলী নোমান  খালাস পেয়েছেন। এ ব্যাপারে উচ্চ আদালতে যাওয়া হবে। তবে বাদি না আসলে উচ্চ আদালতে যাওয়া কঠিন হবে। বাকী যে ২টি রমনা মডেল থানার সাইবার ট্রাইব্যুনাল মামলা ১১৯/২০১৫ এবং পল্লবী মডেল থানার সাইবার ট্রাইব্যুনাল মামলা ৮৭/২০১৫ আছে সেগুলোতে যাতে খালাস না পায় সেজন্য সতর্ক আছি। এসব মামলায়ও সাক্ষীদের বিরুদ্ধে জামিন অযোগ্য গ্রেফতারি পরোয়ানা রয়েছে। ১১৯/২০১৫ মামলার গত ১৫ মে ধার্য ছিল সাক্ষীরা না আসায় নতুন তারিখ সাক্ষীর জন্য আগামী ২ জুন ধার্য করা হয়েছে।  ৮৭/২০১৫ মামলার ২০ মে  সাক্ষীর জন্য ধার্য তারিখ ছিল সাক্ষীরা না আসায় নতুন ধার্য তারিখ আগামী ৬ জুন করা হয়েছে। বাদি ও সাক্ষীদের আদালতে আনার যাবতীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

খালাসপ্রাপ্ত মামলার ২জন তদন্তকারী কর্মকর্তা কোন ধরনের নোটিশ পাননি বলে জানানোর ব্যাপারে জানতে চাইলে পিপি মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম শামীম বলেন, ওনারা তা অস্বীকার করছেন। আদালতে যাবতীয় প্রসেসের কাগজপত্র সংযুক্ত আছে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, মিরপুর মডেল থানার মামলাটির বাদি হয়েছিলেন ওই থানার এস আই মো. মাসুদ পারভেজ, বিপি নম্বর ৮৪১০১২৯১২৫। মামলার প্রথম তদন্তকারী কর্মকর্তা ছিলেন এস আই ইমরুল ফাহাদ বিপি নম্বর ৮৩০৮১২১৯০৮ । চার্জশিট প্রদানকারী সর্বশেষ তদন্তকারী কর্মকর্তা ছিলেন এস আই পলাশ হোসেন, বিপি নম্বর ৭৯৯৮০১৭৯৬৯ । তদন্তকারী কর্মকর্তা এস আই পলাশ হোসেন ও এস আই ইমরুল ফাহাদ বলেন, আমরা আদালতের কোন ধরনের নোটিশ পাইনি। আমাদের ফোন নম্বর রয়েছে তদন্ত প্রতিবেদনে। আদালত নোটিশ দিয়ে না পেলে আপনার মতো ফোন তো করতে পারতো । আপনি আমাদের পেলে, আদালত কেন পাবে না ? আমরা সাক্ষ্য দিতে সব সময় প্রস্তুত। বাদির মোবাইল নম্বর না পাওয়ায় কথা বলা যায়নি।

রমনা মডেল থানার মামলাটির বাদি ছিলেন ডিএমপি’র ডিবি(পশ্চিম)’র এস আই মো. আজিম আলী তালুকদার। বিপি নম্বর ৬১৮০০৩৮৫৩৯ । এজাহারে তার নামীয় মোবাইল নম্বর ০১৭১৮৮৩৪৬৭০ এ ৩ দিন ধরে ফোন দিলেও তিনি রিসিভ করেননি।

পল্লবী মডেল থানার মামলাটির বাদি ছিলেন ডিএমপি’র ডিবি(পশ্চিম)’র এস আই মো. তোফাজ্জল হোসেন। বিপি নম্বর ৫৯৭৯০৩৮৫৩১ । এজাহারে তার নামীয় কোন মোবাইল নম্বর নেই। এই মামলায় তদন্তকারী কর্মকর্তা ডিএমপি’র ডিবি( পশ্চিম)’র এস আই মো. মিজানুর রহমান বিপি নম্বর ৭২৯২০২৮৯৬৬ এর তদন্ত প্রতিবেদনে প্রদত্ত মোবাইল নম্বর ০১৭১২১৩৪৭১৫ নম্বরে ফোন দিলে এক নারী রিসিভ করে বলেন, অনেকেই এই নম্বরে তাকে খুঁজেন আসলে এটা ওনার নম্বর নয়, ভুল নম্বর।

২০১৫ সালের মার্চ মাসে ১০ দিন ধরে টিভি ও প্রিন্টিং মিডিয়ায় প্রতিদিনের আলোচিত খবর ছিল তৎ সময়ে আলোচিত ঘটনায় গ্রেফতার বাঁশখালীর সাধনপুর ইউনিয়নের বাণীগ্রামের কে. এম জিয়া উদ্দিন ফাহাদ। ডিএমপি ডিবি (পশ্চিম)’র একদল পুলিশ কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টের আবাসিক ভবনে তার বোনের বাসা থেকে বিভিন্ন ডিভাইসসহ ওই সময় গ্রেফতারের পর তার বিরুদ্ধে ঢাকার মিরপুর মডেল থানা, রমনা মডেল থানা ও পল্লবী মডেল থানায় ৩টি মামলাও হয়। ৩টি মামলায় ২৭ দিন রিমান্ডেও ছিল এই বাঁশের কেল্লার প্রধান সম্পাদক এবং ৫৮টি ফেসবুক পেইজের অ্যাডমিন ও এডিটরিয়াল অ্যাডমিন জিয়া উদ্দিন ফাহাদ। প্রত্যেকটি মামলার বাদি ও সাক্ষী ছিলেন পুলিশ এবং আইটি বিশেষজ্ঞরা। প্রত্যেকটি এজাহারে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল আসামিগণ নামে ও বেনামে ৫৮টি ফেসবুক আইডি ও ই-মেইল ব্যবহার করে দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের ব্যঙ্গচিত্র গ্রাফিক্স সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়ে দেশে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করা এবং তাদেরকে হত্যায় উদ্ধুদ্ধ করা।

বাঁশখালীর সাধনপুর ইউনিয়নের বাণীগ্রাম গ্রামের খোন্দকার ছমিউদ্দিনের ছেলে  কে এম জিয়াউদ্দিন আলোচিত ১টি মামলায় খালাস পাবার ঘটনাটি স্থানীয়ভাবে কেউ ভালো চোখে দেখছেন না। কেননা বাঁশখালীর সাধনপুর ইউনিয়নের লটমনি পাহাড়ের গভীর জঙ্গলে ২০১৫ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি রাতে ব্যাপক গোলা বারুদ সহ ৪ জঙ্গিকে র‌্যাব গ্রেফতার করেছিল। র‌্যাব কর্মকর্তারা জানিয়েছিল, বাঁশখালীর লটমণি পাহাড় ছিল শহীদ হামজা ব্রিগেডের সামরিক প্রশিক্ষণ ঘাঁটি। সেখানে প্রত্যেক সদস্য ১০ রাউন্ড করে গুলি ছুঁড়ে প্রশিক্ষণ নিত।  এর মধ্যে ৬ রাউন্ড গুলি ছোঁড়া হত একে ২২ থেকে আর অন্যান্য অস্ত্র থেকে ৪ রাউন্ড ছোঁড়া হত । ওই আসামিদের স্বীকারুক্তি মোতাবেক তার বোন অধ্যাপিকা ফাহমিদা আক্তারের বাসা কুমিল্লা সদর(উত্তর) এর কুমিল্লা ক্যাডেট কলেজের আবাসিক ভবন মহানন্দ ফ্ল্যাট বি/১৫ (৩য় তলা) থেকে ২০১৫ সালের ১২ মার্চ  ডিএমপি ডিবি(পশ্চিম) পুলিশ কে. এম জিয়াউদ্দিন ফাহাদকে গ্রেফতার করেছিল। তাকে র‌্যাব জিজ্ঞাসাবাদের জন্য বাঁশখালী আদালতেও এনেছিল।

বাঁশখালী থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) তোফায়েল আহমেদ বলেন, পলাতক ও গ্রেফতারি পরোয়ানা ভুক্ত আসামি কে এম জিয়া উদ্দিন ফাহাদ কিভাবে বিদেশে গেছে সেই তথ্য চেয়েছি তার ভাই সাধনপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান কে এম সালাহ উদ্দিন কামালের কাছে। তিনি জানিয়েছেন জিয়া উদ্দিন ফাহাদ নাকি মালয়েশিয়ায় অবস্থান করছেন। যাবতীয় তথ্য ও পাসপোর্টের কপি দিবে দিবে বলে দিচ্ছে না।