বাংলাদেশের অসহায় আত্মসমর্পণ

সুপ্রভাত ডেস্ক »

ক্রিস ওকসের অফ স্ট্যাম্পের বাইরের অফ কাটারে দূর থেকে ব্যাট এগিয়ে খোঁচা দিলেন লিটন দাস। বল জমা পড়ল জস বাটলারের গ্লাভসে। আম্পায়ার আঙুল তুলে দিতেই হতাশাভরা চাহনিতে ধীর পায়ে ড্রেসিং রুমে ফেরেন লিটন। তার এই অভিব্যক্তি যেন পুরো বাংলাদেশ দলেরই প্রতীকী চিত্র। হতশ্রী বোলিং-ফিল্ডিংয়ের পর ইংল্যান্ডের বিপক্ষেব্যাটিংয়েও আশা জাগানোর মতো কিছু করতে পারেনি সাকিব আল হাসানের দল। আফগানিস্তানকে হারিয়ে উড়ন্ত সূচনার পর বিশ্বকাপ অভিযানে বড় ধাক্কাই খেল বাংলাদেশ।

ধারামশালার হিমাচল প্রদেশ ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন স্টেডিয়ামে বাংলাদেশকে ১৩৭ রানে হারিয়েছে ইংল্যান্ড। ৩৬৫ রানের লক্ষ্যে ১০ বল আগেই ২২৭ রানে গুটিয়ে গেছে বাংলাদেশ।

বিশ্বকাপে বাংলাদেশের এর চেয়ে বড় ব্যবধানে পরাজয় রয়েছে আর দুটি। ২০১১ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে২০৬ রানে ও ২০০৭ সালে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে১৯৮ রানে। বাংলাদেশের বিপক্ষেবিশ্বকাপে এটিই ইংল্যান্ডের সবচেয়ে বড় জয়। বৈশ্বিক টুর্নামেন্টে তাদের এর চেয়ে বড় জয় আছে আর তিনটি।

টস জিতে ইংলিশদের ব্যাটিংয়ে পাঠানোর পর স্রেফ প্রথম ৬ ওভার বলা চলে ম্যাচে ছিল বাংলাদেশ। এরপর বাংলাদেশের হতাশাময় বোলিং-ফিল্ডিংয়ের মাঝে দাপুটে ব্যাটিংয়ে ক্রমেই ম্যাচের লাগাম নিজেদের হাতে নেয় ইংল্যান্ড। পরে বল হাতেও বাংলাদেশকে কোনো সম্ভাবনাই জাগাতে দেয়নি তারা।

ইংল্যান্ডের অনায়াস জয়ের বড় কারিগর দাভিদ মালান। ক্যারিয়ার সেরা ইনিংসে ১৪০ রান করে ম্যাচ সেরার পুরস্কার জেতেন বাঁহাতি ওপেনার। এছাড়া জো রুট ৮২, জনি বেয়ারস্টো খেলেন ৫২ রানের ইনিংস। পরে বল হাতে ৪ উইকেট নিয়ে বাংলাদেশের ব্যাটিং লাইন-আপ ধসিয়ে দেন রিস টপলি। খবর বিডিনিউজ।

হতাশার ম্যাচে শেষ দিকের বোলিংয়ে কিছু সাফল্য পান শেখ মেহেদি হাসান, শরিফুল ইসলাম। বাংলাদেশের দ্বিতীয় স্পিনার হিসেবে বিশ্বকাপে এক ম্যাচে ৪ উইকেট নেন মেহেদি। এক ওভারে দুটিসহ শরিফুল ধরেন ৩ শিকার। পরে রান তাড়ায় চমৎকার ব্যাটিংয়ে ফিফটি করলেও আলগা শটে উইকেট বিলিয়ে আসেন লিটন। মুশফিকের ব্যাট থেকেও আসে পঞ্চাশ ছোঁয়া ইনিংস।

রান তাড়ায় প্রথম পাওয়ার প্লেতেই মূলত ম্যাচ থেকে ছিটকে যায় বাংলাদেশ। নতুন বলে তানজিদ হাসান, নাজমুল হোসেন শান্ত, সাকিব আল হাসানকে ফেরান টপলি। খোঁচা মেরে দ্বিতীয় স্লিপে ক্যাচ দেন তানজিদ। প্রথম বলেই অফ স্ট্যাম্পের বাইরের ডেলিভারি তাড়া করে পয়েন্টে ধরা পড়েন শান্ত।

টপলি অফ স্ট্যাম্প লাইনে পিচ করে সোজা যাওয়া ডেলিভারির লাইনে যেতে পারেননি সাকিব। বল স্ট্যাম্প ভেঙে দেওয়ার পর বিস্ময়ের অভিব্যক্তিতে মাঠ ছাড়েন বাংলাদেশ অধিনায়ক।

আগের ম্যাচে তিন নম্বরে নেমে দারুণ ব্যাটিং করা মেহেদী হাসান মিরাজকে এদিন নামানো হয় পাঁচে। তবে টিকতে পারেননি। ক্রিস ওকসের বলে আলগা শটে কট বিহাইন্ড হন তিনি। পাওয়ার প্লের মধ্যে ৪ উইকেট হারিয়ে বিপদে পড়ে যায় বাংলাদেশ।

অন্য প্রান্তে আসা-যাওয়ার মিছিলে সাবলীল ছিলেন লিটন। পঞ্চম উইকেট জুটিতে মুশফিকের নির্ভরতা পেয়ে স্রেফ ৩৮ বলে স্পর্শ করেন ক্যারিয়ারের একাদশ ফিফটি। তবে সম্ভাবনাময় ইনিংসটি বড় করতে পারেননি তিনি। আউট হওয়ার আগে তিনি ৬৬ বলে ৭ চার ও ২ ছয়ে করেন ৭৬ রান।

লিটনের বিদায়ে ভাঙে ৭২ রানের পঞ্চম উইকেট জুটি। এরপর তাওহিদ হৃদয়কে নিয়ে এগোনোর চেষ্টা করেন মুশফিক। তবে ফিফটি ছুঁয়ে তিনিও বিলিয়ে আসেন নিজের উইকেট। টপলি শর্ট ডেলিভারি স্কয়ার কাট করে সোজা ডিপ থার্ড ম্যান ফিল্ডারের হাতে ক্যাচ দেন ৫১ রান করা অভিজ্ঞ কিপার-ব্যাটসম্যান।

এরপর হৃদয়, মেহেদি, তাসকিন আহমেদ, শরিফুল ইসলামদের ছোট ছোট ইনিংসে কোনোমতে দুইশ পেরোয় বাংলাদেশ। যা স্রেফ পরাজয়ের ব্যবধানই কমায়।

ম্যাচের প্রথমভাগে টপ-অর্ডারের তিন ব্যাটসম্যান মালানের সেঞ্চুরি এবং জনি বেয়ারস্টো ও জো রুটের পঞ্চাশ ছাড়ানো ইনিংসে এক পর্যায়ে চারশ রানের সম্ভাবনা জাগায় ইংল্যান্ড। তবে শেষ ১০ ওভারে লাগাম টেনে ধরে তাদের সাড়ে তিনশর আশপাশে রাখে বাংলাদেশ। তাতেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি।

বিশ্বকাপে প্রায় ৪৮ বছর পর ইংল্যান্ডের প্রথম তিন ব্যাটসম্যানের সবাই খেলেন পঞ্চাশ ছোঁয়া ইনিংস। ১৯৭৫ সালে বিশ্বকাপের প্রথম আসরে পূর্ব আফ্রিকার বিপক্ষেএই কীর্তি গড়েন ব্যারি উড, ডেনিস অ্যামিস, ফ্র্যাঙ্ক হেইস।

নতুন বলে পেসাররা উইকেট থেকে সুবিধা পাবেন এমন ভাবনায় আগে বোলিং নেয় বাংলাদেশ। কিন্তু শুরুতে মুস্তাফিজুর রহমান ছাড়া কেউই তেমন কোনো প্রভাব রাখতে পারেননি। কখনও বেরিয়ে যাওয়া ডেলিভারি, কখনও আচমকা বাউন্সারে মালান ও বেয়ারস্টোকে কিছুটা সমস্যায় ফেলেন মুস্তাফিজ।

শুরুর ওই ধাপ পেরিয়ে সহজেই রান তুলতে থাকেন ইংল্যান্ডের দুই ওপেনার। সঙ্গে যোগ হয় গ্রাউন্ড ফিল্ডিংয়ে বাংলাদেশের একের পর এক ভুল। বিশেষ করে ডিপে বেশ কয়েকবার হাতের নিচ দিয়ে বল চলে যায় বাউন্ডারিতে। ভাগ্যও বলা যায় ছিল ইংল্যান্ডের পক্ষে। টাইমিংয়ে গড়বড় হওয়া প্রায় সবগুলো শটেই বল পড়ে ফাঁকা জায়গায়।

দুই ওপেনারের জুটিতে আসে ১১৫ রান। জোরের ওপর ভেতরে ঢোকা ডেলিভারিতে ৫২ রান করা বেয়ারস্টোকে বোল্ড করে জুটি ভাঙেন সাকিব আল হাসান।

দ্বিতীয় উইকেটে মালান-রুট জুটি যোগ করেন ১৫১ রান, স্রেফ ১১৭ বলে। স্রেফ ৯১ বলে সেঞ্চুরি ছোঁয়ার পর ১৬ বলে আরও ৪০ রান যোগ করেন মালান। তাকে থামান শেখ মেহেদি। হালকা ঝুলিয়ে দেওয়া ডেলিভারি ক্রস ব্যাটে খেলতে গিয়ে বোল্ড হন মালান, ১৬ চার ও ৫ ছক্কা হাঁকান তিনি।
এরপর আর সেভাবে কোনো জুটি গড়ে উঠতে দেয়নি বাংলাদেশ। শরিফুলের অফ স্টাম্পের বাইরের নাকল বল স্টাম্পে টেনে আনেন জস বাটলার। পরের ওভারে শরিফুলের নাকল বলে পরাস্ত রুট হাওয়ায় ভাসিয়ে ক্যাচ দেন মুশফিকের গ্লাভসে। ৬৮ বলে ৮২ রান করে ফেরেন রুট। পরের বলে দারুণ অফ কাটারে বোল্ড হন লিয়াম লিভিংস্টোন।

তাসকিন আহমেদের বিবর্ণ দিন ও ৩২ ওভারের মধ্যে সাকিব আল হাসানের কোটা শেষ হয়ে যাওয়ায় শেষ দিকে বোলিংয়ের দায়িত্ব পড়ে মেহেদির কাঁধে। দারুণভাবেই সেটি পালন করেন ২৮ বছর বয়সী অফ স্পিনার।

প্রথম ৪ ওভারে ৩২ রান দিয়ে উইকেটশূন্য থাকা মেহেদি পরের ৪ ওভারে ধরেন ৪ শিকার। বিশ্বকাপে বাংলাদেশের দ্বিতীয় স্পিনার হিসেবে এক ম্যাচে ৪ উইকেট নেন তিনি। প্রথমজন সাকিব আল হাসান, দুইবার। মেহেদির ৪ উইকেটের জন্য খরচ ৮ ওভারে ৭১ রান। শরিফুল ১০ ওভারে ৭৫ রানে ধরেন ৩ শিকার। চেন্নাইয়ে শুক্রবার নিজেদের তৃতীয় ম্যাচে নিউ জিল্যান্ডের মুখোমুখি হবে বাংলাদেশ।