‘বড় ভাই বাবাকে ১০ টুকরো করে, আমি পাহারা দেই’

আদালতে শফিকুরের জবানবন্দি

সুপ্রভাত ডেস্ক »

নগরীর আলোচিত মো. হাসান আলী (৬১) হত্যাকা-ের ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলায় ভুক্তভোগীর ছেলে শফিকুর রহমান ওরফে জাহাঙ্গীর (২৯) আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। গতকাল মঙ্গলবার চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট সাদ্দাম হোসেনের আদালত তার জবানবন্দি গ্রহণ করেন। এতে অভিযুক্ত শফিক তার বাবাকে হত্যার কারণ ও মরদেহ টুকরো টুকরো করে গুম করার বিষয়টি বিস্তারিত আদালতকে জানান। খবর ঢাকা পোস্টের।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) চট্টগ্রাম মেট্রো ইউনিটের পরিদর্শক মো. ইলিয়াস খান জবানবন্দি গ্রহণের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

জবানবন্দিতে শফিক আদালতকে জানান, তিনি ছোটবেলা থেকে তার বাবাকে দেখেননি। প্রায় ২৭ বছর তার বাবা নিরুদ্দেশ ছিলেন। এসময়ে বড় ভাই ও মা তাকে দেখাশোনা করতেন। গত দেড় বছর আগে তার বাবা হঠাৎ ফিরে আসেন। বাবা ফিরে এসে তার চাচার যোগসাজশে তাদেরকে সম্পদ থেকে বঞ্চিত করার চেষ্টায় ছিলেন।

জবানবন্দিতে শফিক বলেন, বাবা মাকে কুফরি তাবিজ করেন। এতে মা অসুস্থ হয়ে যান। ঘটনার এক মাস আগে মা আমার বাসায় আসেন। এর আগে, গত রোজায় আব্বা আমাকে বলেছিলেন তার কোনো ছেলে নেই। এ কারণে আমি বাবার ওপর এমনিতেই ক্ষিপ্ত ছিলাম। ঘটনার একদিন আগে বাবা আমার ইপিজেড এলাকার বাসায় আসেন। পরদিন নানা বিষয়ে কথাবার্তার একপর্যায়ে আমি বাবাকে রশি দিয়ে মুখ-হাত বেঁধে বাসা থেকে বের হয়ে যাই।

শফিক বলেন, কয়েক ঘণ্টা পর ফিরে এলে আমার বড় ভাই মোস্তাফিজুর রহমান (৩২) জানান তিনি বাবাকে মেরে ফেলেছেন। এরপর বাবার মরদেহ বস্তাসহ আমার রুমে নিয়ে আসি। আনার পর আমার বউকে দিয়ে ধামাসহ অন্যান্য সরঞ্জাম আনাই। বড় ভাই বাবার মরদেহ বাথরুমে ঢুকিয়ে ১০ টুকরো করে। এ সময় আমি বাসার বাইরে পাহারা দেই। এরপর মরদেহের একটি অংশ একটি ছেলেকে দিয়ে ফেলে দেওয়াই। বাকি অংশ লাগেজে ভরে বড় ভাই পতেঙ্গা থানার ১২ নম্বর ঘাট এলাকায় ফেলে দেন। আর আমি এবং আমার স্ত্রী মিলে বাবার কাটা মাথাটি পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতে ফেলে দেই।

এর আগে ৬ অক্টোবর রাতে রাজধানীর হাজারীবাগ থানা এলাকা থেকে বাবাকে হত্যার ঘটনায় দায়ের করা মামলায় শফিকুরকে গ্রেপ্তার করে পিবিআই চট্টগ্রাম মেট্রো ইউনিটের কর্মকর্তারা। পরদিন তাকে নিয়ে পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতে তার বাবার কাটা মাথা উদ্ধারে তল্লাশি চালানো হয়। তবে মাথাটির খোঁজ মেলেনি। এরপর তাকে ওইদিন আদালতে হাজির করে তিন দিনের রিমান্ডে আনা হয়। রিমান্ডে ঘটনার বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে আজ (মঙ্গলবার) তাকে আদালতে হাজির করেন পিবিআই কর্মকর্তারা। আদালতে বিচারকের সামনে তিনি ঘটনার দায় স্বীকার করে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন।

জানা গেছে, ২১ সেপ্টেম্বর পতেঙ্গা থানার ১২ নম্বর ঘাট এলাকায় সড়কের পাশে পড়ে থাকা একটি লাগেজ থেকে মানুষের শরীরের ৮টি খ- উদ্ধার করা হয়। এর মধ্যে ছিল ২ হাত, ২ পা, কনুই থেকে কাঁধ এবং হাঁটু থেকে উরু পর্যন্ত অংশ। প্রতিটি অংশ কস্টটেপ দিয়ে মোড়ানো ছিল। তবে ওই লাগেজে ভুক্তভোগীর মাথা না থাকায় তাৎক্ষণিকভাবে পরিচয় শনাক্ত করতে পারেনি পুলিশ। এ ঘটনায় পতেঙ্গা থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) আব্দুল কাদির বাদি হয়ে অজ্ঞাতনামা ব্যক্তি বা ব্যক্তিদেরকে আসামি করে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন।

এদিকে, খ-বিখ- এই মরদেহের পরিচয় শনাক্ত ও রহস্য উন্মোচনে মাঠে নামেন পিবিআই কর্মকর্তারা। তারা প্রথমে ফিঙ্গারপ্রিন্টের সহায়তায় নিহত ব্যক্তি মো. হাসান বলে শনাক্ত করেন। জাতীয় পরিচয়পত্র অনুযায়ী হাসান বাঁশখালীর উপজেলার কাথারিয়া এলাকার সাহেব মিয়ার ছেলে। তার বর্তমান ঠিকানা লেখা আছে সিলেট সদরের সাধুর বাজার সংলগ্ন রেলওয়ে কলোনির এলাকায়।

পিবিআই জানায়, অন্তত ২৮ বছর ধরে ভুক্তভোগী হাসানের সঙ্গে পরিবারের যোগাযোগ ছিল না। এ সময়ে তিনি কোথায় ছিলেন তাও জানতেন না পরিবারের সদস্যরা। বছরখানেক আগে হঠাৎ তিনি বাড়িতে ফিরে আসেন। বাড়িতে হাসানের নামে কিছু পৈতৃক সম্পত্তি ছিল। যেটি বিক্রি করতে চেয়েছিলেন ভুক্তভোগী হাসান। এ নিয়ে বিরোধের জেরে ২০ সেপ্টেম্বর ইপিজেড থানার আকমল আলী রোডের পকেট গেট এলাকার জমির ভিলা ভবনের একটি বাসায় স্ত্রী-সন্তানরা মিলে হাসানকে হত্যা করে টুকরো টুকরো করে ফেলেন।

হত্যাকা-ের ঘটনায় ইতোমধ্যে ভুক্তভোগী হাসানের স্ত্রী ছেনোয়ারা বেগম (৫০), তাদের বড় ছেলে মোস্তাফিজুর রহমানকে ও ছোট ছেলে শফিকের স্ত্রী আনারকলিকে গ্রেফতার করে পিবিআই। তাদের দেওয়া তথ্যে হাসানের শরীরের অন্যান্য অংশ এবং হত্যার বেশ কিছু আলামত উদ্ধার করে পিবিআই কর্মকর্তারা। ২৭ সেপ্টেম্বর অভিযুক্ত মোস্তাফিজুর রহমান চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট সাদ্দাম হোসেনের আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। এতে তিনি বাবাকে হত্যার কারণ, কীভাবে হত্যা করা হয় এবং কীভাবে মরদেহ ফেলে দেওয়া হয় তার বর্ণনা দেন। এরপর ৩ অক্টোবর একই আদালতে ঘটনার দায় স্বীকার করে জবানবন্দি দেন আনারকলি।